ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ সরল জীবনযাপনের গুরুত্ব

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১৬ মার্চ ২০১৮

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ সরল জীবনযাপনের গুরুত্ব

(গত সপ্তাহের পর) আমরা যদি প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের জীবনযাপনের ইতিহাস অধ্যয়ন করি তাহলে দেখতে পাব তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল জীবনযাপন করতেন, তাঁর জীবনযাপনে আড়ম্বরের লেশমাত্র ছিল না। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাস’উদ রাদিআল্লাহু তায়ালা আন্হু বলেন : আমি একদিন হযরত রসুল্লুল্লাহ (সা)-এর দরবারে হাজির হয়ে দেখতে পেলাম যে, তিনি একটি খেজুরের মাদুরের ওপর শুয়ে আছেন। মাদুরের দাগ তাঁর পবিত্র দেহে পড়েছে। আমি বললাম : ইয়া রসুলুল্লাহ! আপনি যদি ইজাজত দেন তাহলে এর ওপর আমি কিছু বিছিয়ে দেই। এ কথা শুনে প্রিয়নবী (সা) বললেন : পার্থিব বিষয় দিয়ে আমি কি করব? একজন মুসাফির দীর্ঘ পথ চলতে চলতে ক্ষণিকের জন্য গাছের ছায়ায় বসে, পরক্ষণেই সে তা পরিত্যাগ করে চলে যায়। পৃথিবীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক তো সেই রকমই। (তিরমিযী শরীফ)। হযরত উমর ইবনুুল খাত্তাব রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন : আমি একদিন প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাত করতে গিয়ে বিস্ময়ের সঙ্গে অবলোকন করলাম যে, তাঁর দেহ মুবারকে একখানি অতি সাধারণ চাদর রয়েছে, ঘরে একখানা বিছানাবিহীন খাটিয়া রয়েছে যার ওপর খেজুরের আঁশ ভরে তৈরি করা একটি বালিশ রয়েছে, ঘরের এক কোণে সামান্য কিছু যব রাখা একটা পাত্র রয়েছে, তাঁর পবিত্র পদযুগলের দিকে রয়েছে একটা পশুর চামড়া এবং পবিত্র মাথার উপরের দিকে লটকানো রয়েছে একটি পানির মশক। এই অবস্থা দেখে আমার দু’চোখে আঁসু এসে গেল। আমাকে কাঁদতে দেখে হযরত রসুলুল্লাহ (সা) আমার এই ক্রন্দরের কারণ কী তা জানতে চাইলে আমি বললাম : ইয়া রসুলুল্লাহ! আমি কেন কাঁদব না! যে দড়ি দিয়ে আপনার খাটিয়াখানা বানানো হয়েছে তা আপনার পবিত্র শরীরে গভীর দাগ করে দিয়েছে, আপনার এই ছোট্ট কুঠুরিখানি কতটুকুইবা বসবাসের যোগ্য। পারস্য সম্রাট কিসরা এবং রোম সম্রাট কায়সার এক আল্লাহর ইবাদত না করা সত্ত্বেও যখন পার্থিব বিলাস-বসনে ভাসছে তখন আপনি আল্লাহর রসূল হওয়া সত্ত্বেও এই ধরনের সাধারণ জীবনযাপন করছেন তা কি সহ্য করা সম্ভব? হযরত রসুলুল্লাহ (সা) এ কথা শুনে বললেন : হে ইবনে খাত্তাব! এটা কি তুমি পছন্দ কর না যে, ওরা পার্থিব জীবনে ভোগ করবে আর আমি আখিরাতে? (বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ)। আমরা জানি, প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী। আল্লাহ তাঁর নূর মুবারক সৃষ্টি করার মাধ্যমে বিশ্বজগত সৃষ্টির সূচনা করনে। তিনি মদিনা মনওয়ারায় হিজরত করে গিয়ে মদিনার মসজিদে নববীকে কেন্দ্র করে যে আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্র কায়েম করেছিলেন, কয়েক বছরের মধ্যে যে রাষ্ট্রের বিস্তৃতি ঘটেছিল ইয়ামন থেকে সিরিয়া পর্যন্ত সেই বিশাল কল্যাণ রাষ্ট্রের তিনি রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান ছিলেন। অথচ মসজিদুন নববীর পূর্বদিকে মসজিদসংলগ্ন খেজুর পাতার ছাউনি দেয়া পর্নো কুটিরে তিনি থাকতেন। তাঁর পরিবার-পরিজন তাতেই সুখী ছিলেন। তিনি আড়ম্বরহীন যে সরল জীবনযাপন করতেন তা অনুসরণ করতেন সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম, পরবর্তীকালে তাবে’ঈন, তাবে তাবে’ঈন, সুফীগণ। প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের সাধারণ ও আড়ম্বরহীন জীবনযাপনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তাঁর সম্মানিত স্ত্রী উম্মুল মু’মিনীন হযরত ‘আয়িশা সিদ্দীকা রাদিআল্লাহু তায়ালা আন্হা বলেন : প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের পার্থিব জীবন থেকে চলে যাবার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পরিবারের সদস্যদের জন্য একত্রে দুই দিনও চলার মতো রুটি তৈরি করাবার যব থাকত না।’ হযরত ‘আয়িশা সিদ্দীকা (রা) আরও বলেন : তিনি অতি সাধারণ মানুষের মতোই বাড়ির সব কাজকর্ম করতেন। জামা-কাপড় সেলাই করা, জুতা মেরামত করা, ছাগলের দুধ দোয়ানো, ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা প্রভৃতি কাজ তিনি নিজ হাতে করতেন। মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা নফ্সে আম্মারা দমন করার জন্য যে সমস্ত পন্থা রয়েছে তার মধ্যে অনাড়ম্বর জীবনযাপন করা অন্যতম। নফ্সের সঙ্গে যুদ্ধ করাকে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাস জিহাদে আকবর বা বড় যুদ্ধ বলেছেন, ছোট যুদ্ধ হচ্ছে অস্ত্র যুদ্ধ। ধন-সম্পদের আতিশয্য মানুষকে কোন কোন ক্ষেত্রে পথভ্রষ্টতার, অমানবিকতার এবং বিভ্রান্তির পঙ্কিলে হাবুডুবু খাওয়ায়। ধন-সম্পদের প্রাচুর্য অনেক সময় ব্যক্তির আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা লোপ করে দেয়, তার হিতাহিত জ্ঞান বিস্মৃত হয়ে যায়। প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : ধন-সম্পদের প্রাচুর্য মানুষকে ধনী করে না, বরং অন্তরের আনন্দই মানুষকে প্রকৃত ধনী করে। (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)। পার্থিব জীবন আখিরাতের জীবনে যাওয়ার একটি মঞ্জিল মাত্র। আখিরাতের জীবনই হচ্ছে আসল জীবন। কুরআন মজিদে স্পষ্ট ভাষায় ইরশাদ হয়েছে : পারলৌকিক জীবনই তো প্রকৃত জীবন। (সূরা আনকাবূত : আয়াত ৬৪)। ইহলৌকিক জীবনটাকে তাই পরিচ্ছন্নতার সৌরভে যারা সুরভিত করতে পারে তারাই জীবনের ওপারে গিয়ে একটা সুন্দর জীবনের অধিকারী হতে পারে। আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রব্কে ভয় কর এবং ভয় কর সেই দিনের, যখন পিতা সন্তানের কোন উপকারে আসবে না, সন্তানও কোন উপকারে আসবে না তার পিতার। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য, সুতরাং পার্থিব জীবন যেন কিছুতেই তোমাদের প্রতারিত না করে এবং সেই প্রতারক (শয়তান) যেন কিছুতেই তোমাদের আল্লাহ সম্পর্কে প্রতারিত করতে না পারে (সূরা লুকমান : আয়াত ৩৩)। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, সহজ-সরল জীবনযাপন অর্থ বৈরাগ্য সাধন নয়। ইসলাম বৈরাগ্য সাধনকে অনুমোদন করে না। সকল প্রকারের লোভ-লালসাকে বর্জন করে, অল্পে তুষ্ট থেকে সহজ-সরল জীবনযাপনের মধ্যে যে সুখ রয়েছে, তাতে যে আনন্দ-বৈভব রয়েছে, সুখ-সমৃদ্ধির যে অপূর্ব অনুভব রয়েছে তা বিলাসবহুল জীবনে নেই। সহজ-সরল জীবন দুনিয়ার কল্যাণ বয়ে আনে এবং আখিরাতের কল্যাণের পথ প্রশস্ত করে দেয়। (সমাপ্ত) লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ
×