ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বান্দরবানের ৫০ উপজাতীয় পরিবার রাখাইনে ৫ একর করে জমি ও ৫ বছর ফ্রি খাবারের প্রলোভন

রাখাইনে রোহিঙ্গা বসতিতে গড়ে তোলা হচ্ছে বৌদ্ধ পল্লী ও সামরিক ঘাঁটি

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৯ মার্চ ২০১৮

রাখাইনে রোহিঙ্গা বসতিতে গড়ে তোলা হচ্ছে বৌদ্ধ পল্লী ও সামরিক ঘাঁটি

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দ্রুততার সঙ্গে গড়ে উঠছে ‘বৌদ্ধ আদর্শ পল্লী’ ও সামরিক ঘাঁটি। কয়েকমাস আগেও যেখানে ছিল রোহিঙ্গাদের বসতি সেখানে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এসব বৌদ্ধ আদর্শ পল্লী ও সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলছে মিয়ানমার সরকার। এখন আর বুঝতে বাকি নেই মিয়ানমার সরকার সেনা সদস্যদের লেলিয়ে দিয়ে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর কেন গণহত্যা চালিয়েছে এবং দেশান্তরী হতে বাধ্য করা হয়েছে। মিয়ানমার সরকারের পক্ষে যে কথা বলা হয়েছিল, অর্থাৎ তাদের অতীতের সরকার যে কর্মসূচী শুরু করেছে বর্তমানে তা সম্পন্ন করা হচ্ছে- মূলত তারই প্রতিফলন এখন সুস্পষ্ট। কোথায় প্রত্যাবাসন, কোথায় পুনর্বাসন, কোথায় ভিটেমাটির চিহ্ন- রোহিঙ্গাদের এসবের কিছুই অবশিষ্ট রাখা হচ্ছে না। বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা এখনও অব্যাহত রয়েছে। জাতিসংঘসহ বিশ্ব চাপের মুখে মিয়ানমার যে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের কথা দিয়েছিল তা এখন কথার কথায় পরিণত হচ্ছে। উপরন্তু বান্দরবানের পাহাড়ী গহীন এলাকা থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং বৌদ্ধ থেকে খ্রীস্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়া সদস্যদের রাখাইন রাজ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সীমান্তের ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে, মিয়ানমারে সেনা অভিযানে রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করার পর সেখানে বসবাস করতে বাংলাদেশ সীমান্ত অভ্যন্তরে অর্থাৎ বান্দরবানের গহীন অরণ্যে বসবাসকারী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী উপজাতীয়দের টানছে সে দেশের দালাল চক্র। সেখানে বাড়ি, গরু-ছাগল ও পাঁচ একর করে জমি এবং পাঁচ বছর ফ্রি খাবার দেয়ার লোভের টোপ দেয়া হয়েছে। মিয়ানমারের দালাল চক্র এ পারে এই লোভ দেখিয়ে আগ্রহী করে তুলছে সীমান্তের উপজাতীয় পরিবারগুলোকে। বান্দরবানসহ পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন দুর্গম এলাকা থেকে বৌদ্ধ থেকে খ্রীস্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়া সদস্যদের অর্ধশতাধিক পরিবার ইতোমধ্যে রাখাইনে পাড়ি জমিয়েছে। সূত্র জানায়, পার্বত্য রেমাক্রি উসাথোয়াই পাড়া থেকে পাহাড়ী পথ পাড়ি দিয়ে মিয়ানমার সীমান্তে ঢুকে পড়ছে মারমা ও ম্রো সম্প্রদায়ের লোকজন। ওই উপজাতি লোকজনকে মিয়ানমারের মংডুতে নির্মিত ঘরে আশ্রয় দেয়া হচ্ছে। মিয়ানমারে মানবপাচারকারী দালাল চক্র ওইসব উপজাতি পরিবারকে রাখাইনে নিয়ে যেতে সরেজমিনে ও মুঠোফোনে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে প্রতিনিয়ত। তবে বান্দরবান জেলা প্রশাসন পাহাড়ীদের প্রলোভনে ফেলে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে চেষ্টা চালাচ্ছে। বান্দরবান সীমান্তের কিছু অরক্ষিত পয়েন্ট দুর্গম এলাকা হওয়ায় ওসব স্থানে বসতিদের ধরে রাখা যাচ্ছে না বলে জানা গেছে। তারপরও ওসব উপজাতি পরিবারকে স্থানীয় প্রশাসন নানাভাবে দেশান্তরী না হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চলতি মাসে উসাথোয়াই পাড়া থেকে নয়টি পরিবার মিয়ানমারে পাড়ি জমিয়েছে বলে উপজাতিরা দাবি করলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এ পর্যন্ত ৩১ মারমা ও ম্রো পরিবারকে বাংলাদেশ ছেড়ে মিয়ানমারের রাখাইনে চলে যাওয়ার সত্যতা মিলেছে। চলে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে একজন এলাকার পাড়া কারবারিও রয়েছে। থানচি উপজেলা সদর থেকে ৮৫ কিলোমিটার রেমাক্রি ইউনিয়নের পাশে সাংগু সংরক্ষিত বনাঞ্চলের লিক্রি এলাকা থোয়াইচিং পাড়ায় মিয়ানমারের দালালরা অবস্থান নিয়ে এ মানবপাচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বলে সূত্রে জানা গেছে। থানচি রেমাক্রি উপজেলার ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য বাওয়াই মারমা জানিয়েছেন, থোয়াইচিং পাড়া থেকে নয় পরিবার, বড়মোদক পাড়া থেকে দুই পরিবার, থাইংকোয়াই পাড়া থেকে ছয় পরিবার, উসাথোয়াই পাড়া থেকে সাত পরিবার, কংওয়োপুু হ্লাফং পাড়ার পাঁচ পরিবার ও পুশৈথোয়াই পাড়া থেকে দুই পরিবারসহ মোট ৩১ পরিবার বাংলাদেশে ছেড়ে মিয়ানমারের রাখাইনে পাড়ি জমিয়েছে। চেঙ্গী আগাপাড়া ছাড়াও সীমান্তের অরক্ষিত বিভিন্ন পয়েন্টে দিয়ে কমবেশি প্রতিদিনই মিয়ানমারে নেয়া হচ্ছে বৌদ্ধ ও বৌদ্ধ থেকে খ্রীস্টান ধর্মে দীক্ষিতদের। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে এদের সীমান্ত পাড়ি না দেয়ার জন্য খাদ্য কর্মসূচী সোলার সিস্টেমসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন রেমাক্রি ইউপি চেয়ারম্যান মুই সুই থুই। এদিকে সরকারী উদ্যোগে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা পল্লীগুলো শূন্য করতে সেখানে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের পুনর্বাসন করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। সেখানে অসংখ্য টিনের ছাউনিযুক্ত দো-চালা ঘর তৈরি করার কাজ চলছে। আর এসব পাড়ার প্রবেশ পথে টাঙ্গানো হয়েছে পতাকা। যেখানে লেখা রয়েছে ‘বৌদ্ধ আদর্শ পল্লী’। ওসব ঘরে বসতি করার লোক পাচ্ছে না মিয়ানমার সরকার। তাই সীমান্ত এলাকার এপার থেকে উপজাতীয়দের লোভনীয় প্রস্তাবে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ওসব গ্রামগুলো ইতিপূর্বে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর হলেও প্রত্যাবাসনের পর যাতে রোহিঙ্গারা ওই ভিটাগুলো তাদের দাবি করতে না পারে, এ জন্য সেখানে বৌদ্ধদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। দেশটির বিভিন্ন এলাকা থেকে রাখাইন পরিবারের লোকজনকেও ওসব বাড়িতে নিয়ে আনা হচ্ছে বলে জানা গেছে। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা তিনটি শহর এলাকায় বিশেষ করে মংডু শহরের প্রায়ই রোহিঙ্গা পল্লীতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের আদর্শ পল্লী নামে অসংখ্য দো-চালা টিনশেড ঘর নির্মাণ কাজ অতিদ্রুততার সঙ্গে করছে প্রশাসন। ওসব ঘরে বসবাস করার জন্য মিয়ানমারে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা কম হওয়ায় দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশ সীমান্তে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পরিবারকে লোভ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মিয়ানমারে। দেশটির সেনা মদদে বেসরকারী প্রকল্প পরিচালনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা পল্লীতে একাধিক ‘রাখাইন পল্লী’ গড়তে আরও ঘর বর্তমানে নির্মাণাধীন রয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। ওসব ঘরে যাদের (বৌদ্ধ) আশ্রয় দেয়া হচ্ছে- তাদের রোহিঙ্গা বিদ্বেষী করে মগজ ধোলাই করা হচ্ছে। গত আড়াই মাসে মিয়ানমার সেনাবাহিনী শতাধিক গ্রাম বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সামরিক বাহিনীর নিধনযজ্ঞ আড়াল করতেই এখনও বুলডোজার চালানো অব্যাহত রয়েছে। চলতি মাসের শুরু থেকে সেখানে ৩টি সামরিক ঘাঁটি ও রাস্তা নির্মাণ জোরেশোরে চলছে বলেও জানা গেছে।
×