ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জেতা ম্যাচ শেষ বলে হেরে গেল বাংলাদেশ॥ শিরোপা ভারতের

প্রকাশিত: ০৭:৩২, ১৯ মার্চ ২০১৮

জেতা ম্যাচ শেষ বলে হেরে গেল বাংলাদেশ॥ শিরোপা ভারতের

মিথুন আশরাফ ॥ এক বলে জিততে ভারতের ৫ রান দরকার। শেষ মুহূর্তের টান টান উত্তেজনা। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা, উত্তাপ,স্নায়ুচাপ। সব ঘিরে ধরে। যে কোন দলই জিততে পারে। এমন মুহূর্তে দিনেশ কার্তিক ছক্কা হাঁকিয়ে দিয়ে ভারতকে জিতিয়ে দেন। বাংলাদেশকে ৪ উইকেটে হারিয়ে নিদাহাস ট্রফির চ্যাম্পিয়ন হলো ভারত। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের পর থেকেই উত্তেজনা শুরু হয়েছে। সেখানে ফাইনাল ম্যাচ হলে তো কথাই নেই। উত্তেজনার পারদ শুরু থেকেই ছিল। যখন শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে ফাইনালে খেলা নিশ্চিত করে বাংলাদেশ, তখন থেকেই উত্তাপ শুরু হয়ে যায়। এই ম্যাচটি নিয়ে ভারত চাপেও থাকে। সাব্বির রহমান রুম্মনের ৭৭ রানের সুবাদে ভারতকে ১৬৭ রানের টার্গেট দিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু তাতেও কোন কাজ হলো না। ভারতের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন আপকে ছন্নছাড়া করা গেলন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে দিনেশ কার্তিককেই রুখে দেয়া গেল না। আগে ব্যাটিং করে ৮ উইকেট হারিয়ে ২০ ওভারে ১৬৬ রান করে বাংলাদেশ। রোহিতের ৫৬ রানের পর ৮ বলে কার্তিকের করা অপরাজিত ২৯ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ২০ ওভারে ১৬৮ রান করে জয়ের বন্দরে পৌঁছে ভারত। টস জিতলেই ফিল্ডিং। নিদাহাস ট্রফিতে সব দলের যেন এই একটিই মন্ত্র হয়ে যায়। টার্গেট অতিক্রম করার দিকেই যেন তাগিদ দেখা যায়। ফাইনাল ম্যাচেও ভারতও টস জিতেই নেয় ফিল্ডিং। টার্গেট সহজেই অতিক্রমও করে। কোথায় ‘নাগিন নাচে’ উৎসব হবে ভাবা হয়েছে। সেখানে ভারত সমর্থকরা শুরু থেকেই এই নাচে মেতে ওঠেন। তাতে সমর্থন দেন শ্রীলঙ্কান দর্শকরাও। শেষদিকে ভারত ও শ্রীলঙ্কান সমর্থকদের সেই নাচ থেমেও গিয়েছিল। উল্টো বাংলাদেশ সমর্থকরা ‘নাগিন নাচে’ মাতে। কিন্তু কার্তিক সেই নাচ অবিশ্বাস্য ছক্কায় থামিয়ে দেন। সর্বনাশ ডেকে আনল বাংলাদেশের। শুরুতেই শিখর ধাওয়ান (১০) ও সুরেশ রায়নাকে (০) আউট করা গেলেও রোহিত শর্মা যে ধুমধারাক্কা ব্যাটিং করতে থাকেন, তাতেই ভারত পাওয়ার প্লেতে ৫৬ রান করে জেতার অনেকদূর এগিয়ে যায়। ৮৩ রানে গিয়ে লোকেশ রাহুলকে (২৪) রুবেল আউট করে দেন। কিন্তু ততক্ষণে ভারতের হাতে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে। রোহিত যে উইকেটে থাকেন। সুযোগ পেলেই যে ছক্কা-চার হাঁকাতে থাকেন। ৩৫ বলে হাফসেঞ্চুরিও করে ফেলেন রোহিত। ৯৮ রান হতেই ম্যাচ বাংলাদেশের দিকে ঘুরে যায়। যখন নাজমুল ইসলাম অপুর বলে লং অনে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের হাতে ক্যাচ আউট হন রোহিত (৪২ বলে ৫৬ রান)। চাপও পড়ে ভারত। কিন্তু সেই চাপ যেন মানিষ পা-ে উতরে নিতে থাকেন। নবম ওভারে বাউন্ডারি হওয়ার পর ১৪তম ওভারে গিয়ে বাউন্ডারি হয়। তাতেই বোঝা যায়, কী চাপ তৈরি হয়। ১৮ বলে গিয়ে ৩৫ রান দরকার ছিল। এমন মুহূর্তে মুস্তাফিজুর রহমান বোলিং করতে এসে ১ রান দিয়ে ১টি উইকেটও নেন। যদিও বাই থেকে আসে রানটি। তাতে মেডেন ওভারই হয়। পা-েকে (২৮) আউট করে দেন মুস্তাফিজ। ১২ বলে জিততে ৩৪ রান লাগে। বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে ম্যাচ। কিন্তু রুবেলের করা ১৯তম ওভারেই খেলা আবার ভারতের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। যে রুবেল এত ভাল বোলিং করেন। তিনিই যেন ডুবিয়ে দিলেন। ওভারটিতে দুই ছক্কা, দুই চারসহ ২২ রান নিয়ে নেন দিনেশ কার্তিক। তাতেই খেলা ভারতের মুঠোয় চলে আসে। ৬ বলে জিততে তখন ১২ রান লাগে। সৌম্য বোলিংয়ে এসে ২ বলে ২ রান দেন। ৪ বলে জিততে ১০ রান দরকার থাকে। চরম উত্তেজনা তৈরি হয়। তৃতীয় বলে ১ রান আসে। ৩ বলে দরকার থাকে ৯ রান। চতুর্থ বলে গিয়ে ৪ রান হয়। ২ বলে জিততে ৫ রান লাগে। পঞ্চম বলে বিজয় শংকরকে (১৭) আউট করে দেন সৌম্য। ১ বলে জিততে ৫ রান লাগে। সে কী উত্তেজনা। শেষ বলে ছক্কা হাঁকিয়ে দিয়ে ম্যাচ জিতিয়ে দেন কার্তিক। ভারতের বিপক্ষে এমন বড় ম্যাচে কখনই জিততে পারেনি বাংলাদেশ। ভারতের বিপক্ষে কোন টি২০তে জিততে পারেনি। এখন পর্যন্ত কোন প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচের ফাইনালেও জিততে পারেনি বাংলাদেশ। ২০১৬ সালে এশিয়া কাপ টি২০র ফাইনালেও ভারতের কাছে হারে। ভারতের বিপক্ষে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচটি তাই বাংলাদেশের জন্য মহাগুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। জেতার সুযোগও তৈরি হয়। কিন্তু ২০১৬ সালের টি২০ বিশ্বকাপে ব্যাঙ্গালুরুতে যেমন হতাশার নিঃশ্বাস ফেলতে হয়। এবারও তাই হয়। হতাশা নিয়েই মাঠ ছাড়তে হয়। ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশের শুরুটা অবশ্য একটু ঝিমানো হয়েছে। প্রথম ওভারের শেষ বলে গিয়ে বাউন্ডারি হাঁকান ওপেনার তামিম ইকবাল। দ্বিতীয় ওভারে কোন বাউন্ডারি হয়নি। তৃতীয় ওভারে গিয়ে আবার দ্বিতীয় বলেই ছক্কা হাঁকান ওপেনার লিটন কুমার দাস। চতুর্থ ওভারে গিয়ে ওয়াশিংটন সুন্দরের স্লো বলটিতে স্লগ সুইপ করতে গিয়ে লিটন (৯ বলে ১১ রান) আউট হয়ে যান। ২৭ রানেই প্রথম উইকেটের পতন ঘটে যায়। দেখতে দেখতে যুভেন্দ্র চাহালের বলে তামিমও (১৩ বলে ১৫ রান) সাজঘরে ফেরেন। মনে হচ্ছিল, ছক্কা হয়ে যাবে। কিন্তু লং অনে একেবারে সীমানা দড়ির সামনে থেকে অসাধারণ ক্যাচ ধরেন শারদুল ঠাকুর। এরপর ব্যাট হাতে নেমে ব্যর্থতার ষোলোকলা পূরণ করেন সৌম্য সরকার (২ বলে ১ রান)। ৩৩ রানেই ৩ উইকেট হারিয়ে বসে বাংলাদেশ। মুশফিকুর রহীম না নেমে সৌম্যকে ব্যাটিংয়ে পাঠান। যেন কিছু করে দেখাতে পারেন। কিন্তু ব্যর্থতার বোঝা কাঁধে নিয়ে দলকে আরও বিপদে ফেলে সাজঘরের পথে হাঁটা দেন সৌম্য। চাহাল প্রথম ওভারে বল করতে এসেই ২ উইকেট তুলে নেন। স্পিন বল খেলতেই পারেননি বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা। পাওয়ার প্লে কাজে লাগানো যেখানে জরুরী, সেখানে ৩ উইকেট হারিয়ে ৪০ রান করতে পারে বাংলাদেশ। সাব্বির রহমান রুম্মন মেরে খেলছিলেন। মুশফিকুর রহীম ধরে খেলছিলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ মুশফিক এগিয়ে যেতে পারেননি। দুইজন মিলে যেই ৩৫ রানের জুটি গড়েন, ১০ ওভারে দলের ৬৮ রানও হয়; এমন মুহূর্তে চাহালের ঘূর্ণি বুঝতে না পেরে মুশফিক (১২ বলে ৯ রান) আউট হয়ে যান। তাতে দলও চাপে পড়ে যায়। টানা ব্যর্থ হতে থাকা সাব্বির এদিন দুর্দান্ত ব্যাটিং করতে থাকেন। সাব্বিরের সঙ্গে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদও এগিয়ে যেতে থাকেন। ১৪ ওভারে গিয়ে ১০০ রান স্কোরবোর্ডে যোগ করে দল। সবকিছুই সুন্দর চলছিল। হঠাৎ করেই সব ওলট-পালট হয়ে গেল। বল উইকেটরক্ষকের কাছে। অথচ সাব্বির রানের জন্য দৌড় দিয়ে স্ট্রাইক প্রান্তে এসে পড়লেন। মাহমুদুল্লাহ দৌড় দিয়েও কাজ হয়নি। নন স্ট্রাইক প্রান্তে রান আউট হয়ে যান দলকে ফাইনালে ওঠানো মাহমুদুল্লাহ (১৬ বলে ২১ রান)। সাব্বির এত দুর্দান্ত খেলে এমন ভুল করে বসলেন, দলও বিপাকে পড়ে গেল। তবে পুষিয়েও দিয়েছেন। ৩৭ বলেই ৫০ রান করে ফেলেছেন। ক্যারিয়ারের চতুর্থ ফিফটি করে ফেলেন। একের পর এক ছক্কা হাঁকাতে থাকেন। ১৩৩ রানের সময় সাকিব আল হাসান (৭ বলে ৭ রান) রান আউট হলেও সাব্বির দলের স্কোরবোর্ড মজবুত করতে থাকেন। সাব্বিরকে ফেরাতে দুটি ‘রিভিউ’ নিয়েও কাজ হয়নি। শেষপর্যন্ত দলের ১৪৭ রানের সময় ৭ চার, ৪ ছক্কায় ৫০ বলে ৭৭ রান করে উনাদকাতের বলে বোল্ড হয়ে যান সাব্বির। শেষ ওভারে মেহেদী হাসান মিরাজ (১৯*) যে ধুমধারাক্কা ব্যাটিং করেন, তাতেই দল ১৬৬ রান করে ফেলে। ১০ ওভারে যেখানে দল ৬৮ রানে ছিল, সেখান থেকে পরের ১০ ওভারে ৯৮ রান করা যায়। এ রান করেই ভারতকে চেপে ধরা গেছে। কিন্তু প্রথমবারের মতো বিদেশের মাটিতে কোন টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠে আশা জাগিয়েও হতাশাতে ডুবতে হয়েছে। ফাইনালে বাংলাদেশকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল ভারত। স্কোর ॥ বাংলাদেশ-ভারত ফাইনাল বাংলাদেশ ইনিংস ১৬৬/৮; ২০ ওভার (সাব্বির ৭৭, মাহমুদুল্লাহ ২১, মিরাজ ১৯*, তামিম ১৫, লিটন ১১, মুশফিক ৯, সাকিব ৭; চাহাল ৩/১৮, উনাদকাত ২/৩৩)। ভারত ইনিংস ১৬৮/৬; ২০ ওভার (রোহিত ৫৬, কার্তিক ২৯*, রাহুল ২৪, ধাওয়ান ১০; রুবেল ২/৩৫)। ফল ॥ ভারত ৪ উইকেটে জয়ী। টুর্নামেন্ট ॥ ভারত চ্যাম্পিয়ন। ম্যাচ সেরা ॥ দীনেশ কার্তিক (ভারত) সিরিজ সেরা ॥ ওয়াশিংটন সুন্দর (ভারত)
×