ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শান্তির প্রত্যাশায় জ্বলে ওঠা শিল্পিত ক্যানভাস

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২০ মার্চ ২০১৮

শান্তির প্রত্যাশায় জ্বলে ওঠা শিল্পিত ক্যানভাস

মনোয়ার হোসেন ॥ সময় যখন অস্থির, তখন প্রবলভাবে সচকিত শিল্পীর ক্যানভাস। সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী রূপ নেয় চিত্রকরের চিত্রপট। শান্তির প্রত্যাশায় ধাবিত হয় রং-তুলির আঁচড়। এককালের রণাঙ্গনের যোদ্ধা ও বর্তমানের চিত্রশিল্পী চালিয়ে যান শিল্পিত সংগ্রাম। তেমনই কিছু তেজস্বী ও শান্তির মর্মবাণীময় ছবি নিয়ে হাজির হয়েছেন শাহাবুদ্দিন আহমেদ। শহরের শিল্পানুরাগীদের হৃদয় রাঙানো আয়োজনটি চলছে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায়। সেগুন বাগিচার বিশাল প্রদর্শনালয়টির দুই নং গ্যালারিতে শুরু হলো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই শিল্পীর প্রদর্শনী। সেই শিল্পসম্ভারের শিরোনাম ‘শান্তি’। সোমবার চৈতালি বিকেলে প্রদর্শনীটির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে শিল্পের সৃজনশৈলীতে মুগ্ধ হয়ে শিল্পীকে সঙ্গী করে প্রধানমন্ত্রী ঘুরে বেড়িয়েছেন প্রদর্শনালয় জুড়ে। আর বিকেল গড়ানো সন্ধ্যায় সুন্দরতম শিল্পের টানে সমাগত হয়েছিলেন শিল্প রসিকসহ সাধারণজন। দু’চোখ ভরে দেখেছেন রং ও রেখার মিতালীতে কথা বলা বহুতল বিস্তৃত একগুচ্ছ ছবি। সেসব চিত্রপটে ধরা দিয়েছেন বাঙালী জাতিসত্তার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু, মননের দিশারী রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে শান্তির বার্তাবাহক মহাত্মা গান্ধী। চিত্রনের মুন্সিয়ানায় সাদা স্পেসের ভেতর থেকে তারা যেন আবির্ভূত হয়েছেন ধূমকেতুর মতো করে। শিল্পী যেহেতু মুক্তিযোদ্ধা তাই সহজাতভাবে এসেছে স্বাধীনতা সংগ্রামের ছবি। গতিময় চিত্রনের বিশাল ক্যানভাসগুলো বিছিয়ে দেয়া হয়েছে প্রদর্শনালয়ের দেয়ালজুড়ে। রঙের ব্যবহারের সঙ্গে রেখার সংযোগে অনবদ্য হয়ে ধরা দিয়েছে রাজনীতি সচেতন শিল্পীর বহুমাত্রিক চিত্রপট। যৌথভাবে এ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও কলকাতার গ্যাঞ্জেস আর্ট গ্যালারি। একটি চিত্রপটে দেখা মেলে শান্তির সন্ধানী মহাত্মা গান্ধীকে। মানবিক শক্তিতে ভর করে তিনি হেঁটে বেড়াচ্ছেন অহিংস পথের খোঁজে। শুভ্র বর্ণের ভেতর দিয়ে চমৎকার অবয়বে উপস্থাপিত হয়েছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৫ আগস্ট শিরোনামের ছবিটি সাক্ষ্য দেয় পঁচাত্তরের সেই নির্মমতার। ঘাতকের বুলেটে রক্তস্রোতের মাঝে নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে আছেন জাতির জনক। একটু দূরে এক কোণে পড়ে আছে তাঁর চশমা। বঙ্গবন্ধু শিরোনামের ছবিতে আবির্ভূত হয়েছেন চিন্তামগ্ন শেখ মুজিব। দু’চোখ বন্ধ করে ভাবনায় ডুবে যাওয়া মানুষটির মাথার পেছনে উড়ছে লাল-সবুজের পতাকা। প্লাটুন শিরোনামের ছবিতে নিজের যোদ্ধা জীবনে প্রতিকৃতি এঁকেছেন শিল্পী শাহাবুদ্দিন। ফ্রিডম শিরোনামের চিত্রকর্মে দারুণ গতিময়তায় মেলে ধরেছেন শঙ্কাহীন মুক্তিসেনার ছুটে চলা। যুদ্ধ-কান্না শীর্ষক চিত্রপটে উঠে এসেছে সোচ্চার কণ্ঠস্বরের এক মুক্তিসেনা। আর্টিয়ের লা জেনোসাইড শিরোনামের ছবিটি মনে করিয়ে দেয় একাত্তরের গণহত্যার বিভীষিকার কথা। স্তুপ করে রাখা হাজারো লাশের মাঝ থেকে উঠে আসা এক নারী হয়ে ওঠে স্বাধীনতার প্রতীক। অনেক মুষ্টিবদ্ধ হাতের প্রতিচ্ছবিতে আঁকা লা ভিক্টোরি নামের ছবির মাধ্যমে চূড়ান্ত মুক্তির বারতা দিয়েছেন শিল্পী। প্রদর্শনীর উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করা হয় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায়। এখানেই প্রদর্শনীর উদ্বোধন ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুভূতি ব্যক্ত করে বক্তব্য দেন শাহাবুদ্দিন আহমেদ। স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন গ্যাঞ্জেস আর্ট গ্যালারির পরিচালক স্মিতা বাজোরিয়া। সভাপতিত্ব করেন সংস্কৃতি সচিব মোঃ ইব্রাহীম হোসেন খান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উন্মোচিত হয় শাহাবুদ্দিন আহমেদের লেখা ‘আমার মুক্তিযুদ্ধ’ গ্রন্থের মোড়ক। প্রদর্শিত হয় শিল্পীর ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘কালার অফ ফ্রিডম’র অংশবিশেষ । উদ্বোধনী বক্তব্যে শাহাবুদ্দিনকে নিজের ‘ছোট ভাই’ বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। শিল্পীর দীর্ঘজীবন কামনা করে তিনি বলেন, রং তুলিতে সে যেন মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের গাঁথা যেন গেয়ে যায়। দেশের আন্দোলন-সংগ্রামে শিল্পীদের অনবদ্য ভূমিকার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের সকল অর্জন-আন্দোলন-সংগ্রামে সকল স্তুরের শিল্পীরা অবদান রেখেছেন। মার্শাল ল’র সময় যখন রাজনীতিবিদরা কথা বলতে পারছিলেন না তখন শিল্পীরা তাদের নাটক, সঙ্গীত ও চিত্রকলায় কথা বলেছেন। অনুভূতি প্রকাশে বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রবল অনুরাগের কথা ব্যক্ত করে শাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন, আমার জীবনের তিনটি দিক আছে। এগুলো হলোÑ ছবি আঁকা, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্যারিসে যাওয়ার আগে দেশে দুর্ভিক্ষ চলছিল। সে সময় আমি ২৭ হাজার টাকা সংগ্রহ করে তার তহবিলে দেয়ার জন্য চেক দিতে গিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, এ টাকা তোর বাবারে দে। আমি তাকে জোর করে চেকটা দেই। সে সময় তার চোখ দিয়ে পানি বেরিয়েছিল। সেটাই ছিল তার সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাত। তিনি রাজনীতিবিদ নন, কারণ, রাজনীতিবিদরা কাঁদতে পারেন না। তিনি ছিলেন মানুষ। এর আগে ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় কলকাতায় এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছিলেন। পরবর্তীতে ভারতের মুম্বাইতেও একই প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ঢাকার পর দিল্লিতেও প্রদর্শনীটি করার পরিকল্পনা রয়েছে। তেলরংয়ে আঁকা ৩২টি চিত্রকর্ম দিয়ে সাজান প্রদর্শনী। দর্শনার্থীরা প্রদর্শনীটি অবলোকনের জন্য সময় পাবেন প্রায় এক মাস। আগামী ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে এ শিল্প-আয়োজন। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
×