ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অঘোষিত সেমিফাইনালে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার হার ২ উইকেটে, ১৮ বলে ৪৩ রানের হার না মানা টর্নেডো ইনিংস খেলে ম্যাচসেরা মাহমুদুল্লাহ কাল কলম্বোয় ভারতের বিরুদ্ধে ফাইনাল

ফাইনালে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৭:৫২, ১৭ মার্চ ২০১৮

ফাইনালে বাংলাদেশ

জাহিদুল আলম জয় ॥ অবিস্মরণীয়, অবিশ্বাস্য, অনন্য, অতুলনীয়, অনবদ্য কোন উপমাই যথেষ্ট নয়। ঘটনাবহুল, আলোচিত, রুদ্ধশ্বাস ম্যাচে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কাকে ২ উইকেটে হারিয়ে নিদাহাস ট্রফির স্বপ্নের ফাইনালে পৌঁছে গেছে লাল-সবুজের দেশ বাংলাদেশ। শুক্রবার রাতে কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে অঘোষিত সেমিফাইনালে টস জিতে শ্রীলঙ্কাকে ব্যাটিংয়ে আমন্ত্রণ জানান ইনজুরি কাটিয়ে দলে ফেরা বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। বোলার নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ২০ ওভারে ৭ উইকেটে ১৫৯ রান করে লঙ্কানরা। ১৬০ রানের জয়ের লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নেমে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, মুশফিকুর রহীম ও তামিম ইকবালের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে এক বল হাতে রেখে (১৯.৫ ওভার) ৮ উইকেট হারিয়ে জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ১৬০ রান করে বাংলাদেশ। শেষদিকে অনবদ্য হার না মানা ঝড়ো ব্যাটিংয়ে ১৮ বলে ৪৩ রান করে ম্যাচসেরা হয়েছেন টাইগার সহঅধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। রবিবার একই ভেন্যুতে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে ভারতের বিরুদ্ধে খেলবে টিম বাংলাদেশ। অবিশ্বাস্য জয়ের পর প্রশংসার স্রোতে ভাসছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। পাড়া-মহল্লা, শহরে-বন্দরে জয়ের আনন্দে মতোয়ারা হয়েছেন টাইগার ভক্ত-সমর্থকরা। নাটকীয় জয়ে বাংলাদেশ দলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অনেকে। বাংলাদেশের ইনিংসের শেষ ওভার ছিল নাটকীয়তায় ভরপুর। তখন ৬ বলে টাইগারদের জয়ের জন্য দরকার ১২ রান। স্ট্রাইকে ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। লঙ্কান পেসার ইসুরু উদানা ওভারের প্রথম দু’টি বলই দেন বাউন্সার। নিয়ম অনুযায়ী বল দু’টি ‘নো’ অথবা একটি ‘ওয়াইড’ হওয়ার কথা। প্রথমটি বাউন্সারের হিসেব করলেও দ্বিতীয়টি ‘নো’ বল হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আম্পায়াররা দু’টি বলকেই বৈধ বলে রায় দেন! দ্বিতীয় বলে মাহমুদুল্লাহকে স্ট্রাইক দিতে রানআউট হন মুস্তাফিজ। কিন্তু আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত মানতে পারেনি বাংলাদেশ। মাঠেই এর প্রতিবাদ করেন মাহমুদুল্লাহ। বাংলাদেশের সাজঘরেও ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা। আউট হয়ে আসার পর আগে থেকেই বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন অধিনায়ক সাকিব। এ সময় বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার ক্রিজে থাকা দুই ব্যাটসম্যান মাহমুদুল্লাহ ও রুবেলকে মাঠ থেকে বের হয়ে আসার ইশারা করেন। অর্থাৎ ম্যাচ বয়কটের চিন্তাভাবনা করে বাংলাদেশ। পুরো স্টেডিয়ামে তখন উত্তেজনা। লঙ্কান খেলোয়াড়েরা মাঠ ছাড়তে উদ্যত টাইগার ব্যাটম্যানদ্বয়কে মাঠে থাকার অনুরোধ করেন। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ সুজন মাহমুদুল্লাহকে ব্যাট করতে যেতে ইশারা করেন। আর সাকিবকে নিয়ে যান ড্রেসিংরুমে। শেষ পর্যন্ত আম্পায়ারের অন্যায় সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে ব্যাটিংয়ে ফেরে বাংলাদেশ। এ সময় স্ট্রাইকে মাহমুদুল্লাহ থাকায় স্বপ্ন বুনতে থাকে টাইগাররা। ২০তম ওভারের তিন নম্বর বলে বাউন্ডারি হাঁকান মাহমুদুল্লাহ। পরের বলে নেন ২ রান। ফলে শেষ দুই বলে জয়ের জন্য বাংলাদেশের লক্ষ্য দাঁড়ায় ৬ রান। পাঁচ নম্বর বলে লেগ দিয়ে বিশাল ছক্কা হাঁকিয়ে বাংলাদেশকে স্বপ্নের জয় উপহার দেন মাহমুদুল্লাহ। এরপর স্বাভাবিকভাবেই জয়ের বুনো উল্লাসে মেতে ওঠেন নায়ক মাহমুদুল্লাহসহ পুরো বাংলাদেশ দল। এ সময় মাঠে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা নাগিন নাচে মত্ত হয়ে ওঠেন। স্বপ্নের জয়ে লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নেমে শুরুটা অবশ্য ভাল হয়নি বাংলাদেশের। প্রথম চার ওভারের মধ্যে সাজঘরে ফেরেন ওপেনার লিটন দাস ও ওয়ান ডাউনে নামা সাব্বির রহমান। দ্বিতীয় ওভারেই লিটন দাসের উইকেট তুলে নেন লঙ্কান বোলার আকিলা ধনঞ্জয়। রানের খাতা না খুলেই ফিরে যেতে হয় লিটনকে। নিজের পরের ওভারে সাব্বিরকেও স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন ধনঞ্জয়। ৩৩ রানে ২ উইকেট হারিয়ে তখন ধুঁকছে বাংলাদেশ। এরপর তৃতীয় উইকেটে ৬৪ উইকেটের জুটি গড়ে টাইগারদের ম্যাচে ফেরান তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহীম। কিন্তু এই আশার আলো বেশিক্ষণ থাকেনি। পর পর দুই ওভারে দুজনই ফিরে যান। এর পর সাজঘরে ফেরেন সৌম্য সরকারও। অর্থাৎ ১০৯ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে বসে বাংলাদেশ। এরপর ৩১ বলে জিততে লাগবে ৫১ রান-এমন সমীকরণ নিয়ে মাঠে নামেন সাকিব। অধিনায়ক যখন আউট হন তখন দলের প্রয়োজন ১২ বলে ২৩ রান। এর মাঝে ৯ বলে ৭ রান করেন সাকিব। এরপর দলকে জেতানোর সব দায়দায়িত্ব সিরিজের আগের তিন ম্যাচের অধিনায়কত্ব করা মাহমুদুল্লাহর কাঁধে বর্তায়। নিজের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংসটি খেলে অবিশ্বাস্য জয় উপহার দেন শান্তশিষ্ট এ ক্রিকেটার। মাথা ঠান্ডা রেখে লঙ্কানদের কাঁদিয়ে বীরেরবেশে মাঠ ছাড়েন তিনি। অথচ দুই বছর আগে টি ২০ বিশ্বকাপে ভারতের বিরুদ্ধে এমন রুদ্ধশ্বাস একটি ম্যাচেই দল ডুবিয়েছিলেন তিনি। সেবার জয়ের জন্য বাংলাদেশের দরকার ছিল তিন বলে দুই রান। কিন্তু পারেননি ‘দুই ভাইরা’ মাহমুদুল্লাহ-মুশফিক। দু’জন পর পর দুই বলে আউট হয়েছিলেন। সময়ের বিবর্তনে সেই মাহমুদুল্লাহ এখন অনেক পরিণত, বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র। যার প্রমাণ তিনি আরেকবার রাখলেন। লড়াইটা ছিল দুই দলের জন্যই বাঁচা-মরার। জিতলেই ফাইনাল এমন সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে মাঠে নামে শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ। ভাল শুরু করলেও বাংলাদেশ বোলাররা শেষটা রাঙাতে পারেননি। প্রায় দেড় মাস পর দলে ফিরেই নিয়মিত অধিনায়ক সাকিব আল হাসান টস নামক ভাগ্য পরীক্ষায় জয়লাভ করেন। আগে বোলিংয়ের সিদ্ধান্তটা নিতে দেরি করেননি বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। প্রতিপক্ষকে ব্যাটিংয়ে পাঠিয়ে বোলিং উদ্বোধনের দায়িত্বটাও নিজের কাঁধে নেন সাকিব। দলকে দারুণ সূচনা এনে দিয়ে সাকিব প্রথম ওভারে দেন মাত্র ৩ রান। অবশ্য এই চাপটা স্বাগতিকদের ওপর ধরে রাখতে পারেননি পুরো সিরিজে চমৎকার বোলিং করা রুবেল হোসেন। দ্বিতীয় ওভারে রুবেল দেন ১২ রান। পাঁচটি টি ২০ পর একাদশে ফিরে নিজের দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলেই স্বাগতিক শিবিরে প্রথম আঘাত হানেন সাকিব। দানুশকা গুনাথিলাকাকে ফেরান টাইগার কান্ডারি। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের বলে সাব্বির রহমানের হাতে ক্যাচ দেন লঙ্কান উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান। এরপর স্বাগতিক ব্যাটসম্যানরা পড়ে মুস্তাফিজুর রহমানের তোপের মুখে। টানা দুই ওভারে এক রানআউটসহ কাটার মাস্টার ফিরিয়ে দেন তিন লঙ্কানকে। প্রথমে কুশল মেন্ডিসকে মুস্তাফিজ ফেরান সৌম্য সরকারের হাতে। এরপর উপল থারাঙ্গাকে রানআউটের ফাঁদে ফেলে দাসুন সানাকাকেও বাঁ-হাতি পেসার ফেরান গোল্ডেন ডাকের স্বাদ দিয়ে। অবশ্য শেষ দিকের বোলিংয়ে হতাশ করেন মুস্তাফিজ। প্রথমে দুই ওভারে দিয়েছিলেন মাত্র চার রান। চার ওভার শেষে মুস্তাফিজের নামের পাশে যোগ হয় ৩৯ রান। অর্থাৎ নিজের শেষ দুই ওভারে ৩৫ রান দিয়েছেন কাটার মাস্টার। মেহেদী হাসান মিরাজের বলে সুইপ করতে গিয়ে জীবন ধরা পড়েন মুস্তাফিজের হাতে। শ্রীলঙ্কার স্কোরকার্ডে রান তখন ৪১, উইকেট নেই ৫টা। দল যখন ঘোর বিপদে উইকেটে আসেন ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক থিসারা পেরেরা। জুটি বাঁধলেন আরেক ‘পেরেরা’ কুশলের সঙ্গে। এই জুটিই ম্যাচে ফেরায় লঙ্কানদের। ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে ৯৭ রানের জুটি তো গড়েনই; সঙ্গে এ দুজন দলকে এনে দেন লড়াইয়ের পুঁজি। দুজনই করেন অর্ধশতক। ৪০ বলে ৬১ রান করেন কুশল। আর দলপতি থিসারা করেন ৩৭ বলে ৫৮ রান। বাংলাদেশের মুস্তাফিজুর রহমান ২ এবং সাকিব, রুবেল, মেহেদি মিরাজ ও সৌম্য ১টি করে উইকেল লাভ করেন। স্কোর ॥ শ্রীলঙ্কা : ২০ ওভারে ১৫৯/৭ (গুনাথিলাকা ৪, মেন্ডিস ১১, কুশল ৬১*, থারাঙ্গা ৫, শানাকা ০, জীবন ৩, থিসারা ৫৮, উদানা ৭*, ধনঞ্জয়া ১*; সাকিব ১/৯, রুবেল ১/৪১, মুস্তাফিজ ২/৩৯, মিরাজ ১/১৬, মাহমুদুল্লাহ ০/২৯, সৌম্য ১/২১) বাংলাদেশ : ১৯.৫ ওভারে ১৬০/৮ (তামিম ৫০, লিটন ০, সাব্বির ১৩, মুশফিক ২৮, সৌম্য ১০, মাহমুদুল্লাহ ৪৩*, সাকিব ৭, মিরাজ ০, মুস্তাফিজ ০, রুবেল ০*; ধনঞ্জয়া ২/৩৭, মেন্ডিস ১/২৪, ফার্নন্দো ০/১০, আপোন্সো ১/১৯, পেরেরা ০/২০, গুনাথিলাকা ১/২৪, উদানা ১/২৬) ফল : বাংলাদেশ ২ উইকেটে জয়ী ম্যাচ সেরা : মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ (বাংলাদেশ)। .
×