ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভুল বুঝতে পেরে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী ফয়জুরের

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ২০ মার্চ ২০১৮

ভুল বুঝতে পেরে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী ফয়জুরের

শংকর কুমার দে ॥ বিশিষ্ট লেখক ও সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টায় তার ওপর হামলাকারী ফয়জুর আদালতে জবানবন্দীতে বলেছে, জাফর ইকবাল সম্পর্কে জানতে পেরে সে অনুতপ্ত। নিজের ভুল বুঝতে পেরে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে ফয়জুর। জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ করার অভিযোগে সহযোগী বন্ধু সোহাগকে গ্রেফতার করে সোমবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালত থেকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। গ্রেফতার করা সোহাগের কাছ থেকে হামলাকারী ফয়জুরের ব্যবহৃত একটি কম্পিউটার জব্দ করা হয়েছে। সোহাগ ছাড়াও কুয়েত প্রবাসী চাচা আব্দুল জাহার তাকে উগ্র মতাদর্শের জঙ্গীবাদের দিকে নিয়ে গেছে। জাফর ইকবালের লেখা ‘ভূতের বাচ্চা সুলায়মান’ নামের একটি বই পড়ে ক্ষিপ্ত হয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে তার ওপর হামলা করেছে বলে জবানবন্দীতে উল্লেখ করেছে ফয়জুর। সে রবিবার নিজের দোষ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়ার পর তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। নতুন করে জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ করার অভিযোগে সহযোগী সোহাগ ছাড়াও তার ভাই এনামুল হাসান এখন রিমান্ডে পুলিশের হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ফয়জুর আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে জাফর ইকবালকে হত্যার পরিকল্পনার বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে আরও কয়েকজনের নাম উল্লেখ করেছে যারা তাকে জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ করেছে। জাফর ইকবালকে হত্যার উদ্দেশ্য নিয়েই হামলা চালিয়েছিল বলে স্বীকার করেছে সে। জবানবন্দীতে সে বলেছে, কুয়েত প্রবাসী চাচা আব্দুল জাহার বিভিন্ন প্রলোভন দিয়ে উগ্র মতাদর্শের দিকে নিয়ে যায় এবং জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়াসহ হামলার পরিকল্পনার আরও অনেক তথ্যও জানিয়েছে হামলাকারী ফয়জুর হাসান। কুয়েত প্রবাসী চাচা আব্দুল জাহার বিভিন্ন প্রলোভন দিয়ে উগ্র মতাদর্শের দিকে নিয়ে চাচার দেয়া ল্যাপটপেই ইউটিউবে নিয়মিত উগ্রপন্থী ওয়াজ শুনত সে। জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে কয়েকজনের পরামর্শে সে জাফর ইকবালকে হত্যার পরিকল্পনা করে। গত রবিবার ১৮ মার্চ সিলেট মহানগর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তৃতীয় আদালতের বিচারক হরিদাস কুমারের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে এসব কথা জানিয়েছে হামলাকারী ফয়জুর। ফয়জুল তার জবানবন্দীতে জানিয়েছে, পরিকল্পনা অনুযায়ী সে জাফর ইকবালকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করে। তবে তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোন জঙ্গী সংগঠনের যোগাযোগ থাকার কোন প্রমাণ তদন্তে পাওয়া যায়নি। ফয়জুর আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে বলেছে, জাফর ইকবালের লেখা ‘ভূতের বাচ্চা সুলায়মান’ নামের একটি বই পড়ে ক্ষিপ্ত হয় সে। হামলার সময় সে একাই ছিল বলে আদালতে জানায়। জিন্দাবাজারের রাজা ম্যানশনের কম্পিউটারের দোকানে চাকরি করার সময় জঙ্গীবাদ সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্ট ও জঙ্গীবাদের কয়েকটি ওয়াজসহ একটি মেমোরি কার্ড দেয় তার পূর্বপরিচিত একজন। জবানবন্দীতে সে মেমোরি কার্ড দেয়া ওই ব্যক্তির নামও বলেছে। জবানবন্দীতে ফয়জুর বলেছে, জাফর ইকবালের ওপর হামলা করার জন্য তার মামাসহ আরও কয়েকজন নানাভাবে উৎসাহিত করেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেছেন, জাফর ইকবালকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে যারা উৎসাহিত করেছে তাদের কয়েকজনের নাম আদালতকে জানিয়েছে ফয়জুর। হত্যা চেষ্টার জন্য হামলার পর জাফর ইকবাল সম্পর্কে জানতে পেরে সে অনুতপ্ত হয় বলে জানিয়েছে আদালতকে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে সে। ফয়জুর জানিয়েছে, তার সঙ্গে অন্য কোন জঙ্গী সংগঠনের যোগাযোগ নেই। তার কুয়েত প্রবাসী চাচাই মূলত জঙ্গীবাদে জড়াতে উৎসাহিত করেন ফয়জুরকে। সাত দিনের রিমান্ডে সোহাগ ॥ জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারী ফয়জুর হাসানের বন্ধু সোহাগ মিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের হেফাজতে নেয়ার অনুমতি পেয়েছে পুলিশ। সোমবার দুপুরে সিলেট মুখ্য মহানগর হাকিম সাইফুজ্জামান হিরোর আদালতে হাজির করা হয় তাকে। রিমান্ড শুনানি শেষে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করার আদেশ দেন আদালত। ফয়জুরকে জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ করার অভিযোগে সোহাগকে রবিবার রাতে সিলেট নগরীর কালিবাড়ি এলাকা থেকে আটক করে পুলিশ। তার সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করলে শুনানি শেষে আদালত মঞ্জুর করেন। সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের সাদিকুর রহমানের ছেলে ২৪ বছর বয়সী সোহাগ মিয়ার কাছ থেকে ফয়জুরের ব্যবহৃত একটি কম্পিউটারও জব্দ করা হয়েছে। গত ৩ মার্চ বিকেলে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে এক অনুষ্ঠান চলাকালে জাফর ইকবালকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার ওপর হামলা করে মাদ্রাসা ছাত্র ফয়জুর হাসান। হামলা করার সময়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তাকে ধরে পিটুনি দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেন হামলাকারী ফয়জুরকে। কম্পিউটার সায়েন্স এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক জাফর ইকবালকে রক্তাক্ত জখম অবস্থায় প্রথমে নেয়া হয় সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে অস্ত্রোপচার শেষে রাতেই তাকে পাঠানো হয় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। এ ঘটনায় ফয়জুরসহ অজ্ঞাত পরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে পরদিন সিলেটের জালালাবাদ থানায় মামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। রবিবার আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেয় হামলাকারী ফয়জুর হাসান। এর আগে গত ৮ মার্চ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ফয়জুরকে দশ দিনের হেফাজতে নেয়া হয়। জঙ্গীবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থানের কারণে বহুবার জাফর ইকবালকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। সেজন্য সরকারের তরফ থেকে তাকে পুলিশী নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। জাফর ইকবাল ‘ইসলামের শত্রু’ বলে মনে করে, এ কারণেই তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করেছে বলে ফয়জুর স্বীকার করেছে। এরপর গত ১১ মার্চ হামলাকারী ফয়জুরের বাবা মাওলানা আতিকুর রহমান ও মামা ফজলুর রহমানকে পাঁচ দিনের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠানো হয়। কারাগারে পাঠানো হয়েছে রিমান্ড শেষে হামলাকারীর মা মিনারা বেগমকেও। সর্বশেষ ১৩ মার্চ তার ভাই এনামুল হাসানকে আদালতের অনুমতিতে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। সোমবার হামলাকারী ফয়জুরের সহযোগী বন্ধু সোহাগকে জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ করার অভিযোগে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
×