ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পাট ॥ অর্থ ও পাট এবং বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের মতপার্থক্য দূর হোক

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ১৬ মার্চ ২০১৮

পাট ॥ অর্থ ও পাট এবং বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের মতপার্থক্য দূর হোক

প্রথমে দেখলাম সোনারগাঁও হোটেলের আট রাস্তার মোড়ে, পরে দেখলাম সচিবালয়ের কাছে। দ্বিতীয় স্থানে গাছে গাছে পাটখড়ি ও কাঁচা পাট- একদম সোনালি রঙের। ভাবলাম নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে। পরে জানতে পারলাম ‘জাতীয় পাট দিবস’ উদযাপন করছে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়। এর ওপর লিখব লিখব করে আর লেখা হয়ে ওঠেনি। এর অবশ্য কারণও আছে। পাটের কথা উঠলেই আমি অনেকটা আবেগতাড়িত হয়ে পড়ি। ছোটবেলায় পাটের সঙ্গেই আমরা বড় হয়েছি। পাটের বীজ বপন, নিড়ানি, আগাছা উপড়ে ফেলা, পাটগাছ কাটা, পাটের ‘জাগ’ দেয়া, পাটশোলা থেকে পাট আলাদা করা, পাট ও পাটশোলা শুকানো ইত্যাদি কাজ চোখের সামনে দেখেছি এবং অনেক সময় আনন্দের সঙ্গে এসব কাজে জড়িত হয়েছি। কাঁচা পাটের গন্ধই আলাদা। বলাবাহুল্য, এই গন্ধ একটা আবেশ সৃষ্টি করে, যা আমাদের কৃষকদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম পাট চাষের সঙ্গে জড়িত রেখেছে। অধিকন্তু আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গেও পাট ছিল ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ‘পাকিস্তান’ (১৯৪৭-১৯৭০) আমলে পাট, চা ও চামড়া ছিল আমাদের প্রধানতম রফতানি সম্পদ। পাট ও চায়ের ওপর কত রচনা আমরা মুখস্থ করেছি। ‘সোনালি আঁশের’ ওপর ‘ম্যাট্রিক/এসএসসি’ পরীক্ষায় রচনা আসত বিরতি দিয়ে। আসত চায়ের ওপর। অতএব, আমার বয়সের লোকদের ওই আমলে পাটের রচনা মুখস্থ করতে হতোই। আরেকটা রচনাও ছিল প্রিয়। আর সেটা হচ্ছে গরুÑ দি কাউ। ‘দি কাউ ইজ এ্যা ফোর ফুটেড এ্যানিমেল’ বাক্যটি দিয়ে শুরু করে কতভাবেই না গরুর ওপর রচনা মুখস্থ করতে হতো। হবেই তো, পাট হচ্ছে কৃষিপণ্য এবং তা তো গরু ছাড়া চাষ করা যাবে না। এখনকার মতো তখনকারকালে তো ট্রাক্টর ইত্যাদি ছিল না, ছিল না আজকের মতো ‘যান্ত্রিকীকরণ’। এরই প্রেক্ষাপটে মানুষ হওয়া বাঙালী প্রথম আঘাত পেলাম বিএনপি আমলে। তারা হঠাৎ করে বিশ্বের এক নম্বর পাটকল ‘আদমজী জুট মিল’ বন্ধ করে দিল। বিশ্বব্যাংক চাপ দিয়ে এই কাজটি করাল। মিলটি বন্ধ করার জন্য তারা টাকা দিল। যতদূর মনে পড়ে শ্রমিক নেতাদের ওই সময়টাতে তারা আমেরিকা নিয়ে যায়, যাতে কোন প্রতিবাদ না হয়। এর কত কাহিনী। হাজার হাজার শ্রমিক চাকরি হারাল। তাদের বেতন-ভাতা বাকি পড়ল। আমার মনে না শুধু আরও অনেকের মনেই প্রশ্ন অনেক। বিশ্বব্যাংকের কী স্বার্থ? তারা টাকা দিয়ে মিল বন্ধ করাচ্ছে কেন? টাকা দিয়ে তারা মিল গড়ায়, অথচ ‘আদমজী’ বন্ধ করার জন্য, শ্রমিকদের বেকার করার জন্য তারা টাকা দিচ্ছে। আজব ঘটনা। এর কোন উত্তর নেই। উত্তর ধীরে ধীরে পাওয়া গেল। যে কাঁচা পাট উৎপাদনে আমরা ছিলাম বিশ্বে এক নম্বর সেই অবস্থান থেকে আমরা পেছনে পড়ে গেলাম। পেছনে পড়ে গেলাম পাটজাতদ্রব্য রফতানিতেও। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় কাঁচা পাট তৈরি হয় বাংলাদেশে (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান)। পাটকল সব ভারতে অর্থাৎ কলকাতার হাওরাঞ্চলে। আমাদের পাটকল নেই। ধীরে ধীরে আশপাশে পাটকল গড়ে ওঠে। আমরা আমাদের কাঁচা পাট ব্যবহার করতে শুরু করি। তৈরি হয় পাটজাতদ্রব্য। আমরা ভারতের প্রতিযোগী। শত হোক আমাদের কাঁচা পাটের মান ভাল। বিশ্বব্যাংকের বিষ খেয়ে ‘বিএনপি’ সরকার আদমজী জুট মিল বন্ধ করে দিলে আমাদের পাটশিল্প পেছনে পড়তে থাকে। দেশীয় পাটকল বন্ধ হতে থাকে। পাট চাষ নিরুৎসাহিত হতে থাকে। আজকে অবস্থা এমন হয়েছে যে, পাটের বীজ আমাদের হাতে নেই। ভারত থেকে পাটবীজ আমদানি করতে হয়। ওই বীজ অনেক সময় উন্নতমানের হয় না। অধিকন্তু বীজের সরবরাহ অনেক সময় হয় অনিয়মিত। এতে সমস্যায় পড়ে পাটচাষীরা। মজার ঘটনা বিশ্বব্যাংক আমাদের পাট চাষে নিরুৎসাহিত করে ভারতকে পাট চাষে উদ্বুদ্ধ করে। ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও ঢাকায় বিপুলসংখ্যক লোক পশ্চিমবঙ্গবাসী হয়েছেন। তাদের অনেকেই ছিলেন পাটচাষী। বর্ধমান ইত্যাদি অঞ্চলে তাদের বসতি। তারা পাটচাষে উৎসাহী হয়। ভারত হয়ে ওঠে পাট চাষে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী। শুধু পাট নয়, টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরির কারিগর, টাঙ্গাইলের ‘বসাকরা’ও বর্ধমান অঞ্চলে গিয়ে এখন ভারতীয় টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরি করে। এসব দারুণ দারুণ অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে শুধু পাটবীজ নয়, ধানের বীজের নিয়ন্ত্রণও আজ বড় বড় সংস্থার হাতে। কৃষকদের হাতে এর নিয়ন্ত্রণ নেই। অনেকেই মনে করেন এই সমস্যা আগামী দিনে আমাদের নাজুক পরিস্থিতিতে ফেলতে পারে। এই অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা শক্ত হাতে পাটকে এবং পাটশিল্পকে ধরেন। তিনি বন্ধ পাটকলের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচটাকে পুনরায় চালু করেন। গবেষণায় উৎসাহ দেয়ার ফলে পাটের ‘জেনোম’ আবিষ্কার হয়েছে। এতে পাটের ওপর আমাদের অধিকার নিশ্চিত হয়েছে। তিনি পাট ক্রয়ের জন্য প্রতিবছর ঋণের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। পাটকলগুলো যাতে চলতে পারে তার জন্য নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হচ্ছে : ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০।’ এই আইনটি প্রবর্তনের পর ধীরে ধীরে পাটশিল্প জাগরূক হচ্ছে। বর্তমান আইনের ফলে এখন ১৭টি পণ্যের মোড়ক হিসেবে পাটজাত দ্রব্য ব্যবহার করতে হয়। উল্লেখ্য, ভারত পাট উৎপাদন করত কম, রফতানিও করত কম। কারণ? কারণ তারা অভ্যন্তরীণভাবে পাটজাতদ্রব্য ব্যবহার করত বেশি। এর ফলে কাঁচা পাটের ব্যবহার দেশেই হতো বেশি। এই কাজটি আমাদের করতে কত সময় লাগল? ১৯৭২ সালে দেশ স্বাধীন, আর বাধ্যতামূলকভাবে মোড়ক হিসেবে পাটজাতদ্রব্য ব্যবহারের আইনটি হলো ২০১০ সালে। দেরিতে হোক তবুও পাটশিল্প ও পাটকে বাঁচানোর একটা ব্যবস্থা হলো। এখন সরকারী খাতে নয় শুধু, বেসরকারী খাতেও পাটকল হচ্ছে। বহুমুখী চাহিদার সৃষ্টি হচ্ছে। পাটপণ্য বহুমুখীকরণ এবং কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে কাজ করছে ‘জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার’ (জেডিপিসি)। এই সেন্টারের প্রচেষ্টার ফলে ২৩০-২৩৫ ধরনের দৃষ্টিনন্দন পাটপণ্য উৎপাদন হচ্ছে দেশে। নতুন নতুন পণ্য আবিষ্কারে সঙ্গত যোগাচ্ছে পরিবেশ সচেতনতা। পরিবেশ এখন সারা বিশ্বের জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পলিথিনের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবেশের সমূহ ক্ষতি হচ্ছে। সমুদ্রের তলদেশেও বর্জ্য পলিথিন পাওয়া যাচ্ছে বলে খবর আসছে। নালা-নর্দমা, খাল-বিল, নদী ভরে গেছে পলিথিনে। পলিথিন ধ্বংসও করা যায় না। এর যথেচ্ছ ব্যবহার বিশ্বকে বিপদে ফেলছে। আশার কথা মানুষ পলিথিনবিরোধী হয়ে উঠছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধের ঘোষণা দিয়েছে। এমতাবস্থায় পাটের শপিং ব্যাগ, শৌখিন দ্রব্যের চাহিদাও বাড়ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পাট দিবস উদ্বোধন অনুষ্ঠানে পাটসুতায় তৈরি পাটের শাড়ি ও পাটের স্যান্ডেল পরে এসেছিলেন বলে কাগজে দেখলাম। তার হাতে ছিল পাটের হ্যান্ডব্যাগ। তিনি উপস্থিত বোনদের আহ্বান করে বলেছেন পাটের তৈরি শাড়ি পরতে, বউমাদের পাটের শাড়ি উপহার দিতে। প্রধানমন্ত্রীর এসব বক্তব্য পড়তে পড়তে আমার মনে পড়ছিল ১৯৭৩ সালের কথা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সেমিনার কক্ষে পাটের ওপর একটা ওয়ার্কশপ হয়েছিল। সৈয়দ আলী কবীর তখন ‘ব্যাংকিং কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টের’ (বিসিডি) চীফ অফিসার। সেই ওয়ার্কশপে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের সবাই একটা করে সোয়েটার উপহার পেয়েছিলেন সেমিনারের উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে। পাটের তৈরি সোয়েটার। আমি বহুদিন ওই সোয়েটার পরেছি। সকলেই তখন জিজ্ঞেস করত এই সোয়েটারের কথা। বঙ্গবন্ধুও নেই, পাটেরও দুর্দশা শুরু হলো। আশার কথা সেই সুদিন আবার ফিরে আসছে। পাটের গুরুত্ব বাড়ছে। তবে পাটের সমস্যাও আছে। উৎপাদন ক্ষেত্রের সমস্যা এক রকমের। সেটি কৃষি সম্পর্কিত। উপাদান সরবরাহ, ন্যায্যমূল্যে তা সরবরাহের কাজ সেখানে বড় বিষয়। ভর্তুকিরও দরকার সেখানে। আবার দরকার পাটের ন্যায্যমূল্য। এটি দীর্ঘদিনের সমস্যা। পাকিস্তান আমল থেকেই এর কথা শুনে আসছি। অন্যান্য ফসলের মতোই পাটচাষীরা কাঁচা পাটের ন্যায্যমূল্য পায় না। এর একটা অন্যতম বড় কারণ ‘পাটকল কর্পোরেশন’ যথাসময়ে পাট কেনার টাকা পায় না। সময় মতো এবং প্রয়োজনমতো পাট ঋণের টাকা সরবরাহ করা সরকারের দায়িত্ব। এখন দেখা যাচ্ছে এসব ক্ষেত্রে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতপার্থক্য রয়েছে। বড় মতপার্থক্য একটা স্বীকৃতি প্রশ্নে দেখা দিয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। দুই বছর আগে প্রধানমন্ত্রী একটি আদেশ দিয়েছিলেন পাটকে কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিতে। অর্থ মন্ত্রণালয় আজও তা করেনি। এই বিষয়টি তো খুব জটিল বলে মনে হয় না। তাহলে কেন জটিলতা তৈরি হচ্ছে? প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ কার্যকর করা যে কোন মন্ত্রণালয়ের অবশ্য কর্তব্য। এটা কেন হচ্ছে না তা তলিয়ে দেখা দরকার। যদি কোন জটিলতা থাকে তাহলে এর ওপর সরকারের ভেতরেই আলোচনা হতে পারে, ক্যাবিনেট সভায় আলোচনা হতে পারে। বিষয়টি তো ঝুলে থাকতে পারে না দিনের পর দিন। পাটকল, পাটকল কর্পোরেশন, শ্রমিক, পুরনো যন্ত্রপাতি, সময়ানুগ ঋণ বরাদ্দ, প্রক্রিয়াজাত পাটপণ্য মোটামুটি এই কয়েকটিই আলোচ্য বিষয়। সরকারের উচিত অবিলম্বে এই বিষয়গুলো বিস্তারিত আলোচনা করে সমাধান বের করা। পাট ও পাটশিল্পকে নিয়ে যে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে তাকে কোনভাবেই নষ্ট করা ঠিক হবে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া এ সমস্যার সমাধান নেই। অতএব, অন্যান্য বিষয়ের মতো এক্ষেত্রেও তাকেই হস্তক্ষেপ করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা করা দরকার। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×