ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

জাতির পিতার জন্মদিনে আরও এক ধাপ এগোল দেশ

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৮ মার্চ ২০১৮

জাতির পিতার জন্মদিনে আরও এক ধাপ এগোল দেশ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনে উৎফুল্ল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ আর পিছিয়ে নেই। এটি জাতির জন্য এক বিরাট অর্জন। জাতির পিতার যে স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা, সেই পথেই আমরা আরও একধাপ এগিয়েছি। বাংলাদেশ আর পিছিয়ে থাকবে না। জাতির পিতার আদর্শকে বুকে নিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। শনিবার দুপুরে টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধি কমপ্লেক্সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৮তম জš§বার্ষিকী এবং জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে আয়োজিত শিশু সমাবেশ, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আজকে আমাদের জন্য একটা সুখের সংবাদ, জাতির পিতার জš§দিনেই এই সংবাদটি পেলাম যে, আমাদের এত দিনের প্রচেষ্টার ফলে আজকের বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ ছিল, আজ সেই বাংলাদেশ আজ জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃতি পেয়েছে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে। অর্থাৎ আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো যেমন-ভারত, শ্রীলঙ্কা এমনকী পাকিস্তানসহ বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের কাতারেই আজ বাংলাদেশের অবস্থান। সেজন্য সকলকে আমি আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবং বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ও গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা একধাপ পিছিয়ে ছিলাম। আজকেই (শুক্রবার) আমরা খবর পেয়েছি আমরা আর পিছিয়ে পড়ে নেই। এই অঞ্চলের সকল দেশের সঙ্গে সমানতালে তাল মিলিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে পারব। আমরা চলতে পারব। তিনি বলেন, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে একটি উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্য হয়ে উঠেছে, কারণ এটি এলডিসি ব্লক থেকে বের হওয়ার জন্য প্রথমবারের মতো তিনটি মানদ-ই পূরণ করেছে। প্রসঙ্গত, জাতিসংঘের প্যানেল দ্য কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি কমিটি (সিডিপি) শুক্রবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে এক সভায় বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের বিষয়ে একটি ঘোষণাপত্র প্রকাশ করে। প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ এবং মাদকের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করে ছেলেমেয়েদের এসব অপশক্তির বিষয়ে সচেতন করতে অভিভাবক, শিক্ষক এবং ধর্মীয় নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আপনারা প্রত্যেকে আমাদের শিশু থেকে যুবক শ্রেণী কোথায় যায়, কী করে, কার সঙ্গে মেশে সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেবেন। যেন কেউ সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, মাদকাশক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে না পারে। তারা যেন সুস্থ জীবন পায়। আর বাবা-মা, ভাইবোনকে নিয়ে সুখে শান্তিতে কাটাতে পারে তারই পদক্ষেপ নিতে হবে। কোন ছেলে-মেয়ে যেন বিপথে না যায় সেদিকে দৃষ্টি দেয়ার জন্য আমি সকলকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানাই।’ শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের একটি শিশুও পথশিশু থাকবে না। প্রতিটি শিশু লেখাপড়া শিখবে মানুষের মতো মানুষ হবে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার উপযুক্ত হবে। এ দেশেই প্রতিটি দরিদ্র মানুষ ঘর পাবে, খাদ্য পাবে, চিকিৎসা পাবে, সুন্দর জীবন পাবে। এ দেশেই প্রতিটি মানুষ বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে চলবে। তিনি বলেন, প্রত্যেক জেলা যেন ভিক্ষুকমুক্ত হয় সে ব্যবস্থা করেছি আমরা। গ্রামেও যেন উন্নত জীবন যাপন করা যায় সে চেষ্টা করা হচ্ছে। শিশুদের ভবিষ্যত যেন সুন্দর হয় সেজন্য আমাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করেছি। তারাই এ দেশকে গড়ে তুলবে, এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। শিশুদেরকে মনযোগ দিয়ে লেখাপড়া করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের আজকের শিশুরা আগামী দিনের যারা ভবিষ্যত কর্ণধার এ দেশের। তাদের কেউ প্রাইম মিনিস্টার হবে আমার মতো, কেউ বড় বড় চাকরি করবে, কেউ বিভিন্ন জায়গায় যাবে, উন্নত হবে, এ দেশকে গড়ে তুলবে।’ তাঁর সরকার শিশুদের মন মানসিকতা, শরীর, স্বাস্থ্য সব কিছু উন্নত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চার দিকে বিশেষভাবে নজর দিয়েছি। বিভিন্ন ধরনের খেলা, এমনকী গ্রামের হারিয়ে যাওয়া খেলাধুলাগুলোও এখন যাতে প্রতিযোগিতা হয় তারও পদক্ষেপ নিয়েছি।’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগতাড়িত তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়ায় জš§ নেয়া খোকা একদিন হয়ে উঠেছিলেন বাঙালীর আশা আকাক্সক্ষার ধারক-বাহক। তাঁর নেতৃত্বে সংগ্রামের পথ ধরেই ১৯৭১ সাল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের কবল থেকে মুক্ত হয় স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। সেই খোকা পরে পরিচিত হয়ে উঠেন ‘বাংলার বন্ধু’ বা বঙ্গবন্ধু নামে, পান জাতির জনকের উপাধি। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে এ দেশের মুক্তিকামী জনগণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর দু লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। জাতির পিতা দেশ শাসনের জন্য মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেই সময়ের মধ্যেই তিনি যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি প্রদেশকে গড়ে তুলে স্বল্প আয়ের দেশে উন্নীত করে যান। তিনি যদি আরেকটু সময় পেতেন তা হলে বাংলাদেশ আরও আগেই একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারত। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শেখ হাসিনা বলেন, আমরা দুটি বোন (তিনি এবং বঙ্গবন্ধু ছোট মেয়ে শেখ রেহানা) বিদেশে থাকায় বেঁচে গিয়েছিলাম। ছয়টি বছর বিদেশে শরণার্থী হিসেবে কাটাতে বাধ্য হই, আমাদের দেশে ফিরতে দেয়া হয়নি। একটা দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যদিয়ে স্বজন হারাবার বেদনা নিয়েই আমাদের দিন কাটে। তারপরেও তাঁর বাবার স্বপ্ন দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার লক্ষ্য নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি। পচাত্তরের পর ২১ বছর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে না পারায় দেশ পিছিয়ে পড়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারেনি। ফলে আরও ৭ বছর পিছিয়ে যায় এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠনের পরই তাঁর সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে দেশে আবারও উন্নয়নের ধারা সূচিত হয়। ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদ্যাপন হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরমধ্যে আমরা ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলব। আমি বিশ্বাস করি আমরা তা করতে পারব। এ সময় তিনি শিশুদের মনোযোগী হয়ে লেখাপড়া করার তাগিদ দেন। উল্লেখ করেন শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকারের উপবৃত্তি ও বিশেষ ভাতার কথা। এস এম সরকারী মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র আরাফাত হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেয় গোপালগঞ্জের সোনালী স্বপ্ন একাডেমির চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী প্রিয়ন্তি সাহা। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করার অনুরোধ করে প্রিয়ন্তি। অনুষ্ঠানে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকিও বক্তব্য রাখেন। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালযের সচিব নাসিমা বেগম, ঢাকা এবং গোপালগঞ্জের বিভাগীয় কমিশনার বজলুল আহমেদ এবং মোখলেসুর রহমান সরকার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রী পরিষদ সদস্যবৃন্দ, মন্ত্রী পরিষদ সচিব, তিনবাহিনী প্রধানগণ, আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দ, সরকারী পদস্থ কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকবৃন্দ ও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী পরে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি এবং গোপালগঞ্জ জেলা পরিষদের পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতি অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। এ দিকে দিবসটির স্মরণে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর ছোট ছেলে শেখ রাসেলের নামে একটি স্মারক ডাকটিকিট অবমুক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব শ্যাম সুন্দর সিকদার এবং ডাক বিভাগের মহাপরিচালক সুশান্ত কুমার ম-ল উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে তাঁর রচিত এবং বাংলাদেশ শিশু একাডেমি প্রকাশিত ‘আমাদের ছোট্ট রাসেল সোনা’ শীর্ষক প্রন্থের মোড়ক উšে§াচন করেন। এ সময় শিশু একাডেমির পরিচালক আনজির লিটন উপস্থিত ছিলেন। ‘উঠবো জেগে ছুটবো বেগে’ শীর্ষক একটি ভিডিও চিত্রও অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী ৭ মার্চ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর সমাধি কমপ্লেক্সে একটি বই মেলার উদ্বোধন করেন এবং ‘আমার ভাবনায় ৭ মার্চ’ শীর্ষক শিশুদের একটি চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা পরিদর্শন করেন। তিনি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া এবং কোটালিপাড়ার দু’জন দুঃস্থ মহিলার মাঝে সেলাই মেশিন বিতরণ করেন এবং বঙ্গবন্ধুর জš§বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত শিশু-কিশোরদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ করেন। টুঙ্গিপাড়ার অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কাজী জাফর উল্যাহ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ, ডেপুটি স্পীকার ফজলে রাব্বী মিয়া, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবীর নানক ও আবদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম, কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য এস এম কামাল হোসেন প্রমুখ অংশ নেন।
×