ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কাল আরও ৩ জনকে কাঠমান্ডু থেকে পাঠানোর কথা

দেশে ফিরেছেন মৃত্যুঞ্জয়ী শেহরিন, ঢামেক বার্ন ইউনিটে ভর্তি

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ১৬ মার্চ ২০১৮

দেশে ফিরেছেন মৃত্যুঞ্জয়ী শেহরিন, ঢামেক বার্ন ইউনিটে ভর্তি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নেপালের কাঠমান্ডুতে বিমান দুর্ঘটনায় আহত মৃত্যুঞ্জয়ী শেহরিন আহমেদ দেশে ফিরেছেন। বৃহস্পতিবার নেপালের স্থানীয় সময় দেড়টায় ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়ে বাংলাদেশ সময় বেলা ৩টা ৫০ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পৌঁছায় তাকে বহনকারী ইউএস-বাংলা বিমানের বিজি-০০৭২ ফ্লাইটটি। দেশে পৌঁছানোর পর হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের বিশেষ একটি এ্যাম্বুলেন্স বিকেল ৫টায় তাকে নিয়ে ঢামেক হাসপাতালে এসে পৌঁছায়। এ সময় বার্ন ইউনিটের প্রধান ডাঃ সামন্ত লাল সেন শেহরিন আহমেদকে গ্রহণ করেন। এরপর তাকে ঢামেকের বার্ন ইউনিটের আইসিইউর ৫ নম্বর বেডে চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে নেয়া হয়। এর আগে, শেহরিনকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার উদ্দেশে ঢামেক থেকে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও দুজন নার্স বিমানবন্দরে এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে পৌঁছান। তারা হলেনÑ বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন ডাঃ পার্থ শংকর পাল এবং আইসিইউর নার্স ফারজানা আক্তার ও মরিয়ম আক্তার। কাঠমান্ডু মেডিক্যাল কলেজ (কেএমসি) হাতপাতাল কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেয়ায় শেহরিনকে দেশে ফিরিয়ে আনা হলো। শেহরিন আহমেদকে ঢামেকের বার্ন ইউনিটে ভর্তির পরেই সংবাদ সম্মেলনে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সমন্বয়কারী ডাঃ সামন্ত লাল সেন গণমাধ্যমের উদ্দেশে বলেন, ‘তার দুই পায়ে ৭ শতাংশ পুড়ে গেছে। এছাড়া তার পা ভেঙে গেছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন বলে আশা রাখছি। তবে তার মানসিক সুস্থতার জন্য কাউন্সিলিংয়ের প্রয়োজন। কারণ এই দুর্ঘটনার পর তিনি ট্রমার মধ্যে রয়েছেন। শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও মানসিকভাবে তার সুস্থ হতে কিছুটা সময় লাগবে। ’ ডাঃ সামন্ত লাল সেন আরও বলেন, শেহরিন কাঠমান্ডু মেডিক্যাল কলেজের (কেএমসি) প্ল্যাস্টিক সার্জারি এ্যান্ড বার্ন ইউনিট-৩ এ চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি শঙ্কামুক্ত। এজন্যই তাকে নেপাল থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। ঢামেক বার্ন ইউনিটে তার চিকিৎসার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। প্রয়োজন হলে শেহরিনের চিকিৎসায় মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হবে। আমরা তার চার থেকে পাঁচটি পরীক্ষা করতে দিয়েছি। আশা করি দুই একদিনের মধ্যে রিপোর্ট যাওয়া যাবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে তাকে কি ধরনের চিকিৎসা দেয়া হবে। তখন পরবর্তী করণীয় বিষয়ে ঠিক করা হবে। তবে আমি তাকে দেখে এসেছি। এটুকু বলব, তিনি ভাল আছেন।’ এ সময় তার সামন্ত লালের সঙ্গে ছিলেন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিন, বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডাঃ সাজ্জাদ খোন্দকার, প্রধানমন্ত্রী সহকারী সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ ও শেহরিনের ভাই লে. কর্নেল সরফরাজ আহমেদ। তিনি দেশের মানুষের কাছে বোনের জন্য দোয়া চান। এক বন্ধুর সঙ্গে ওই উড়োজাহাজে ছিলেন ঢাকার একটি স্কুলের শিক্ষক শেহরিন আহমেদ। তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও মারা গেছেন তার সেই বন্ধু। দুর্ঘটনার পর নেপালে চিকিৎসারত অবস্থায় বিবিসি নেপালী সার্ভিসকে দেয়া সাক্ষাতকারে তার সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন ২৯ বছরের শেহরিন। তিনি বলেন, ‘আমি আমার বন্ধুর সঙ্গে বিমানে ছিলাম। বিমানটি অবতরণ করার সময় যখন বাম দিকে মোড় নিতে শুরু করে তখন সবাই ভয়ে চিৎকার করছিল আর আল্লাহকে ডাকাডাকি করছিল। আমরা পেছনে তাকিয়ে দেখলাম বিমানে আগুন ধরে গেছে। আমার বন্ধু অমাকে বলল তার আগে দৌড়াতে। কিন্তু যখন আমরা দৌড়াতে লাগলাম আগুনের শিখা তাকে ঘিরে ফেলল। ও পড়ে গেল। লোকজন আগুনে ঝলসে যাচ্ছিল, চিৎকার করছিল আর পড়ে যাচ্ছিল। তিনজন জ্বলন্ত বিমান থেকে লাফিয়ে পড়ল। খুব ভয়াবহ ছিল এ দৃশ্য। ভাগ্যক্রমে কেউ একজন আমাকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে আসে। শেহরিন বলেন, বাইরে প্রচণ্ড রকমের আগুন ছিল এবং আমাদের কেবিন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। এরপর সেখানে একটি বিস্ফোরণ হয়। পরে আগুন নিভিয়ে উদ্ধার করা হয় আমাদের। তিনি আরও বলেন, ‘দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকা থেকে আমরা উড্ডয়ন করি। দুপুর আড়াইটার দিকে কাঠমান্ডু পৌঁছে পাইলট প্রথমে অবতরণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু পারেনি। পরে ঘুরে ঘুরে আবার যখন দ্বিতীয়বার অবতরণের চেষ্টা করে, তখন উড়োজাহাজটি বাঁ কাত হয়ে যায়। তখনই আমি বলি, বাঁ-দিকটা উঁচু হলো কেন, আর তখনি (উড়োজাহাজ) বিধ্বস্ত হলো!’ উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হওয়ার আগে কোন আভাস দেয়া হয়েছিল কি-না বা তারা কিছু টের পেয়েছিলেন কি-না? এ প্রশ্নের জবাবে শেহরিন বলেন, ‘একেবারে স্বাভাবিকভাবেই উড়োজাহাজটি নামছিল। একদম হঠাৎ করে সবকিছু হয়ে গেল।’ তিনি আরও বলেন, ‘আগুন লাগার আনুমানিক প্রায় ২০ মিনিট পর সাহায্য আসে। সে পর্যন্ত আমি ও আরেকজন ভেতরেই বসে ছিলাম। প্রচণ্ড ভয় লাগছিল আর হেল্প হেল্প বলে চিৎকার করছিলাম। কারণ আমি জানতাম, আগুন লাগার পর অনেকে দমবন্ধ হয়েই মারা যায়।’ শেহরিন জানান, আগুন নেভানোর পর উড়োজাহাজটির একটি অংশ খসে পড়ে। আর বাইরে থেকে পরিষ্কার বাতাস ভেতরে আসতে শুরু করে। বাইরে আসার সময় দেখতে পান, একজন উড়োজাহাজের মেঝেতে পড়ে আছে, তার হাত ঝুলছিল। তবে তিনি বেঁচে আছেন কি-না, সেটি বুঝতে পারেননি শেহরিন। ওই দুর্ঘটনার পরও পুরোপুরি সচেতন ছিলেন শেহরিন আহমেদ। উদ্ধারকর্মীরা তাকে ধরে বাইরে নিয়ে আসে। এ সম্পর্কে শেহরিন বলেন, ‘তখন আমি বলি, আমি হাঁটতে পারব। এমনকি এ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত হেঁটেও আসি। কিন্তু তখন পায়ে ব্যথা শুরু হয়। আসতে আসতে শুধু আগুন দেখতে পাই।’ শেহরিন আহমেদ ছাড়া আরও তিন বাংলাদেশীকে কেএমসি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেয়ার অনুমতি দিয়েছে। তারা হলেনÑ মেহেদী হাসান, কামরুন্নাহার স্বর্ণা ও আলমুন নাহার এ্যানি। এ বিষয়ে নেপালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামস গণমাধ্যমকে জানান, আহত শেহরিন আহমেদকে বৃহস্পতিবার দেশে নেয়া হচ্ছে। এছাড়া বাকি তিনজনের কাগজপত্র ঠিক করা হচ্ছে। সবকিছু ঠিক থাকলে তাদের শুক্রবার দেশে পাঠানো হবে। উল্লেখ্য, গত সোমবার (১২ মার্চ) ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিএস-২১১ নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুর্ঘটনায় পড়ে। ৬৭ যাত্রী ও চার ক্রুসহ দুপুর ২টা ২০ মিনিটে বিমানটি বিমানবন্দরের পাশের একটি ফুটবল মাঠে বিধ্বস্ত হয়। এতে ৫১ যাত্রীর প্রাণহানি ঘটে। বাকিদের উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতলে ভর্তি করা হয়। বিমানটিতে মোট ৬৭ যাত্রীর মধ্যে বাংলাদেশী ৩২, নেপালী ৩৩, একজন মালদ্বীপের ও একজন চীনের নাগরিক ছিলেন। তাদের মধ্যে পুরুষ যাত্রীর সংখ্যা ছিল ৩৭, মহিলা ২৮ ও দু’জন শিশু ছিল।
×