ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রমজানে প্রস্তুতি ॥ ৫ ভোগ্যপণ্য আমদানি বাড়ানো হবে

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১৫ মার্চ ২০১৮

রমজানে প্রস্তুতি ॥ ৫ ভোগ্যপণ্য আমদানি বাড়ানো হবে

এম শাহজাহান ॥ রমজান সামনে রেখে চিনি মসুর ডাল ছোলা ভোজ্যতেল এবং খেজুরের মতো পাঁচটি ভোগ্যপণ্য আমদানি বাড়ানোর প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। দেশের শীর্ষ ভোগপণ্যের আমদানিকারকরা পণ্য আমদানিতে এলসি (ঋণপত্র) খোলার পরিমাণ বাড়িয়েছেন। রমজানে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়-চিনির দাম ইতোমধ্যে কেজিতে ৩ টাকা বেড়ে গেছে। ছোলা, মসুর ডাল, ভোজ্যতেল এবং খেজুরের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। কমছে পেঁয়াজের দাম। আর নিত্যপণ্য চালের শুল্ক হ্রাসের সুবিধার পুরোটাই পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। কম দামে চাল আমদানি করে এখন তা উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে খুচরা পর্যায়ে। রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত বাজার মনিটরিং, টিসিবির ভোগ্যপণ্য বিক্রি, খোলা বাজারে (ওএমএস) বিক্রি কার্যক্রম শুরুসহ আরও কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, রমজানে যাতে দ্রব্যমূল্য পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে থাকে সেজন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে। ভোক্তা স্বার্থ রক্ষায় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের পক্ষ থেকে নিয়মিত বাজার তদারকি করা হবে। এ ছাড়া নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ভেজালমুক্ত খাবার পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে তাদের তৎপরতা বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। চাল, পেঁয়াজসহ অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দাম যাতে আর না বাড়ে সেজন্য নতুন বাজেটে এসব পণ্য আমদানিতে শুল্ক হ্রাসের ঘোষণাসহ উৎপাদনে প্রণোদনা ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচন সামনে রেখে দ্রব্যমূল্য নিয়ে কোন রকম বিতর্কে জড়াতে চাচ্ছে না সরকার। ইতোমধ্যে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষায় করণীয় নির্ধারণে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া রমজান সামনে রেখে পণ্যভিত্তিক সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী যাতে গড়ে না উঠতে পারে সেজন্য এখন থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি তৎপর হওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারক, মজুদকারী, সরবরাহকারী, পাইকার এবং খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের দিকেও এবার নজর রাখা হবে। আগামী সপ্তাহে দ্রব্যমূল্য আমদানি, দাম নিয়ন্ত্রণ এবং সরবরাহ ব্যবস্থাপনা নিয়ে সকল পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জরুরী বৈঠক করতে যাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করার কথা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব শুভাশিষ বসু জনকণ্ঠকে বলেন, রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে করণীয় সবকিছু করা হবে। তিনি বলেন, এবার জিনিসপত্রর দাম আর বাড়বে না। চিনি এবং মসুর ডালের দাম গত বছরের তুলনায় এখনও কম। পেঁয়াজের দাম বাড়লেও কমতে শুরু করেছে। এ পণ্যটির দাম আরও কমবে। এ ছাড়া অন্যান্য পণ্যের আমদানি বাড়ছে। সবমিলিয়ে ওই সময়ে দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক থাকবে। পণ্যমূল্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তিনি বলেন, এ ছাড়া সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা টিসিবি রমজানে পণ্যবিক্রি কার্যক্রম শুরু করবে। ওই সময় ভর্তুকি দিয়ে ভোক্তাদের স্বার্থে বাজারমূল্যের চেয়ে কমমূল্যে পণ্য বিক্রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। জানা গেছে, রমজান সামনে রেখে এবার দেশে ছোলা, মসুর ও মটর ডাল এবং চিনি ও ভোজ্যতেলের আমদানি ও সরবরাহ বেড়েছে। রাজধানী ঢাকার প্রধান পাইকারি বাজার হিসেবে খ্যাত মৌলভীবাজার এবং চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে এসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে গত বছরের চেয়ে কিছুটা কম দামে। কিন্তু খুচরা বাজারে এসব পণ্য বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, খুচরা বাজারের দায়ভার তাদের নয়। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে মিলমালিক এবং পাইকারি ব্যবসায়ীদের দিকে নজর বাড়াতে হবে। বাজারে সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক থাকলে কোন পণ্যের দাম বাড়বে না। যদিও পণ্যভেদে এবার আমদানি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় তিনগুণ পর্যন্ত বেড়েছে। চিনির দাম কেজিতে ৩ টাকা বেড়ে ৫৮ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। অথচ রমজানে এই পণ্যটির চাহিদা আরও বাড়বে। মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির কোষাধ্যক্ষ হাজী মোহাম্মদ আলী ভুট্টো জনকণ্ঠকে বলেন, আন্তর্জাাতিক বাজারে চিনি ও ভোজ্যতেলের দাম কম, তাই দেশেও বাড়ার সম্ভাবনা নেই। এ জন্য মিলমালিকরা যাতে সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখেন সেদিকটায় খেয়াল রাখা জরুরী। এ দিকে, ভোক্তাদের স্বার্থ বিচেবনায় নিয়ে গত কয়েক বছর আগে ১৭ পণ্যকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পণ্যগুলোকে অত্যাবশ্যকীয় করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা। কিন্তু রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে ও গত এক বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কারণ ছাড়াই খুচরা বাজারে ইতোমধ্যে কয়েকটি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে-রসুন, চিনি, ধনিয়া, জিরা, আদা, হলুদ, রসুন, তেজপাতা ও খাদ্য লবণ। যদিও আমদানি পরিস্থিতি গতবারের চেয়ে বেশি এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম নিম্নমুখী ধারায় রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পণ্যমূল্য নিয়ে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কারসাজি বন্ধ করা গেলে ভোগ্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক থাকবে আগামী রমজানে। টিসিবির যত প্রস্তুতি ॥ আগামী রমজান মাস সামনে রেখে সারা দেশে ১৭৪-১৮০ পয়েন্টে টিসিবি ট্রাক বসানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। যেখানে চিনি, মসুর ডাল, ছোলা, সয়াবিন তেল ও খেজুর সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হবে। রাজধানী ঢাকার ২৫-৩০ পয়েন্টে, চট্টগ্রামের দশটি, অন্য বিভাগীয় শহরে পাঁচটি করে ট্রাক বসবে। এ ছাড়া জেলা শহরে দু’টি করে মোট ১৭৪-১৮০ স্থানে অস্থায়ীভাবে ট্রাক বসিয়ে স্থানীয় বাজারের তুলনায় কিছুটা কম দামে পাঁচটি পণ্য বিক্রি করা হতে পারে বলে বলে জানিয়েছেন টিসিবির এক উর্ধতন কর্মকর্তা। রমজান উপলক্ষে পাঁচ শ’ মেট্রিক টন সয়াবিল তেল, ১ হাজার ৫শ’ মেট্রিক টন ছোলা খোলা বাজারে ছাড়া হবে বলে জানা গেছে। চালের শুল্ক হ্রাসের মুনাফা ব্যবসায়ীদের পকেটে ॥ চালের দাম কমাতে আমদানি শুল্ক ২৮ থেকে ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। এর ফলে চালের দাম কমার কথা ছিল। কিন্তু বাজারে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। মোটা চাল চায়না ইরি ও স্বর্ণা ৪৪-৪৭, সরু মিনিকেট ও নাজিরশাইল চাল ৬২-৭০ এবং মাঝারি মানের পাইজাম ও লতা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৮-৫৮ টাকায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যবসায়ীদের এ সুবিধা দেয়ার ফলে ভোক্তাদের কম দামে চাল কিনতে পারার কথা থাকলেও বাস্তবে তা হয়নি। কারণ আমদানি শুল্ক কমানোর সুবিধার বড় অংশই কায়দা করে ব্যবসায়ীরা নিজেদের পকেটে পুরেছেন। এক হিসাবে দেখা গেছে, শুধু শুল্কায়নের কারণেই প্রতিকেজি চালে ৯ টাকা কম খরচ হচ্ছে আমদানিকারকদের। গত ২০ জুন চাল আমদানির ওপর বিদ্যমান শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করার সিদ্ধান্তের কথা জানান বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। সে সময় তিনি বলেছিলেন, শুল্ক কমানোর পর কেজিপ্রতি পাঁচ-ছয় টাকা পর্যন্ত দাম কমবে। এরপর ১ জুলাই থেকে কম শুল্কে চাল আমদানি শুরু করেন ব্যবসায়ীরা। সে সময় প্রচুর পরিমাণ চাল ভারত থেকে আমদানি শুরু হলে এক মাসে চালের দাম কমে মাত্র এক-দুই টাকা। যদিও পাইকারি পর্যায়ে সেটা তিন টাকা পর্যন্ত কমেছিল। এরপর আরও একদফা শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত হয় গত বছরের আগস্টের মাঝামাঝি। ১৭ আগস্ট জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চালের আমদানি শুল্ক ২ শতাংশ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। শুল্ক কমানোর পাশাপাশি ভারতীয় বাজারে কমেছে চালের রফতানি মূল্যও। শুল্ক কমানোর পরও চালের দাম কমে মাত্র দুই টাকা। বাজারে চাল বেশি দামেই বিক্রি হচ্ছে। ডাল চিনি ছোলা ও ভোজ্যতেলের আমদানি বাড়ছে ॥ রমজান সামনে রেখে এবার দেশে ছোলা, মসুর ও মটর ডাল এবং চিনি ও ভোজ্যতেলের আমদানি ও সরবরাহ বাড়ছে। প্রতিবছর রমজানের মাস চারেক আগে থেকে ছোলা, চিনি, ভোজ্যতেল, ডাল ইত্যাদির আমদানি শুরু হয় বাড়তি চাহিদা পূরণের জন্য। কাস্টম হাউসের পরিসংখ্যান শাখার এক তথ্যে দেখা যায়, রমজান মাস সামনে রেখে গত জানুয়ারি-মার্চ সময়ে আবশ্যকীয় সব পণ্যের আমদানি বেড়েছে। এ ছাড়া ছোলা খেজুরসহ রমজানে চাহিদা বৃদ্ধি পায় এমন প্রয়োজনীয় সব পণ্য আমদানি হয়েছে প্রচুর। ভোজ্যতেলও আমদানি হয়েছে। গত বছর রমজানের পূর্বে যেমন আমদানি হয়েছিল এবারও হচ্ছে। এস আলম গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, বিএসএম গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ, আবদুল মোনেমসহ বিভিন্ন গ্রুপ রমজানের বাজার ধরতে অত্যাবশ্যকীয় বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য আমদানি করেছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, রমজানে কোন পণ্যের সঙ্কট হবে না, পণ্যভেদে এবার আমদানি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় তিনগুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে। দেশে রোজার মাসে ৭০ হাজার টন ছোলার চাহিদা থাকে বলে মনে করা হয়। রোজার মাসে শুধু শরবতে ব্যবহারের জন্য চিনির চাহিদা বাড়ে ১ লাখ টন। এ ছাড়া ওই সময়ে বিভিন্ন খাদ্যপণ্য তৈরিতে চিনির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পণ্যটির দাম বাড়ে। সরকারী পর্যায়ে দাম কমলে বেসরকারী চিনিরও দাম কমবে। এ দিকে, বিদেশ থেকে আমদানি করা মসুর ডালের দাম এখন সবচেয়ে কম। এত কম দামে মসুর ডাল এর আগে বেচাকেনা হয়নি। পাইকারি বাজারে দাম কমায় এখন খুচরা বাজারেও কেজিপ্রতি ৬০-৬৫ টাকা দামে মোটা মসুর ডাল পাওয়া যাচ্ছে। বাজারে যখন প্রায় সব পণ্যের চড়া দাম, সেখানে মসুর ডাল ভোক্তাদের কিছুটা হলেও স্বস্তি দিচ্ছে।
×