ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সৃষ্টিতত্ত্বের বিস্ময়কর বিজ্ঞানী হকিং আর নেই

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৫ মার্চ ২০১৮

সৃষ্টিতত্ত্বের বিস্ময়কর বিজ্ঞানী হকিং আর নেই

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ আধুনিক সৃষ্টিতত্ত্বের ‘উজ্জ্বলতম নক্ষত্র’ স্টিফেন উইলিয়াম হকিং আর নেই। বুধবার সকালে ৭৬ বছর বয়সে কেমব্রিজের নিজ বাসভবনে এই প্রবাদপ্রতিম ‘বিস্ময়’ বিজ্ঞানী মারা যান। বুধবার তার পরিবারের সদস্যরা গণমাধ্যমের কাছে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। -খবর বিবিসি, এএফপি ও টেলিগ্রাফ অনলাইনের। এক বিবিৃতিতে স্টিফেন হকিংয়ের তিন সন্তান লুসি, রবার্ট ও টিম বলেন, আমরা গভীর শোকের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, আমাদের প্রিয় পিতা আজ মারা গেছেন। তিনি বিখ্যাত বিজ্ঞানী ছিলেন। তার কাজ এ বিশ্বে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবে। স্টিফেন হকিংয়ের ‘সাহস ও অধ্যাবসায়ের’ প্রশংসা করেন তার সন্তানেরা। তারা বলেন, ‘হকিংয়ের প্রতিভা এবং রসবোধ বিশ্বব্যাপী মানুষকে অনুপ্রেরণা জোগাবে। তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।’ এই বিজ্ঞানীর মৃত্যুতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে, বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানসহ অন্যান্য বিশ্বনেতারা শোক প্রকাশ করেছেন। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খোলা হয়েছে শোক বই। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে স্টিফেন হকিংয়ের ভক্তরা এতে শোকবাণী লিখছে। টুইটারে এক শোক বার্তায় টেরেসা মে বলেন, স্টিফেন হকিংকে বিশ্ববাসী কোন দিন ভুলবে না। বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী বুধবার এক শোকবার্তায় বলেন, মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য ‘বিগ ব্যাং থিউরির’ প্রবক্তা স্টিফেন হকিং ছিলেন বর্তমান সময়ের সেরা পদার্থবিজ্ঞানী। তাঁর অধ্যবসায়, প্রতিভা এবং জীবনসংগ্রাম ছিল অতুলনীয়। তিনি বিশ্বব্যাপী মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বিজ্ঞানী গ্যালিলিওর মৃত্যুর ঠিক ৩শ’ বছর পর জন্ম হয়েছিল স্টিফেন হকিংয়ের। আর তিনি মারা গেলেন বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের ১৩৯তম জন্মবার্ষিকীর দিনে। মানুষের মৃত্যু-পরবর্তী জীবন নিয়ে নানা কথা চালু থাকলেও হকিং মনে করতেন, এ শুধুই রূপকথা। সেই রূপকথার জগতেই অবশেষে ঠাঁই নিলেন এই বিজ্ঞানী। পদার্থবিদ্যার ইতিহাসে অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী হিসেবে বিবেচনা করা হয় স্টিফেন হকিংকে। ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন তিনি। দুরারোগ্য মোটর নিউরন ব্যাধি ছিল হকিংয়ের। কিন্তু শারীরিক অক্ষমতা তাকে রুখতে পারেনি। আইনস্টাইনের পর হকিংকে বিখ্যাত পদার্থবিদ হিসেবে গণ্য করা হতো। তিনি ছিলেন রসবোধসম্পন্ন একজন মানুষ। বিজ্ঞানের একজন জনপ্রিয় দূত এবং তিনি সব সময় নিশ্চিত করতেন যেন তাঁর কাজ সাধারণ মানুষেরা সহজে বুঝতে পারেন। তাঁর লেখা বই এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম অনেকটা ধারণার বাইরে বেস্ট সেলার বা সবচেয়ে বিক্রীত বইয়ে পরিণত হয়। জীবদ্দশায় তিনি বেশকিছু টেলিভিশন প্রোগ্রামে অংশ নিয়ে কৃত্রিম কণ্ঠস্বরের সাহায্যে কথা বলেন। তার বাবা ছিলেন একজন জীববিজ্ঞানের গবেষক। জার্মানি থেকে লন্ডনে পালিয়ে যান তিনি। স্টিফেন হকিং লন্ডন এবং সেন্ট এ্যালবানসে বেড়ে ওঠেন। অক্সফোর্ডে পদার্থবিদ্যার ওপর প্রথম শ্রেণীর ডিগ্রী অর্জন করে ক্যামব্রিজে কসমোলজির ওপর স্নাতকোত্তর গবেষণা করেন তিনি। কেমব্রিজে গবেষণা করার সময় তার মোটর নিউরন রোগ ধরা পড়ে যেটা তাকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে অচল করে দেয়। ১৯৬৪ সালে যখন তিনি তার প্রথম স্ত্রী জেনকে বিয়ে করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন চিকিৎসকরা বলে দেন তিনি বড় জোর দুই থেকে তিন বছর বাঁচবেন। কিন্তু রোগটি যতটা দ্রুততার সঙ্গে ছড়ানোর আশঙ্কা করা হচ্ছিল তার চেয়ে কম গতিতে ছড়ায়। ১৯৮৮ সালে তিনি তার বই ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ প্রকাশ করেন। বইটির প্রায় এক কোটি কপি বিক্রি হয়। ১৯৮৮ সালের মধ্যে হকিং এর অবস্থা এমন হল যে শুধু কৃত্রিম উপায়ে কথা বলতে পারতেন তিনি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে তার অসুস্থতা তার জন্য কিছু উপকারও এনে দিয়েছে। তিনি বলেছিলেন, অসুস্থ হবার আগে তিনি জীবন নিয়ে বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। অবশ্য তার শারীরিক অবস্থা অবধারিতভাবেই তাকে অন্যদের ওপর নির্ভরশীল করে তোলে। তিনি প্রায় সময়ই তার প্রথম স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতার কথা বলতেন। যিনি ২০ বছরেরও বেশি তার দেখাশোনা করেছেন। যদিও তিনি যখন তার একজন নার্সের জন্য প্রথম স্ত্রীর সাথে সম্পর্কোচ্ছেদ করেন তখন তার বন্ধু এবং আত্মীয়-স্বজনরা বেশ অবাক হয়েছিল। ১৯৯৫ সালে তিনি তার সাবেক নার্সকে বিয়ে করেন। ২০০০ সাল নাগাদ আঘাতের কারণে তিনি বেশ কয়েকবার কেমব্রিজের একটি হাসপাতালে জরুরী বিভাগে চিকিৎসা নেন। ওই সময় একটি অভিযোগ আসে যে তিনি কয়েক বছর যাবত নানাভাবে মৌখিক এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদও করে। তবে তিনি ছিলেন বেশ খেয়ালী। তার হুইলচেয়ারটিই তিনি প্রায় সময় বেপরোয়াভাবে চালাতেন এবং হকিং বারবার বলেন যে, তার এসব আঘাত কোন নির্যাতনের কারণে হয়নি। পরে বিষয়টি নিয়ে পুলিশও আর আগায়নি। ২০০৭ সালে তিনি প্রথম চলৎশক্তিহীন ব্যক্তি হিসেবে একটি বিশেষ বিমানে ওজনশূন্যতার অভিজ্ঞতা নেন। মানুষকে মহাকাশ ভ্রমণে উৎসাহ দেয়ার জন্যই তিনি এটি করেছেন বলে জানান। তখন হকিং বলেন, আমার বিশ্বাস পারমাণবিক যুদ্ধ, জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে তৈরি ভাইরাস অথবা অন্য কোন কারণে পৃথিবীতে প্রাণের অবসান হতে পারে। মানুষ যদি মহাকাশে না যায় তাহলে আমার মনে হয় মানব জাতির কোন ভবিষ্যত নেই। যে কারণে আমি মানুষকে মহাকাশে যাওয়ার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে চাই। ২০১৪ সালে স্টিফেন হকিংয়ের জীবন নিয়ে তৈরি হয় ‘থিওরি অব এভরিথিং’ চলচ্চিত্র। জেন হকিংয়ের বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয় চলচ্চিত্রটি। ডিসকভারি চ্যানেলের সঙ্গে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, পৃথিবীর বাইরে কোন বুদ্ধিমান জীবনের উপস্থিতি আছে এমন ধারণা করাটা সম্পূর্ণ যৌক্তিক এবং এলিয়েন বা ভিনগ্রহবাসীরা প্রাকৃতিক সম্পদের খোঁজে পৃথিবীতে অভিযান চালাতে পারে। প্রিন্স অব অস্ট্রিয়ান্স পুরস্কার, জুলিয়াস এডগার লিলিয়েনফেল্ড পুরস্কার, উলফ পুরস্কার, কোপলি পদক, এডিংটন পদক, হিউ পদক, আলবার্ট আইনস্টাইন পদক অর্জন করেছিলেন হকিং।
×