ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মশিউর রহমান

চা শিল্পে চাই ব্র্যান্ডিং

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ১৮ মার্চ ২০১৮

চা শিল্পে চাই ব্র্যান্ডিং

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যেসব শিল্প গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে তার মধ্যে ‘চা’ অন্যতম। চা একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল ও রফতানি পণ্য। চা বিশ্বের সর্বাধিক ব্যবহৃত পানীয়। এর এক ধরনের স্নিগ্ধ, প্রশান্তিদায়ক স্বাদ রয়েছে এবং অনেকেই এটি উপভোগ করে। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের চা রয়েছে। প্রায় সবরকম চা-ই ক্যামেলিয়া সিনেনসিস থেকে তৈরি হলেও বিভিন্ন উপায়ে প্রস্তুতের কারণে এক এক ধরনের চা এক এক রকম স্বাদযুক্ত। গত ১০ বছরে চায়ের উৎপাদন বেড়েছে ২ কোটি কেজি। চাহিদা বেড়েছে ৩ কোটি ৩৮ লাখ কেজি। প্রায় ৫০০০ বছর আগে চীনে প্রথম চায়ের চাষ শুরু হলেও বাংলাদেশে চা চাষের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনিছড়ায় বাংলাদেশের প্রথম চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৬০ সালে লাল চাঁদ ও মাটিরাঙ্গা নামে আরও দুটি চা বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়। চা গাছের জন্য অধিক পরিমাণে বৃষ্টিপাত ও তাপের প্রয়োজন হয়। তাই বাংলাদেশের বৃষ্টিবহুল পাহাড়ীয়া অঞ্চল সিলেটে চা শিল্প অন্যতম প্রধান স্থান দখল করে নেয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, সিলেটে ১৮৯৩ সালে ২০৬,২৭,০০০ পাউন্ড চা উৎপাদিত হয় যা আসামের শীর্ষ চা উৎপাদনকারী জেলা শিবসাগরের সমান। ১৯০০ সাল পর্যন্ত উৎপাদনের এই উর্ধগতি অব্যাহত থাকে। বর্তমানে ৪৭,৭৮১ হেক্টর জমিতে ১৬৬টি চা বাগানের মধ্যে সিলেট বিভাগেই রয়েছে ১৪৮টি চা বাগান। উৎপন্ন চায়ের ৯০ শতাংশ সিলেট বিভাগে এবং অবশিষ্ট ১০ শতাংশ চট্টগ্রাম বিভাগে হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে প্রতি বছর ৫ মিলিয়ন কেজি চা রফতানি হয়ে থাকে। বাংলাদেশের চা পৃথিবীব্যাপী সিলেট টি নামে খ্যাত। জাতীয় অর্থনীতিতে চা শিল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশের চা উৎপাদনের পরিমাণ বছরে প্রায় সাড়ে ৬০০ মিলিয়ন কেজি এবং এখান থেকে চা রফতানি করা হয় ২৫টি দেশে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, রাশিয়া, চেক ও বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরী, জাপান, মিসর, সুদান, জর্ডান, গ্রীস, সাইপ্রাস, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশে চা রফতানি করা হয়। চা উৎপাদনের দিক থেকে এগিয়ে আছে চীন, ভারত, কেনিয়া, শ্রীলঙ্কা। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টমে। বাংলাদেশে চা পানকারীর সংখ্যা প্রতিবছর ৬ শতাংশ হারে বাড়ছে। চা পানে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১৬তম। সে তুলনায় চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধি না-পাওয়ায় ১৯৮৪ সাল থেকে ক্রমান্বয়ে রফতানির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। বাড়ছে আমদানির পরিমাণ। ২০০৮ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ বাৎসরিক ৫৯ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন করে। ২০০০ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের ৩০টি চা উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে ৯ম চা উৎপাদনকারী দেশ ছিল, কিন্তু ২০০৮ সালে বাংলাদেশ ১১তম স্থানে নেমে আসে। তবে ২০১০ সালে চা উৎপাদন কিছুটা বৃদ্ধি পায়। টানা নয় বছর ধরে ৫৮ থেকে ৬৭ মিলিয়ন কেজিতে আটকে ছিল চায়ের উৎপাদন। আশার খবর হলো বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী ২০১৬ সালে ১৬২টি বাগানে চা উৎপাদন হয়েছে সাড়ে আট কোটি কেজি। এ সময়ে চায়ের চাহিদা ছিল ৮ কোটি ১৬ লাখ কেজি। এ হিসাবে চাহিদার চেয়ে চা উৎপাদন বেশি হয়েছে ৩৪ লাখ কেজি। তা সত্ত্বেও এই সময়ে চা আমদানি হয়েছে ৭৭ লাখ কেজি। চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, ‘১৬২ বছরের চা-শিল্পের ইতিহাসে এবার উৎপাদনে রেকর্ড হয়েছে। আগামী দু-তিন বছর যদি এই উৎপাদন ধরে রাখা যায়, তাহলে আশাবাদী হওয়া যাবে এবং আমদানিরও দরকার হবে না। চাহিদা মিটিয়ে রফতানি করা যাবে। চা বোর্ড সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে চা চাষের জমির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৫৫০ হেক্টর। হেক্টরপ্রতি উৎপাদন অন্য সময়ের তুলনায় বেড়েছে। গত বছর হেক্টরপ্রতি উৎপাদন হয়েছে ১ হাজার ৫৮৭ কেজি। ২০১৩ সালে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ছিল সর্বোচ্চ, ১ হাজার ৩২০ কেজি। এভাবে উৎপাদন অব্যাহত থাকলে চা শিল্প অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে। ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিবছরই চায়ের চাহিদা বাড়ছে। চাহিদা বাড়ায় বাজারের আকারও বাড়ছে। ২০১৬ সালে চা উৎপাদনের হিসাব অনুযায়ী, এ বাজারের আকার প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ২০১০ সাল থেকে চা আমদানি শুরু হয়। চা বোর্ডের হিসাবে, ২০১৫ সালে ১ কোটি ১৪ লাখ কেজি চা আমদানি হয়, যা এক বছরে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রফতানি দ্রব্য ‘চা’ যা দীর্ঘকাল থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিসেবে বিবেচিত। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রফতানি আয় বৃদ্ধি, আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদন এবং গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাসকরণের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে চা খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশে চা শিল্পের বিকাশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রয়েছে অবিস্মরণীয় অবদান। ১৯৫৭-৫৮ সময়ে তিনি বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তার সময়ে চাষাবাদ, কারখানা উন্নয়ন এবং শ্রম কল্যাণের ক্ষেত্রে চা শিল্পে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং কার্যকর উদ্যোগের ফলে চা’এর উৎপাদন এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে এ দেশের চা শিল্পের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। বাংলাদেশের চা শিল্প উন্নয়নের জন্য প্রণীত কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা ‘ভিশন ২০২১’ এর লক্ষ্য হচ্ছে ‘অভ্যন্তরীণ চাহিদাপূরণ করে রফতানি বাজার সম্প্রসারণের জন্য অধিক পরিমাণ উন্নতমানের চা উৎপাদন। এই লক্ষ্য অর্জনে চা শ্রমিকদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড, চিকিৎসাসেবা, যাতায়াত ব্যবস্থার সুবিধা, অবকাঠামোগত সমস্যা সমাধান এবং দক্ষ শ্রমিকের ব্যবস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা থাকলে অর্থনীতির অন্যতম হাতিয়ার হবে চা শিল্প। বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডেড চা অত্যন্ত জনপ্রিয়। পণ্য বিপণনের ক্ষেত্রে ব্র্যান্ড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বব্যাপী পরিচিত একটি ব্র্যান্ড তৈরি করা সম্ভব হলে তা বিশ্ববাজারে বাংলাদেশী চায়ের পরিচিতি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ ভোগের জন্য কিছু কিছু ব্র্যান্ড তৈরি করা হয়েছে। দেশীয় একটি কোম্পানি তাদের উৎপাদিত অর্গানিক চা এর জন্য একটি ব্র্যান্ড তৈরি করেছে। তারা তাদের উৎপাদিত পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে। বাংলাদেশ চা বোডের্র ‘শ্রীমঙ্গল টি, সিলেট টি, বান্দরবান টি, পঞ্চগড় টি ’ ইত্যাদি নামে ব্র্যান্ড তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। এসব কার্যকরী পদক্ষেপ এর সফল বাস্তবায়ন সম্ভব হলে একসময় বাংলাদেশীয় চা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করবে এবং বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।
×