ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

৫৩২ কোটি ৩৯ লাখ টাকার প্রকল্প নেয়া হচ্ছে এখানে বাঙালী জাতির ইতিহাস, বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার স্মৃতি এবং ঢাকার মধ্যযুগের ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা হবে

নবরূপে সাজছে পুরনো কারাগার

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ১৭ মার্চ ২০১৮

নবরূপে সাজছে পুরনো কারাগার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নতুন রূপে সাজছে রাজধানীর পুরান ঢাকায় অবস্থিত সদ্য-সাবেক ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। ইতোমধ্যেই কারাগারের কার্যক্রম কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরিত হয়েছে। ফলে, ঐতিহ্যবাহী এই স্থানটিকে দর্শনীয় ও জ্ঞান অর্জনের স্থানে পরিণত করতে ৫৩২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নবরূপে সজ্জিত করার প্রকল্পা গ্রহণ করা হচ্ছে। পুরনো কারাগার নবরূপে সজ্জিত হওয়ার মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতির সংগ্রামের নানা ইতিহাস, বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার স্মৃতি এবং ঢাকার মধ্যযুগের ঐতিহ্য সংরক্ষিত ও পরিদর্শনযোগ্য হবে। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ‘পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ইতিহাস, ঐতিহাসিক ভবন সংরক্ষণ ও পারিপার্শ্বিক উন্নয়ন’ নামের একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। শীঘ্রই প্রকল্পটি নিয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে। এর মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনার বাস্তবায়ন ঘটবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রক্রিয়াকরণ শেষে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে কারা অধিদফতর ও সেনা সদর দফতর। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, বাঙালী জাতির ইতিহাস তথা বঙ্গবন্ধু জাদুঘর, চার নেতার স্মৃতি জাদুঘর এবং ঢাকার মধ্যযুগের ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা হবে। এ ছাড়া উন্মুক্ত নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মঞ্চায়ন, গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি, পুরাতন ঢাকার ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং কারা অধিদফতরের আওতায় সরকারী জমির পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কারা অধিদফতর বাংলাদেশের একটি সুপ্রাচীন প্রতিষ্ঠান। ১৭৮৮ সালে একটি ক্রিমিনাল ওয়ার্ড নির্মাণের মাধ্যমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের তথা কারা বিভাগের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীকালে ১৮১৮ সালে রাজবন্দীদের আটক করার জন্য বেঙ্গল বিধি জারি করা হয়। ১৮৩৬ সালে জেলা ও তৎকালীন মহকুমা সদর ঢাকা, যশোর, রাজশাহী ও কুমিল্লায় কারাগার নির্মাণ করা হয়। এরপর ১৯২৯ সালে ঢাকা ও রাজশাহী কারাগারকে কেন্দ্রীয় কারাগার হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশ জেল বা বিডিজি-এর যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে কারা সদর দফতর, ৭টি বিভাগীয় কারা দফতর এবং ৬৮টি কারাগার নিয়ে বাংলাদেশের কারা অধিদফতর গঠিত হয়। পুরাতন কারাগারটি জরাজীর্ণ এবং বসবাসের অযোগ্য হওয়ায় কেরানীগঞ্জে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের পশ্চিম পাশে ১৯৪ দশমিক ৪১ একর জমির উপর নতুনভাবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, কেরানীগঞ্জ নির্মাণ করা হয়। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সব কয়েদিকে নতুন কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়। ফলে পুরাতন কারাগারের স্থানটি অব্যবহৃত অবস্থায় রয়েছে। পুরাতন করাগারের প্রায় ৩৬ দশমিক ২১ একর জমির পরিকল্পিত ব্যবহারের জন্য এর আগে দিকনির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেবা সুরক্ষা বিভাগ এবং কারা অধিদফতর যৌথভাবে একটি উন্মুক্ত ডিজাইন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এতে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স-এর তত্ত্বাবধানে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় দেশের মোট ৯৮টি প্রতিষ্ঠান রেজিস্ট্রিভুক্ত হয়। সর্বশেষ ৩৪টি প্রতিষ্ঠান ডিজাইন ও মডেল জমা দেয়। পরবর্তীকালে ৭ সদস্য বিশিষ্ট জুরি বোর্ড চারদিন ব্যাপী কার্য পরিচালনার মাধ্যমে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য দলের ডিজাইন চূড়ান্ত করেছে। সে অনুযায়ী প্রণীত খসড়া প্রাক্কলনের মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় মূল কার্যক্রম হচ্ছে, মাটি পরীক্ষা, বাণিজ্যিক ভবন কাম মাল্টিপারপাস হল ও চকমার্কেট ভবন নির্মাণ (এর মধ্যে ফাউন্ডেশন, সুপার স্ট্রাকচার, অভ্যন্তরীণ বিদ্যুতায়ন, অভ্যন্তরীণ ও বাইরের পানি সরবরাহ এবং পয়ঃ নিষ্কাশন), জাদুঘর সামগ্রী সংগ্রহ ও ইনটেরিয়র ডিজাইনসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। একসময় যে কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশ ঘেঁষে চলতেও মেপে মেপে পা ফেলতে হতো, পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের সেই পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারকে নগরবাসীর ঘোরাঘুরি ও বিনোদনের অন্যতম আকর্ষণকেন্দ্র বানাতে উদ্যোগী হয়েছে সরকার। যেখানে থাকবে ডিজিটাল মঞ্চ, সুইমিংপুল থেকে সিনেপ্লেক্স পর্যন্ত। এমনকি থাকবে এ্যাকুসটিক সাউন্ড সিস্টেম ও ফুড কোর্টও। এই বিশাল পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কারাগারের প্রায় ৩৬ দশমিক ২১ একর জমিকে নিয়ে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন এ প্রকল্পের আওতায় পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে বাঙালী জাতির ইতিহাস, বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার স্মৃতি এবং ঢাকার মধ্যযুগের ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা হবে। পাশাপাশি এতে থাকবে বিনোদন, কেনাকাটা ও খাওয়া-দাওয়ার জন্য নানা আয়োজন। দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে থাকবে গ্যালারি, চিত্রকর্ম, আর্কাইভ ফিল্মস, রিফ্লেকশন পুল, মন্যুমেন্ট সংগ্রহ ও প্রাচীন ধাতব মুদ্রার প্রদর্শন। নজরকাড়া ইনটেরিয়র নকশার পাশাপাশি নির্মিত হবে বাণিজ্যিক ভবন কাম মাল্টিপারপাস হল, ডিজিটাল মঞ্চ, চকমার্কেট, সুইমিংপুল, বিশাল সিনেপ্লেক্স ও এ্যাকুসটিক সাউন্ড সিস্টেম। যেমন থাকবে ফুড কোর্ট, তেমনি থাকবে আন্ডার গ্রাউন্ড পার্কিং ব্যবস্থা, প্রধান জেলগেটে বিশাল ক্যানোপি, অভ্যন্তরীণ ওয়াকওয়ে ও বাইসাইকেল লেন। পুরো ফাউন্ডেশন ঘিরে থাকবে অভ্যন্তরীণ বিদ্যুতায়ন, নিরাপদ পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, প্রকল্পের আওতায় পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগার নবরূপে সাজানো হবে। ঢাকাবাসীর বিনোদনের জন্য প্রকল্পটি হাতে নেয়া হচ্ছে। পুরনো জেল গেটের পুরো সীমানা প্রাচীর পুনঃনির্মাণ ও মেরামত করা হবে। এটি বাস্তবায়ন হলে পুরাতন ঢাকার ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ, নাটক মঞ্চায়ন ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কারা অধিদফতরসহ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আশা করছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে নাজিমউদ্দিন রোডের মতো ঘিঞ্জি এলাকায় সবুজঘেরা একটি দৃষ্টিনন্দন জায়গা হবে। যেটা ইট-কাঠের নগরীতে হয়ে উঠবে পরিবার-পরিজন নিয়ে বেড়ানোর জন্য একটি মনোরম সুন্দর আদর্শ জায়গা।
×