ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্বকাপকথন-৯

সপ্তম বিশ্বকাপ : চিলি ১৯৬২

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ১৪ মার্চ ২০১৮

সপ্তম বিশ্বকাপ : চিলি ১৯৬২

বিশ্বকাপ ফুটবলের আর মাত্র বাকি মাস তিনেক। দিনের হিসাবে ১০০ দিনের মতো। প্রস্তুত ফিফা, প্রস্তুত সব ভেন্যু, যেখানে বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো অনুষ্ঠিত হবে। প্রস্তুত দশকও। প্রস্তুত বিশ্বকাপের ৫ বারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। বিশ্বকাপকে সামনে রেখে ব্রাজিলেও চলছে নানান আয়োজন। আয়োজনের ধারাবাহিকতায় এবারের বিশ্বকাপে ব্রাজিল তাদের পুরনো জার্সি বদলে নতুন জার্সি গায়ে মাঠে নামবে বলে শোনা যাচ্ছে। তবে নতুন জার্সি কেমন হবে সে বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়। তারপরও বিষয়টি অনেকের জানা হয়ে গেছে। ব্রিটিশ মিডিয়া তো এরই মধ্যে ব্রাজিলের নতুন জার্সি গায়ে নেইমারদের ছবিও প্রকাশ করে ফেলেছে। নতুন জার্সির সঙ্গে ব্রাজিলের ১৯৮০ সালের জার্সির অনেকটাই মিল রয়েছে। নতুন জার্সির গাঢ় সবুজ কলারের সঙ্গে হলুদ রং। রাশিয়া বিশ্বকাপে ব্রাজিলই গ্রুপে কোস্টারিকা, সুইজারল্যান্ড ও সার্বিয়ার মোকাবেলা করবে। এ বছর ১৪ জুন শুরু হয়ে এ প্রতিযোগিতা শেষ হবে ১৫ জুলাই। এবারের বিশ্বকাপ আয়োজন করছে রাশিয়া সে কথাও সবার জানা। রাশিয়ার মস্কোর লুজনিকি স্টেডিয়ামে ২১তম বিশ্বকাপ ফুটবলের উদ্বোধনী ও সমাপনী (ফাইনাল) ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। এ কথা সবার জানা, ১৯৩০ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম আসর বসে উরুগুয়েতে। মন্টিভিডিওতে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। মন্টিভিডিও থেকে মস্কো। বিশ্বকাপ ফুটবলের ৮৮ বছরের পথচলা নিয়ে আমাদের ধারাবাহিক আয়োজন ‘বিশ্বকাপকথন’। লিখেছেন... প্রথিতযশা কবি, কথাসাহিত্যিক ও ক্রীড়ালেখক সৈয়দ মাজহারুল পারভেজ আবার ল্যাটিনে বিশ্বকাপ আয়োজন। এবারের আয়োজক চিলি। সপ্তম বিশ্বকাপের আগে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প চিলির অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনে। অনেকে ভেবেছিল, চিলি হয়তো বিশ্বকাপ আয়োজন করতেই পারবে না। প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে যায় চিলির অবকাঠামো। প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে সব কিছু লন্ডভন্ড হয়ে যায়। চারদিকে তখন শোক আর দুর্ভিক্ষের ছায়া চিলিকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরে আছে। তারপরও সবকিছু ওভারকাম করে, সবার সব ধারণা মিথ্যে প্রমাণিত করে শেষ পর্যন্ত সফলভাবে (কিছু নিন্দিত ঘটনার পরও) বিশ্বকাপ আয়োজন করে চিলি। তবে এটি ছিল বিশ্বকাপ ফুটবলের অন্যতম নিন্দিত আয়োজন। সে কথায় পরে আসছি। এবারও বিশ্বকাপ সেই লাতিন-ইউরোপের গন্ডি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারল না। ঘুরে ফিরে বিশ্বকাপ সেই ইউরোপ-আমেরিকার গন্ডিতেই আটকে থাকল। লাতিন-ইউরোপের গন্ডি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারল না। সে যাই হোক, চিলি আয়োজক নির্বাচিত হলো ফিফার ১০৪টি সদস্য দেশের ভোটে। এবারও সপ্তম বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলল আগের মতোই ১৬টি দেশ। ১৬টি দেশ নির্বাচন করা হয় বাছাইপর্বের ৫৬টি দেশের মধ্যে থেকে। এই ১৬টি দেশের সবগুলো ছিল ইউরোপ আর দ. আমেরিকার। উ. আমেরিকা, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ থেকে এবার কোন দেশ খেলার সুযোগ পেল না। অঞ্চলভিত্তিক দলগুলো হলো : ইউরোপ : প. জার্মানি, ইংল্যান্ড, ইতালি, চেকোস্লাভাকিয়া, হাঙ্গেরি, সুইজারল্যান্ড, স্পেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুগোস্লাভিয়া, বুলগেরিয়া; কনমোবল : ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, চিলি, কলম্বিয়া; কনকাকাফ : মেক্সিকো সপ্তম বিশ্বকাপে অংশ নেয়। বাছাই পর্বে অনুষ্ঠিত হয় ৯১টি ম্যাচ। আর মূল পর্বে অনুষ্ঠিত হয় ৩২টি ম্যাচ। চিলির ৪টি স্টেডিয়ামে এই ৩২টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। ষষ্ঠ বিশ্বকাপের মতো এবারো গ্রুপিং করা হয় একই পদ্ধতিতে। গ্রুপ পর্বে ১৬টি দলকে ৪টি গ্রুপে ভাগ করা হয়। প্রত্যেক গ্রুপে ৪টি করে দল অংশ নেয়। এরপর চার গ্রুপের গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স আপ দলকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় কোয়ার্টার ফাইনাল। কোয়ার্টার ফাইনাল বিজয়ী ৪ দল সেমি-ফাইনাল ও সেমি। ফাইনাল বিজয়ী দুই দল ফাইনাল খেলে। এ বিশ্বকাপের সবচে’ উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার টপ ফেবারিট সব দলের চূড়ান্ত পর্বে খেলতে পারা। চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল ও স্বাগতিক চিলি সরাসরি মূল পর্বে খেলার সুযোগ পায়। গ্রুপ পর্বের স্বাগতিক চিলি বনাম দ্বিতীয় বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ইতালির মধ্যেকার ম্যাচটিকে ‘সান্টিয়াগোর যুদ্ধ’ বলা হয়। খেলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে রেফারিকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। যে করেই হোক চিলিকে যেন জিততেই হবে। শেষ পর্যন্ত তারা জেতেও ২-০ গোলে। তবে এ জয় খুব একটা কৃতিত্বের ছিল না। সেমি-ফাইনালেও চিলির সে গায়ের জোর অব্যাহত থাকে। ব্রাজিলের বিপক্ষেও তারা গায়ের জোরে খেলতে থাকে। খেলায় গন্ডগোল হয়। গ্যারিঞ্চাকে দেয়া হয় অন্যায়ভাবে বহিষ্কারাদেশ। শেষ পর্যন্ত ব্রাজিল ১০ জন নিয়েই জেতে ২-০ গোলে। এবারো কাপ শুরুর অনেক আগেই ব্রাজিল নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়। ব্রাজিলই যে শিরোপা অক্ষুন্ন রাখবে সেটা অনেকেই বিশ্বকাপ শুরুর আগেই বুঝে গিয়েছিল। এ কারণে বিশ্বকাপ শুরুর আগেই অনেকে ব্রাজিলের পক্ষে বাজি ধরতে রাজি ছিল। এ বিশ্বকাপেও ব্রাজিলের অধিনায়ক গ্যারি গিলমোর, স্যান্তোস ব্রাদার ছাড়াও জিটো, ভাভা, ডিডি, জাগালো, গ্যারিঞ্চার সঙ্গে পেলের খেলা দর্শক মাতিয়ে রাখেন। তারা আগের বিশ্বকাপের অধিনায়ক বেলিনি বা ফাইনালে পেলের অভাব বুঝতেই দেয়নি। বিশেষ করে গ্যারিঞ্চার খেলা দর্শক বিমোহিত করে। সপ্তম বিশ্বকাপকে বলা হয় ‘গ্যারিঞ্চার বিশ্বকাপ’। আগেই বলা হয়েছে, ১৬টি দল ষষ্ঠ বিশ্বকাপে অংশ নেয়। এই ১৬টি দলকে ৪ গ্রুপে ভাগ করা হয়। ক গ্রুপ : উরুগুয়ে, যুগোস্লাভিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কলম্বিয়া; খ গ্রুপ : প. জার্মানি, ইতালি, সুইজারল্যান্ড ও স্বাগতিক চিলি; গ গ্রুপ : চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল, স্পেন, চেকোস্লাভাকিয়া ও মেক্সিকো; ঘ গ্রুপ : আর্জেন্টিনা, ইংল্যান্ড, হাঙ্গেরি, ও বুলগেরিয়া অংশ নেয়। চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল, স্বাগতিক চিলি, যুগোস্লাভিয়া, ও যুগোস্লাভিয়া গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন ও ইংল্যান্ড, প. জার্মানি, হাঙ্গেরি, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুগোস্লাভিয়া রানার্স আপ দল হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে। ব্রাজিল, চেকোস্লাভাকিয়া, যুগোস্লাভিয়া ও চিলি অর্থাৎ গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন ৪ দলই কোয়ার্টার ফাইনালে জয়ী হয়। কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩-১ গোলে জয় পায়। তবে সেমিতেই স্বাগতিক চিলিকে ৪-২ গোলে হারিয়ে আগাম জানিয়ে দেয় এবারও বিশ্বকাপ তাদের। অপর সেমি-ফাইনালে যুগোস্লাভিয়া, ৩-১ গোলে হারায় যুগোস্লাভিয়াকে। গ্রুপ পর্বের ফলাফল : গ্রুপ-এ : উরুগুয়ে-২ কলম্বিয়া-১; সো. ইউনিয়ন-২ যুগোস্লাভিয়া-০; যুগোস্লাভিয়া-৩ উরুগুয়ে-১; সো. ইউনিয়ন-৪ কলম্বিয়া-৪; সো. ইউনিয়ন-২ উরুগুয়ে-১; যুগোস্লভিয়া-৫ কলম্বিয়া-০; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : সো. ইউনিয়ন গ্রুপ রানার্স আপ : যুগোস্লাভিয়া। গ্রুপ-বি : চিলি-৩ সুইজারল্যান্ড-১; প. জার্মানি-০ ইতালি-০; চিলি-২ ইতালি-১; প. জার্মানি-২ সুইজারল্যান্ড-১; প. জার্মানি-২ চিলি-০; ইতালি-০ সুইজারল্যান্ড-১; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : প. জার্মানি গ্রুপ রানার্স আপ : চিলি। গ্রুপ-সি : ব্রাজিল-২ মেক্সিকো-১; চেকোশ্লাভাকিয়া-১ স্পেন-০; ব্রাজিল-০ চেকোস্লাভাকিয়া-০; স্পেন-১ মেক্সিকো-০; ব্রাজিল-২ স্পেন-১; মেক্সিকো-৩ চেকোস্লাভাকিয়া-১; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : ব্রাজিল গ্রুপ রানার্স আপ : চেকোস্লাভাকিয়া। গ্রুপ-ডি : আর্জেন্টিনা-১ বুলগেরিয়া-০; হাঙ্গেরি-২ ইংল্যান্ড-১; ইংল্যান্ড-৩ আর্জেন্টিনা-১; হাঙ্গেরি-৬ বুলগেরিয়া-১; আর্জেন্টিনা-০ হাঙ্গেরি-০; ইংল্যান্ড-০ বুলগেরিয়া-০; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : হাঙ্গেরি গ্রুপ রানার্স আপ : ইংল্যান্ড। কোয়ার্টার ফাইনাল : যুগোস্লাভিয়া-২ প. জার্মানি-০; ব্রাজিল-৩ ইংল্যান্ড-১; চিলি-২ সো. ইউনিয়ন-১; চেকোস্লাভাকিয়া-১ হাঙ্গেরি-০; সেমি-ফাইনাল : ব্রাজিল-৩ চিলি-২; চেকোস্লøাভাকিয়া-৩ যুগোস্লাভিয়া-১; তৃতীয় স্থান : চিলি-১ যুগোস্লøাভিয়া-০; ফাইনাল : ব্রাজিল-৩ চেকোস্লাভাকিয়া-১ (আমারিন্ডো, জিটো, ভাভা) (মার্সোপাস্ট) চ্যাম্পিয়ন : ব্রাজিল রানার্স আপ : চেকোস্লাভাকিয়া তৃতীয় স্থান : চিলি। চিলির সান্টিয়াগোতে অনুষ্ঠিত হয় আর একটি ল্যাটিন-ইউরোপ ফাইনাল। তবে এবার ফাইনালটাতে হয় হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। আগের ম্যাচে ‘লাল কার্ড’ পাওয়ায় গ্যারিঞ্চার খেলা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। ম্যাচে নেই পেলেও। ব্রাজিলের জয় নিয়েও সংশয় দেখা দেয়। শেষমেষ গ্যারিঞ্চার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ব্রাজিলের সমর্থকেরা। আর সেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ফাইনালে লাতিন ফুটবলের কারিশমার কাছে আবারও হেরে যায় ইউরোপ। ব্রাজিল জেতে ৩-১ গোলে ইউরোপের দল চেকোস্লাভাকিয়ার বিপক্ষে। বিরতির সময় পর্যন্ত খেলা ১-১ গোলে অমীমাংসিত ছিল। তুমুল উত্তেজনার মধ্যে খেলা শুরু হয়। খেলার শুরুতেই চেক স্ট্রাইকার মার্সোপাস্ট গোল করে চেকোস্লাভাকিয়াকে এগিয়ে নেন। ব্রাজিলের আমারিন্ডো গোল পরিশোধ করে দলকে খেলায় সমতা আনেন। বিরতির পর কোমর বেঁধে মাঠে নামে ব্রাজিল। তারা অল-আউট ফুটবল খেলতে থাকে। এর ফলও পায় তারা। পেলে মাঠে নেই। পুরো দায়িত্ব একাই কাঁধে তুলে নিলেন গ্যারিঞ্চা। গ্যারিঞ্চা নিজে গোল করলেন না। সতীর্থ জিটো ও ভাভাকে দিয়ে গোল করালেন। নিশ্চিত হলো ব্রাজিলের জয়। আর এর ফলে টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ ছোঁয়ার গৌরব অর্জন করে সাম্বা নাচের দেশ ব্রাজিল। আবারও স্বপ্নের বিশ্বকাপ ছোঁয়া। পঞ্চাশে যে কাপ ছুঁতে গিয়েও পারেনি সে কাপ ঘরে তুললো পরপর দু’বার। ভাভা, আমারিন্ডো, গিলমোর, জাগালোদের সঙ্গে এ কৃতিত্ব বলতে গেলে সিংহভাগই ছিল গ্যারিঞ্চার। বলা যায়, একক তাঁর কৃতিত্বে এবার কাপ জয় করে ব্রাজিল। বিশ্বকাপের ইতিহাসে আরও একবার ফেবারিটরাই কাপ জয় করে। তৃতীয়স্থান নির্ধারণী ম্যাচে স্বাগতিক চিলি ১-০ গোলের কষ্টসাধ্য জয় পায় যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে। সপ্তম বিশ্বকাপে ব্রাজিলের নেতৃত্ব দেন গ্যারি গিলমোর আর চেকোস্লাভাকিয়ার ডিফেন্ডার নোভাক। সপ্তম বিশ্বকাপে মোট ৮৯টি গোল হয়। সপ্তম বিশ্বকাপে সর্বধিক গোল করেন গ্যারিঞ্চাসহ ৬ জন। তারা প্রত্যেকে ৪টি করে গোল করেন। সপ্তম বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ পরিচালনা করেন সোভিয়েত ইউনিয়নের রেফারি ল্যাটিভেচ। (চলবে) লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ লেখক পরিষদ e-mail : [email protected]
×