ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ইকবাল হত্যাচেষ্টা ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধকরণে বাধা কোথায়

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১৬ মার্চ ২০১৮

জাফর ইকবাল হত্যাচেষ্টা    ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধকরণে বাধা কোথায়

মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ লেখক, ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণে আমাদের আন্দোলন ও সংগ্রামের সাহসী সহযোদ্ধা অধ্যাপক জাফর ইকবালকে হত্যার উদ্দেশ্যে নৃশংসভাবে ছুরিকাঘাত করেছে মৌলবাদী ঘাতকরা। গত ছয় বছর ধরে মুক্তচিন্তার লেখক, শিক্ষাবিদ, অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট, প্রকাশক, বিদেশী নাগরিক, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, পুরোহিত, পাদ্রী ও ভিক্ষুÑ এমন কি মসজিদের ইমাম ও পীরদের যারা যে উদ্দেশ্যে হত্যা করেছে তারা একইভাবে, একই উদ্দেশ্যে গত ৩ মার্চ (২০১৮) সহযোদ্ধা জাফর ইকবালকে হত্যা করতে চেয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জাফর ইকবালের উপর হামলাকারী মাদ্রাসার ছাত্র ফয়জুলকে গ্রেফতার করেছে এবং জিজ্ঞাসাবাদের পর তার পিতা, মাতা ও ভাইসহ পরিবারের কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতার করা হলেও সহযোগী অন্য কোন জঙ্গীকে গত ১২ দিনেও গ্রেফতার করা যায়নি। ঘাতক ফয়জুল জাফর ইকবালের কোন লেখা পড়েনি, শুনেছে তিনি ‘নাস্তিক’ এবং তার একটি শিশুতোষ বইয়ের নাম (‘ভূতের বাচ্চা সোলায়মান’) তার কাছে আপত্তিকর মনে হয়েছে, তাই তাকে বেশ কিছুদিন ধরে হত্যার সুযোগ খুঁজছিল এবং প্রথম সুযোগেই হামলা করেছে। আঘাতের ধরনও সমচরিত্রের অন্যান্য আঘাতের মতো, পেছন থেকে ঘাড়ের ওপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে ফয়জুলের ছুরি যথেষ্ট ধারালো ছিল না বলে জাফর ইকবাল এ যাত্রায় প্রাণে বেঁচেছেন, তবে মুক্তিচিন্তার বুদ্ধিজীবীরা এভাবে আর কতদিন বাঁচতে পারবেন এ নিয়ে আমাদের আশঙ্কা রয়েছে। ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথাবিরোধী লেখক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের উপরও একইভাবে হামলা করেছিল মৌলবাদী ঘাতকরা। হুমায়ুন আজাদের উপর আঘাত আরও মারাত্মক ছিল, চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে যেতে হয়েছিল কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি বাঁচতে পারেননি। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে মুক্তচিন্তার লেখক ড. অভিজিৎ রায়ের উপরও একই ধরনের হামলা করেছে মৌলবাদী ঘাতকরা, যে হামলায় তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। কারা কী উদ্দেশ্যে ভিন্নমত, ভিন্নধর্ম এবং ভিন্ন জীবনধারায় বিশ্বাসীদের ওপর এসব হামলা করছে এ নিয়ে গত চল্লিশ বছর ধরে লিখে যাচ্ছি, এখন পর্যন্ত হত্যার প্রেরণাদাতাদের বিরুদ্ধে কেন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। আমরা সব সময় বলছি- ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে তালিকা প্রস্তুত করে বরেণ্য বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের ‘ইসলামের দুশমন’ এবং ‘ভারতের এজেন্ট’ আখ্যা দিয়ে হত্যা করেছিল মওদুদীবাদে উদ্বুদ্ধ জামায়াতে ইসলামীর ঘাতক আলবদর বাহিনী। শুধু বুদ্ধিজীবী হত্যা নয়, ’৭১-এর গণহত্যা ও নারী নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী যাবতীয় অপরাধকে ইসলামের নামে বৈধতা দিয়েছিল আবুল আলা মওদুদী ও গোলাম আযমদের জামায়াতে ইসলামী। এ কারণে স্বাধীন বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সহযোগীরা, যাদের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু এবং তার প্রধান সহযোগীদের নৃশংস হত্যাকাে র পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা পাকিস্তানপন্থী জেনারেল জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা মুছে ফেলার পাশাপাশি ধর্মের নামে রাজনীতির উপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা বাতিল করে দিয়েছিলেন। ’৭৫-এর পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির যে মৌলবাদীকরণ, সাম্প্রদায়িকীকরণ ও পাকিস্তানীকরণ শুরু হয়েছে তারই অনুষঙ্গ হিসেবে ইসলামের দোহাই দিয়ে ভিন্নমত ও ভিন্ন ধর্মের মানুষদের হত্যা, নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জামায়াত-শিবির চক্রের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের যে আন্দোলন আমরা শুরু করেছি, এর সূচনাকাল থেকে জাফর ইকবাল আমাদের সঙ্গে আছেন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নামে ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার পক্ষে তার লেখার কারণে মৌলবাদীদের চক্ষুশূল তিনি। ২০১৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগে তারুণ্যের মহাজাগরণে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসী উৎপাদনের কারখানা চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসা ও হেফাজতে ইসলামের প্রধান আহমদ শফী সরকার ও দেশবাসীর উদ্দেশে এক বিশাল খোলা চিঠি লিখে জাফর ইকবাল, নির্মূল কমিটির সভাপতি বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী, নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির, সহ-সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা অধ্যাপক অজয় রায়সহ কয়েকজন তরুণ ব্লগারকে ‘নাস্তিক’, ‘মুরতাদ’, ও ‘কাফের’ হিসেবে আখ্যায়িত করে ফতোয়া দিয়েছিলেন। তার এই খোলা চিঠি জামায়াত ও তাদের সহযোগী অপরাপর মৌলবাদীদের সংবাদপত্রে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৭১ সালে জাফর ইকবালের পিতা পুলিশের কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান আহমেদকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী হত্যা করেছিল জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সহযোগিতায়। এসব হত্যা ও হত্যার প্ররোচনার কোন বিচার হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ’৭১-এর কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীর বিচার করলেও গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের জন্য প্রধানত দায়ী জামায়াতে ইসলামী, তাদের বিভিন্ন ঘাতক বাহিনী এবং তাদের প্রভু পাকিস্তানী সামরিকজান্তার বিচারের কোন উদ্যোগ এখন পর্যন্ত গ্রহণ করেনি। যার ফলে মাঠপর্যায়ে কিছু খুচরো জঙ্গী ঘাতককে গ্রেফতার বা হত্যা করা হলেও জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাস উৎপাদনের কারখানাগুলো পুরোদমে চালু রয়েছে। জঙ্গীবাদের আদর্শিক প্রণোদনা ‘মওদুদীবাদ’, ‘ওহাবিবাদ’ ও ‘সালাফিবাদ’-এ প্রচার ও প্রসার ঘটছে নির্বিঘেœ, কখনও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায়। বাংলাদেশে জামায়াত-হেফাজত থাকবে, একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ নিরাপদ থাকবে, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ নিরাপদ থাকবেÑ এমনটি যারা বিশ্বাস করেন তারা আহাম্মকের স্বর্গে বাস করছেন। ২০০৪ সালে প্রতিবাদী লেখক হুমায়ুন আজাদের উপর নৃশংস হামলার একদিন পর দৈনিক জনকণ্ঠে ‘আর কত রক্ত দেখতে চায় জোট সরকার’ শিরোনামে লিখেছিলামÑ ‘জানুয়ারিতে মৌলবাদী ঘাতকদের বোমা-হামলায় নিহত খুলনার সাংবাদিক মাণিক সাহার রক্তের দাগ মুছে না যেতেই ওরা আবার রক্ত ঝরিয়েছে ঢাকার রাজপথে। ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির বইমেলা থেকে বেরুতেই মৌলবাদী ঘাতকরা হামলা চালিয়েছে সব্যসাচী লেখক, ভাষাবিজ্ঞানী ও গবেষক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের উপর। তার অপরাধ তিনি মৌলবাদের বিরুদ্ধে লেখেন। সম্প্রতি প্রকাশিত তার ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাস ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’-এর দর্পণে একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধীদের দল মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সহযোগীরা নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখতে পেয়েছে। ‘জামায়াতের একজন প্রধান নেতা জোট সরকারের প্রভাবশালী সাংসদ দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী গত ২৫ জানুয়ারি (২০০৪) জাতীয় সংসদে ‘ব্লাসফেমি আইন’ প্রণয়নের দাবি জানিয়ে ভাষণ দেয়ার সময় যেভাবে হুমায়ুন আজাদকে ‘কোরান ও ইসলামের দুশমন’ বানিয়ে বিষোদ্গার করেছেন তা থেকে এটা বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়, কারা এই নৃশংস কাপুরুষোচিত হামলার জন্য দায়ী। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী বলেছেন- ‘২০ নভেম্বর, ২০০৩ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাকের ঈদ সংখ্যার ৩৩ পৃষ্ঠায় হুমায়ুন আজাদ ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ শিরোনামে যে উপন্যাসটি লিখেছেন একজন সুস্থ মানুষের পক্ষে এ ধরনের লেখা চিন্তাও করা যায় না। এই লেখার মাধ্যমে হুমায়ুন আজাদ ইসলাম, কোরান, সুন্নাহ এবং এর অনুসারীদের জঘন্যভাবে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে উপস্থাপন করে ইসলাম এবং গোটা মুসলিম উম্মাহকে আঘাত করেছেÑ যা অমার্জনীয় অপরাধ। দেশে ‘ব্লাসফেমি আইন’ থাকলে ধর্ম ও নৈতিকতার দুশমনরা কোন ধর্মের বিরুদ্ধে এ ধরনের বলার বা লেখার সাহস পেত না।’ (দৈনিক সংবাদ, ২৬ জানুয়ারি, ২০০৪)। চলবে... ১৫ মার্চ, ২০১৮
×