ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

একজন ঝালমুড়ি বিক্রেতার জীবন কাহিনী

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, ডিজিটাল হচ্ছে, জুলহাস কেন পিছিয়ে থাকবে-

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ১৭ মার্চ ২০১৮

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, ডিজিটাল হচ্ছে, জুলহাস কেন পিছিয়ে থাকবে-

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ পরিপাটি চুল। চোখে সানগ্লাস। কানে সাদা হেডফোন। গলায় বাঁধা টাই। টাইটা শার্টের সঙ্গে ক্লিপ দিয়ে আটকানো। হালকা এক রঙ্গের শার্টটা ইন করে পরা। পরনে কালো প্যান্ট । বাঁ হাতে সাদা চেইনের ঘড়ি। পায়ে চকচকে কালো সু। বেল্টের সঙ্গে বাঁ পাশে গুজে রাখা সাদা টিস্যু। জামার পকেটে কলম আর বের হয়ে রয়েছে মোবাইলের কিছু অংশ। তার ভঙ্গিমাও অন্যরকম; ধীর-স্থির ও খুব বিচক্ষণ ব্যক্তিদের মতো। তার দিকে চোখ পড়লেই মনে হতে পারে তিনি হয়তো প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা বা বেসরকারী কোন প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পর্যায়ের কোন কর্মকর্তা। আসলে তিনি সরকারী বা বেসরকারী কোন প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী নন। তিনি একজন ঝালমুড়ি বিক্রেতা! তার নাম জুলহাস হাওলাদার। তিনি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। স্বল্প শিক্ষিত হওয়ার কারণে চাকরি করতে না পারলেও জীবিকার তাগিদে তিনি বেছে নিয়েছেন এই ঝালমুড়ি বিক্রি। এই রোজগারেই চলছে তার সংসার। রাজধানীর শাহবাগ মোড়ের পাশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়েরর গেটের বাইরে ফুটপাথে ঝালমুড়ি বিক্রি করেন তিনি। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, ‘বিগত সাত বছর ধরে এই এলাকায় ঝালমুড়ি বিক্রি করছেন। সকাল ১০টায় আসেন আর রাত ১০টায় বাসায় যান।’ জুলহাসের বাবা মোঃ তসলিম হাওলাদার ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। কয়েক বছর আগে তিনি মারা গেছেন। বাবার মুক্তিযোদ্ধা সনদের একটি কপি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি লেমিনেটিং করে ফুটপাথে তার ভাসমান দোকানের সামনে লাগিয়ে রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও বাবার আদেশ মানতে তিনি সব সময় বঙ্গবন্ধুর ছবি সঙ্গে রাখেন। জুলহাস জানান, তার বাবা মারা যাওয়ার আগে তাকে বলেছিলেন, যার জন্য এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। তাকে কোনদিনও ভুলে যেও না। তাই সেই থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি সঙ্গে রাখেন। এই ছবিটা দোকানে রাখার জন্য মার খেতে হয়েছে। ছবি ঝুলিয়ে রেখেছেন কেন? সে জন্য কয়েকটা ছেলে তাকে মেরেছে বলেও জানান তিনি। ছয় ভাই বোনের মধ্যে জুলহাস দ্বিতীয়। জুলহাসের পৈত্রিক বাড়ি শরিয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলার ধানকাটি গ্রামে। সাত বছর আগেও তিনি নিজ এলাকায় বৃদ্ধ বাবার দেখাশুনা করতেন। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ায় তিনি ভিটা-বাড়ি ত্যাগ করে কর্মসংস্থানের জন্য রাজধানীতে আসেন। বর্তমানে তিনি রাজধানীর বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সের পিছনে একটি ভাড়া বাসায় বাস করেন। জুলহাসের বাঁ চোখে সমস্যা। একটু কম দেখেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই সন্তানের বাবা। ছেলে সুলাইমান হাওলাদার তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। মেয়ে জিতনী আক্তারের বয়স পাঁচ বছর। তার এই কষ্টের রোজগার দিয়েই তিনি তার সন্তানদেরকে সুশিক্ষিত করতে চান। তিনি জানান, ‘আমি বেশি পড়ালেখা করতে পারিনি। আর তাই চাকরিও করতে পারনি। তবে সন্তানদেরকে পড়ালেখা শেখাতে আমি গায়ের রক্ত পানি করতে রাজি আছি।’ জুলহাস পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আর এ জন্যই তার বেশভুষা অন্যান্য ঝালমুড়ি বিক্রেতাদের থেকে আলাদা বলে জানালেন তিনি। তার বিভিন্ন রঙ্গের ৯টি শার্ট আছে। একটি শার্ট দুই দিন করে পরেন। টাই আছে ৩০ থেকে ৩৫টি। তিন চার মাসের মাথায় সু (জুতা) পরিবর্তন করেন। এভাবে টাই পরে ঝালমুড়ি বিক্রির কারণ জানতে চাইলে জুলহাস জানান, ‘দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, ডিজিটাল হচ্ছে, জুলহাস কেন পিছিয়ে থাকবে। সুন্দর পোশাক, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা জুলহাসের কাছে ডিজিটালের একটা অংশ। তিনি আরও বলেন, বাসে বা ফুটপাথ দিয়ে যাওয়ার সময় মানুষ যখন আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন, তখন আমার খুব ভাললাগে। ঝালমুড়ি বিক্রির সময় আত্মীয়-স্বজন বা এলাকার মানুষের সঙ্গে দেখা হলে লজ্জা লাগে। লজ্জা লাগলে ভাবি চুরি করে তো খাচ্ছি না। রোজগার করে খাচ্ছি। সরকারকে ভ্যাট দিচ্ছি। সরকারকে সহযোগিতা করছি। কীভাবে ভ্যাট দিচ্ছেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মোবাইলে কথা বলছি ভ্যাট দিয়ে। কিছু কিনতে গিলে ভ্যাট দিচ্ছি। তাছাড়া সরকারের সব কিছু মেনে চলছি। তার মানেই সরকারকে সহযোগিতা করছি। সরকার যদি বলে, প্রয়োজনে পরিবারের সবাই এক বেলা না খেয়ে সরকাকে ভ্যাট দেব।’ দেশপ্রেমিকের সন্তান হিসেবে তারও রয়েছে অগাধ দেশপ্রেম। আজ তিনি অসহায়ভাবে জীবনযাপন করছেন। তবে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে দেশের কাছে তার চাওয়ার কিছু নেই। দেশের একজন নাগরিক হিসেবে তিনি ফুটপাথে ঝালমুড়ি বিক্রির নিশ্চয়তা চান। কারণ ফুটপাথে বসতে না পারলে পরিবার নিয়ে তাকে না খেয়ে মরতে হবে। শুধু জুলহাস নয় জুলহাসের মতো এমন অনেক মানুষ আছে যাদের জীবিকার উৎস ফুটপাথ।
×