ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

গাড়ি চালকের কানে মোবাইল ফোন! বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৯ মার্চ ২০১৮

গাড়ি চালকের কানে মোবাইল ফোন! বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল

রাজন ভট্টাচার্য ॥ আইন নিষেধাজ্ঞা থাকলেও চলন্ত গাড়িতে চালকদের মোবাইল ফোনের ব্যবহার বন্ধ হয়নি। অথচ প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলা হচ্ছে চালকের মোবাইল ফোন ব্যবহার। এটি বন্ধে সরকার দশ বছর আগে আইন করেছিল। কিন্তু আইনের প্রতি চালকদের তোয়াক্কা নেই। ফলে ফোন ব্যবহারে দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান দীর্ঘ হচ্ছে। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। পরিবহন শ্রমিক ও মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, চালকদের সচেতনতার অভাবেই ফোন ব্যবহার বন্ধ হচ্ছে না। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় বলছে, নতুন সড়ক পরিবহন আইন চূড়ান্ত হলে গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনের ব্যবহার রোধ সম্ভব হবে। বিদ্যমান আইনেও ফোনের ব্যবহার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামীতে এ বিষয়ে আরও কঠোর আইন প্রণয়ন ও তা যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা না গেলে সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে না। ২০১৬ সালে ভারতের সরকারী রিপোর্টে বলা হয়, দেশটিতে সড়ক দুর্ঘটনায় দিনে ৪শ’ জনের মৃত্যু হয়। প্রতি সাড়ে তিন মিনিটে মারা যায় একজন। সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বলা হচ্ছে, চালকদের অসাবধানতা ও বেপরোয়া গাড়ির গতি। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, মোবাইল ফোনের ব্যবহার। ভারতেও চালকদের মোবাইল ফোনে কথা বলা বন্ধে আইন রয়েছে। সেখানে এ আইন ভাঙলে ২ হাজার টাকা জরিমানা বা ৬ মাসের জেল অথবা উভয় দ- দেয়ার বিধান রয়েছে। সেদিক বিবেচনায় আমাদের দেশে চালকদের মোবাইল ফোনের ব্যবহার রোধ ও আইনের শাস্তি খুবই দুর্বল। তাই সমস্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) কর্তৃপক্ষ মোবাইল কোর্ট পরিচালনা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ বিষয়ে তারা সোচ্চার ভূমিকা পালন করছেন। যাত্রী অধিকার সংরক্ষণে কাজ করা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান যাত্রী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গত বছর সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় সাত হাজার ৩৯৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহতের সংখ্যা ১৬ হাজারের বেশি। মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৪৮ ভাগ খবর গণসমাধ্যমে আসলেও ৪০ ভাগ খবর প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ দুর্ঘটনার বড় অংশই গণমাধ্যমে আসে না। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো গাড়ি চালানোর সময় চালকের মোবাইল ফোন ব্যবহার। দিন দিন এর মাত্রা বাড়ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চালকদের মোবাইলে কথা বলার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও যানবাহন চালকরা কেউ এই আইনের তোয়াক্কা করছেন না। মহানগরী থেকে হাইওয়ে এমনকি আঞ্চলিক সড়ক সবখানেই চালকরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন। সব যানবাহনের চালকই ইচ্ছামতো চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোনে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছেন। যাত্রীরা এর প্রতিবাদ করলে অনেক সময় চালকের হাতে উল্টো নাজেহাল হতে হয়। পুলিশ বলছে, ইচ্ছা থাকলেও নানা কারণে আইনটি প্রয়োগ করা যায় না। এর অন্যতম কারণ হলো জনবল সঙ্কট। পুলিশের এক কর্মকর্তা স্বীকার করে বলেন, আইনটি যেমন চালকেরা মানেন না, তেমনি সড়কে যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকেন, তারাও এ বিষয়ে অনেক সময় সচেতন নন। বিআরটিএ সচিব শওকত আলী বলেছেন, চালকদের মোবাইল ফোনে কথা বলার কারণে সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে তারাও অবগত। সমস্যা সমাধানে তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এ কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে চালকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। সবাই মিলে সচেতন না হলে এই সমস্যা কোন একক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাধান সম্ভব হবে না। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী উদাহরণ টেনে বলেন, সর্বশেষ গত ২৬ জানুয়ারি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সোনারগাঁওয়ের ত্রিবর্দী এলাকায় একটি যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে লরির সংঘর্ষে ১০ জন নিহত হন। এ দুর্ঘটনার কারণ মোবাইল ফোন। আহত যাত্রীরা জানিয়েছেন, ঘটনার সময় চালক মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন। যাত্রীরা বার বার নিষেধ করা সত্ত্বেও চালক কর্ণপাত করেননি। তিনি বলেন, এটা বন্ধে নতুন আইন জরুরী, তবে তার চেয়েও জরুরী কঠোর ভাবে আইনটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া। বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোতালেব বলেন, সচেতনতাই পারে সমস্যা সমাধান করতে। আমরা চালকদের বললেও তারা নিজের মতো করেই কাজটি করেন। তাছাড়া বিষয়টি মনিটরিং করার কোন মাধ্যমে নেই। তিনি বলেন, মোবাইলে কথা বলার সময় চালকরা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন। এ কারণে ঘন ঘন দুর্ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, এই প্রেক্ষাপটে সরকার ২০০৭ সালের ১২ জুলাই মোটরযান আইনের ১১৫ (বি) ধারার সংশোধন করে নতুন আইনের প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল। নিয়মভঙ্গকারী চালককে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা জরিমানার বিধানও রাখা হয়। কিন্তু তার বাস্তবায়ন খুব একটা নেই বলেই চালকরা অবাধে চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী খান বলেন, চলন্ত গাড়িতে মোবাইল ফোন ব্যবহার নিয়ে আইন থাকলেও সচেতনতা না আসলে কোনভাবেই এটি বন্ধ করা যাবে না। তিনি বলেন, আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে চালকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি। হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি আতিকুল ইসলাম বলেন, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৭ পাস হলে কেউ গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না। এ আইন ভাঙলে এক মাসের কারাদ- ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ চালকদের মোবাইল ফোন ব্যবহার। এজন্য সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে সচেতনতামূলক কর্মসূচী প্রণয়ন করতে হবে। আমরা চাই না সড়ক দুর্ঘটনায় আর কারও মৃত্যু হোক। যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, সড়ক-মহাসড়ক ও রাস্তাঘাটের নির্মাণ ক্রটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো, মহাসড়ক ও রেলক্রসিংয়ে ফিডার রোডের যানবাহন ওঠে পড়া ও রাস্তায় ফুটপাথ না থাকা বা ফুটপাথ থাকলেও রাস্তার মাঝপথে পথচারীদের যাতায়াতের কারণেই মূলত দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। দুর্ঘটনা রোধে সুপারিশে বলা হয়েছে, ট্রাফিক আইন, মোটরযান আইন ও সড়ক ব্যবহার বিধিবিধান সম্পর্কে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ও সাধারণের মধ্যে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। এছাড়াও জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশ থেকে হাট-বাজার অপসারণ, ফুটপাথ দখলমুক্ত করা, রোড সাইন স্থাপন করা, জেব্রা ক্রসিং দেয়া, চালকদের পেশাগত প্রশিক্ষণ ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা, যাত্রীবান্ধব সড়ক পরিবহন আইন ও বিধিবিধান প্রণয়ন, গাড়ির ফিটনেস ও চালকদের লাইসেন্স দেয়ার পদ্ধতিগত উন্নয়ন-আধুনিকায়ন, জাতীয় মহাসড়কে কমগতি ও দ্রুতগতির যানের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করার কথাও বলেছে সংগঠনটি।
×