ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মাহিকে সান্ত¡না দিয়েই আবার আড়ালে গিয়ে কাঁদছেন তারা

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২১ মার্চ ২০১৮

মাহিকে সান্ত¡না দিয়েই আবার আড়ালে গিয়ে কাঁদছেন তারা

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ বাবা ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান ক’দিন আগে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। বাবার শোকে মা আফসানা খানমকে হারাতে বসেছে তাদের একমাত্র সন্তান তামজিদ সুলতান মাহি (১৪)। রাজধানীর নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে আফসানাকে দেখতে এসে তার স্কুল শিক্ষক, স্কুলের বন্দুরা এবং স্বজনেরা এমন কথা বলছে বারবার। মাহিকে সান্ত¡না দিয়েই আবার আড়ালে গিয়ে কাঁদছেন তারা। এদিকে সোমবার থেকে আফসানা রাজধানীর নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আফসানার হার্ট, কিডনি, লিভারসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে। মঙ্গলবার বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে তার সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের পক্ষ থেকে প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়। হাসপাতালের যুগ্ম-পরিচালক প্রফেসর বদরুল আলম সাংবাদিকদের জানান, আফসানার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। তবে তার হার্টবিট আছে। কিডনি, লিভার সবই কাজ করছে। ব্লাড প্রেসার ১২০ বাই ৮০। আমরা তার চিকিৎসা চালিয়ে যাব। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে আফসানার মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে অধ্যাপক বদরুল আলম জানান, তার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন ও আশঙ্কাজনক। এটা আমরা বলতে পারি। কিন্তু তিনি এখনও জীবিত আছেন। নেচারালি ডেড না হলে তো আমরা ডেড বলতে পারি না। তিনি জানান, আফসানার চিকিৎসার জন্য গঠিত ১৪ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড তার চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বুধবার সকালে সাত সদস্যের আরেকটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করার কথা ভাবা হচ্ছে। তাকে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নেয়ার প্রয়োজন আছে কিনাÑ এমন প্রশ্নের জবাবে প্রফেসর বদরুল আলম জানান, বাইরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। কারণ যে পরিমাণ ভেন্টিলেশন তার দরকার সেটা দেয়া সম্ভব হবে না। তার ব্রেনের ওপরের খুলির একটা অংশ খুলে রাখা হয়েছে। ব্রেনের প্রেসার কমলে ওটা আবার লাগানো হবে। আবিদের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু জানান, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে প্রথম মৃত্যু সংবাদটি শুনে কোনভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না ভাবী আফসানা খানম। অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। পরে তিনি বেঁচে আছেন জেনে একটু স্বাভাবিক হন। কিন্তু পরদিন যখন জানতে পারলেন উনি মারা গেছেন, তারপর থেকে তিনি একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছিলেন। আসলে এত বড় শোক সহ্য করতে পারেননি। রবিবার সকালে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে উত্তরার একটি ক্লিনিকে নেয়া হয়। নিউরোসায়েন্সে আনার পর আফসানা খানমের মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধার আলামত খুঁজে পান চিকিৎসকরা। একটি মেডিক্যাল বোর্ডের সিদ্ধান্তে সহযোগী অধ্যাপক সিরাজী শফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে আফসানা খানমের অস্ত্রোপচার হয় রবিবার। তাকে রাখা হয় আইসিইউতে। কিন্তু অবস্থার অবনতি হলে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। ওইদিন রাত ১১টার দিকে আফসানা আবার স্ট্রোক করেন। তার অবস্থা ক্রিটিক্যাল দেখে আবার অপারেশন করেন চিকিৎসকরা। অপারেশনের পর তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, তার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। ডায়াবেটিস থাকায় অবস্থা আরও জটিল বলেও জানান তারা। সোমবার চিকিৎসকরা বলছেন, তার বাঁচার সম্ভাবনা মাত্র দুই শতাংশ। অন্যদিকে আফসানার অবস্থা সঙ্কাপন্ন কথা শুনে সোমবার সকাল থেকেই হাসপাতালটির আইসিইউয়ের সামনে ভর্তি থাকা আফসানাকে দেখতে এসে স্কুল শিক্ষক, স্কুলের বন্ধুরা এবং স্বজনেরা এসে ভিড় জমান। সবাই তাদের একমাত্র সন্তান মাহিকে সান্ত¡না দিচ্ছেন, তোমার মায়ের কিচ্ছু হবে না। ডাক্তার বলেছেন, মা ভাল হয়ে যাবেন। সান্ত¡না দিয়েই তারা আড়ালে গিয়ে কাঁদছেন। মাহিকে ঘিরে আছেন স্বজনেরা। তার সঙ্গে কথা বলছেন। চেষ্টা করছেন তাকে দিয়ে কথা বলাতে। মাহির বন্ধু তাশফি জানান, আগামী ১ মে থেকে আমাদের ‘ও’ লেভেল পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। রবিবার পর্যন্ত মাহি আমাদের সঙ্গে কথা বলেছিল। কিন্তু আজ আর কোন কথা বলছে না। সে নির্বাক হয়ে থাকছে। আমাদের স্কুলের শিক্ষকরা, বন্ধুরা, আত্মীয়রা তাকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছি। তার মা ভাল আছেন, ভাল হয়ে ফিরবেন। এ কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন তাশফি। নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাহি জানেও না তার মায়ের বাঁচার সম্ভাবনা খুব কম। সে বিশ্বাস করে, বাবার মতো মা অন্তত তাকে ছেড়ে যাবে না। ক্যাপ্টেন আবিদসহ ওই দুর্ঘটনায় নিহত ২৩ জনের মরদেহ রবিবার বিকেলে দেশে ফিরিয়ে এনে আর্মি স্টেডিয়ামে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। মাহির বন্ধু তাশফি জানান, ওইদিন বিকেলে মাকে হাসপাতালে রেখে শেষবারের মতো বাবার লাশ আনতে গিয়েছিলেন আবিদ-আফসানার একমাত্র ছেলে তানজিদ সুলতান মাহি। পরে আবিদকে বনানীর সামরিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। মাস্টারমাইন্ডের আরও কয়েকজন শিক্ষক মাহিকে সান্ত¡না দেয়ার জন্য এসেছিলেন। এ সময় কথা হয় মাস্টারমাইন্ডের ধানমন্ডি শাখার কর্মকর্তা মাসুমা আক্তারের সঙ্গে। তিনি জানান, ছেলেটার (মাহি) বাবা নেই। তার মায়ের অবস্থা খুব ভাল নয়। তবে অনেক গুজব শুনছি। আমরা এসেছিলাম ছেলেটাকে সান্ত¡না দিতে। আফসানার বড় বোনের মেয়ে মিম, খালামনির মুখ ফুলে আছে। মুখে অক্সিজেন দেয়া রয়েছে। বোঝা যাচ্ছে তিনি দম নিচ্ছেন।
×