ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টা ॥ ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি ফয়জুরের

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১৯ মার্চ ২০১৮

জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টা ॥ ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি ফয়জুরের

শংকর কুমার দে ॥ বিশিষ্ট লেখক ও সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যা চেষ্টাকারী একাই হামলা করেছে বলে নিজের দোষ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে হামলাকারী ফয়জুল হাসান ওরফে ফয়জুর। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে সে বলেছে, ইউটিউবে নাস্তিকদের বিরুদ্ধে হুজুরদের ওয়াজ শুনে জিহাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাফর ইকবালের ওপর সে হামলা করেছে এবং হামলার সময় ঘটনাস্থলে সে একাই ছিল। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়ার পর তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, হামলাকারী ফয়জুল রবিবার বিকেলে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয় সিলেট মহানগর হাকিম হরিদাস কুমারের আদালতে। রবিবার দুপুর দেড়টায় হরিদাস কুমারের আদালতে আনা হয় তাকে। এরপর স্বেচ্ছায় সে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেবে বলে জানায়। তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। জবানবন্দী রেকর্ড করার পর তাকে সিলেটের কারগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। দশ দিনের রিমান্ড শেষে আদালতে হাজির করা হলে সে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে সম্মত হয়। গত ৩ মার্চ বিকেলে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটি অনুষ্ঠানে জাফর ইকবালের ওপর হামলা চালায় ফয়জুল। ঘটনাস্থল থেকে আটক করা হয় ফয়জুল হাসানকে। ওইদিন রাতেই ফয়জুলকে প্রধান আসামি করে জালালাবাদ থানায় মামলা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ইশফাকুল হোসেন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ মার্চ পাঁচদিনের রিমান্ড শেষে ফয়জুলের বাবা আতিকুর রহমান আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছেন। জবানবন্দী রেকর্ড শেষে তাকে ও ফয়জুলের মামা ফজলুর রহমানকে কারাগারে পাঠানো হয়। একই মামলায় ফয়জুলের মা মিনারা বেগমকেও দুইদিনের রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়। এছাড়া জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ফয়জুলের ভাই এনামুল হাসানকে গত ১৩ মার্চ ৮ দিনের হেফাজতে নেয়ার পর এখন জিজ্ঞাসাবাদীন আছে। সিলেট মহানগর কমিশনার গোলাম কিবরিয়ার এই বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টায় তার ওপর হামলার ঘটনায় হামলাকারী ফয়জুল হাসান আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে নিজের দোষ স্বীকার করেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন তিনি। হামলার সময়ে ঘটনাস্থলে সে একাই ছিল এবং একাই হামলা করেছে এমন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়ার কথা নিশ্চিত করলেও বিস্তারিত বিবরণ সম্পর্কে আর কিছুই বলতে তিনি অস্বীকৃতি জানান। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, হামলাকারী ফয়জুলের মোবাইল ফোন, ট্যাব পরীক্ষা করে দেখেছে পুলিশ। এতে হুজুরদের ওয়াজ, জিহাদ, নাস্তিক সম্পর্কে নানা ধরনের বক্তব্য আছে। ফয়জুলের মোবাইল ও ট্যাবটি নিয়ে তার ভাই এনামুল হাসান পালিয়ে গেলে তাকে গাজীপুর থেকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাকে আট দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টায় মোবাইল ফোন, ট্যাব লুকানোর অভিযোগে তার ভাই এনামুল এবং জঙ্গী তৎপরতায় সহযোগিতা করার অভিযোগে তার বাবা-মা ও আসামি হতে পারে বলে জানা গেছে। গত ৩ মার্চ সিলেটের এই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টায় ছুরিকাঘাত করে গুরুতর আহত করে ফয়জুল হাসান নামের এক যুবক যাকে সেলফ রেডিক্যালাইডজড বলেছেন পুলিশের আইজি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। হামলাকারী ফয়জুলকে সেলফ রেডিক্যালাইজড অর্থাৎ নিজে স্বীয় উদ্যোগী বলার পর থেকে তার বাবা, মা, মামা, ভাই ও পরিবারের সদস্য ছাড়া বাইরের কেউ গ্রেফতার হয়নি এবং দীর্ঘ ১৫ দিন পর সে একাই হামলা করেছে বলে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশব্যাপী বহুল আলোচিত জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টায় হামলার ঘটনার রহস্য উন্মোচনের তদন্ত করছে পুলিশের পাশাপাশি ছায়া তদন্ত করছে র‌্যাব, সিআইডি, পিবিআই এবং ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। হামলারকারী ফয়জুল হাসান একই জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টায় তার ওপর হামলা করেছে বলে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়ার ঘটনায় তদন্ত এখানেই শেষ হয়ে গেল বা থেমে যাবে বলে মনে করেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাফর ইকবাল ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপতালে চিকিৎসা শেষে গত ১৩ মার্চ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বদ্যিালয় ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেছেন, আমি নিশ্চিত সে ছেলে (ফয়জুল) শুধু একা নয়, তার মতো আরও অনেকে আছে, এখানেই হয়ত দাঁড়িয়ে আছে, যে নাকি আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর ভাবছে পারলাম না, আরেকবার ‘এটেম্পট’ নিতে হবে। উগ্রপন্থীদের আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তোমাদের মধ্যে যদি কোন বিভ্রান্তি থাকে তাহলে আস, শুধু অস্ত্রটা বাসায় রেখে এসো, সামনা সামনি আমার সঙ্গে কথা বল প্লিজ তোমার মনে যে বিভ্রান্তি আছে তা নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বল। আমি জানতে চাই, আমি শুনতে চাই। কোরান শরীফে বলা আছে, তুমি যদি একজন মানুষকে মার, তুমি যেন সমস্ত মানবজাতিকে হত্যা কর। তাহলে একজন মানুষ যদি কোরান শরীফ পড়ে তাহলে কী করে সে একজন মানুষকে হত্যা করে? ‘আমাকে নাস্তিক বলো? আমি কোরান শরিফ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিখুঁতভাবে পড়েছি। সেখানে একটি আয়াত আছে, তুমি যদি একজনকে মারো, তুমি সারা মানবজাতিকে হত্যা করছো। কেমন করে তারা এত বড় দায়িত্ব ঘাড়ে নেয়। কে তোমাদের এসব বুঝিয়েছে। যারা বুঝিয়েছে তারা নিশ্চিন্তে আছে। আর তুমি, যে কিনা রিমান্ডে আছো, তোমার মা, ভাই, বাবা রিমান্ডে যারা এসব কথা বলো, তারা আসো আমার সঙ্গে কথা বলো। হামলাকারী ফয়জুলের উপর তার কোন ক্ষোভ নেই উল্লেখ করে তাদের পৃষ্ঠপোষক ও মদদদাতাদের খুঁজে বের করার কথা বলেন জাফর ইকবাল। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, হামলাকারী ফয়জুল হাসান একাই হামলা করেছে বলে আদালতে নিজের দোষ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়ার পর তদন্তের চ্যাপ্টার শেষ হয়ে গেলো বলা যেতে পারে। কোন জঙ্গী সংগঠন কিংবা হামলাকারীর পৃষ্ঠপোষক বা মদদদাতা খুঁজে বের করার আর কোন প্রয়োজন থাকল না। তবে জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলামের যারা স্লিপার সদস্য হওয়ার কারণে তারা কাটআউট পদ্ধতিতে হত্যাকা- ঘটানোর উদ্দেশে জঙ্গী হামলা করে। জঙ্গী সংগঠনের স্লিপার সেলের সদস্যরা কাটআউট পদ্ধতিতে যারা জঙ্গী হামলা করতে আসে তারা জান্নাত লাভের আশায় শহীদে পথ বেছে নেয় বিধায় তারা তাদের সহযোগী জঙ্গী সদস্যদের নাম বলে না, আর দিও বলে তাহলেও ছদ্মনাম যা সাংগঠনিক নাম বলে, যা তদন্তকারীরা আর সেই নামের ব্যক্তিকে খুঁজে পায় না। জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টায় হামলাকারী ফয়জুল হাসান জঙ্গী সংগঠনের স্লিপার সেলের সদস্য হয়ে কাটআউট পদ্ধতিতে হামলা করে থাকলে তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ তার সহযোগীদের খুঁজে পাবে না এবং সেই সুযোগে সে একাই হামলা করার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেবে, এটাই স্বাভাবিক ঘটনা।
×