ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সত্য ও সুন্দরের প্রতীক ছিলেন প্রিয়ভাষিণী- নাগরিক শোকসভা

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৪ মার্চ ২০১৮

সত্য ও সুন্দরের প্রতীক ছিলেন প্রিয়ভাষিণী- নাগরিক শোকসভা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একইসঙ্গে সত্য ও সুন্দরের প্রতীক ছিলেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। সাহসী এই মানুষ একদিকে শিল্পচর্চা করেছেন, অপরদিকে লড়াই করেছেন সত্যের প্রতিষ্ঠায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ছড়িয়ে দিতে ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশজুড়ে। কাজ করেছেন একাত্তরের নির্যাতিত নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায়। এভাবেই মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে মূল্যায়ন করলেন বিশিষ্টজনরা। মঙ্গলবার বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত হলো সদ্য প্রয়াত এ শিল্পীকে নিবেদিত নাগরিক শোকসভা। এ স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। নেপালে বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণে নীরবতা পালনের মাধ্যমে স্মরণানুষ্ঠানের সূচনা হয়। এরপর পরিবেশিত হয় শোকসঙ্গীত। শারমিন সাথী ইসলাম শোনান ‘তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে/তব, পুণ্য-কিরণ দিয়ে যাক, মোর মোহ-কালিমা ঘুচায়ে’। এরপর শুরু হয় ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে নিবেদিত আলোচনা। বক্তব্য রাখেন ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির, নাট্যজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ, প্রিয়ভাষিণীর মেয়ে ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী, ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, প্রিয়ভাষিণীর চিকিৎসক ডাঃ আমজাদ হোসেন, জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি মাকসুদ কামাল, চারুশিল্পী সংসদের সাধারণ সম্পাদক চিত্রশিল্পী মনিরুজ্জামান, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি প্রমুখ। প্রিয়ভাষিণীকে নিবেদিত স্বরচিত কবিতাপাঠ করেন কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তারিক সুজাত। সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী প্রকৃতির মঝে খুঁজেছেন শিল্পকে। অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। একইসঙ্গে তিনি ধারণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং অন্যদিকে ছড়িয়েছেন নন্দনতাত্ত্বিক বোধ। ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী বলেন, আমি একাত্তর দেখিনি, মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। আমি একজন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে দেখেছি। একজন শিল্পীর জীবন দেখেছি। তার চোখের দ্যূতি দেখেছি। সেই দ্যূতি আমাকে তাড়া করে, আমাকে শাসন করে। যদি পৃথিবীতে আমার শতবার জন্ম হয় তাহলে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর সন্তান হিসেবে জন্ম নিতে চাই। কামাল লোহানী বলেন, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে ইলা মিত্রের উত্তরাধিকার হিসেবে পাই। ঘরে বাইরে সত্য ও সুন্দরের উপাসনাই ছিল তার আরাধ্য। তাই আমাদের মাঝে তিনি বিরাজ করবেন সত্য ও সুন্দরের প্রতীক হয়ে। সারা দেশ ঘুরে ঘুরে তিনি তরুণ প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করেছেন। সত্যকে নিঃশঙ্ক চিত্রে গ্রহণ করেছেন। একাত্তরে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের কথা অকপটে বলেছেন। মানসিক যন্ত্রণাকে পাশ কাটিয়ে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সংগ্রাম করেছেন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। তারপরও আমরা যদি কুসংস্কারে নিমজ্জিত থাকি তবে তার জন্য এ স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করা শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। শাহরিয়ার কবির বলেন, আত্মপ্রকাশের যে সাহস প্রিয়ভাষিণী দেখিয়েছিলেন তা বিরল। একাত্তরের নির্যাতিত নারীদের সেই যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। একসময় সেসব নির্যাতিত নারীরা তাদের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়ার অপমান ও লাঞ্ছনার কথা বলতো না। প্রিয়ভাষিণী সেই বীরাঙ্গনাদের একজন যিনি সেই নির্যাতনের কথাসহ নির্যাতকদের নাম বলেছিলেন। নীরবতার দেয়াল ভেঙেছিলেন। তার কারণেই বীরাঙ্গনারা যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালে এসে মুখ খুলেছেন। সাক্ষী দিয়েছেন। এভাবেই সারাদেশের নির্যাতিত নারীদের মুখে প্রতিবাদের ভাষা দিয়েছেন প্রিয়ভাষিণী। হয়ে উঠেছিলেন সততা, সাহস ও সংগ্রামের প্রতীক। নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, আমরা জাহানারা ইমাম কিংবা সুফিয়া কামালকে যেভাবে পেয়েছি, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকেও সেভাবে পেয়েছি। তিনি ছিলেন আমাদের শক্তির উৎস। প্রশ্ন তুলে হাশেম খান বলেন, বীরাঙ্গনাদের আমরা কতটুকু সম্মান দিয়েছি? অথচ তাদের বাদ দিয়ে স্বাধীনতার কথা ভাবা যায় না। প্রিয়ভাষিণীর মতো সাহসী মানুষ সেই অধিকারের পক্ষে সোচ্চার হয়েছেন। উল্টোদিকে তিনি ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত শিল্পী। এদেশের ভাস্কর্যশিল্পে তার অবদানটি অনন্য। মুহাম্মদ সামাদ বলেন, যখন যেভাবে যতটা পেরেছেন মানুষের জন্য কাজ করেছেনÑএটাই ছিল প্রিয়ভাষিণীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। হাসান আরিফ বলেন, একইসঙ্গে সত্য ও সুন্দরের এক অভূতপূর্ব মিশ্রণে গঠিত মানুষ ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। প্রবল সাহস নিয়ে দাঁড়িয়েছেন সত্যের মুখোমুখি। তার মতো মানুষ যদি আরও বেশি জন্মাতো তাহলে এদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত হতো না। তুরিন আফরোজ বলেন, আজকের মতো অনেক অনুষ্ঠানে তাকে পাশে রেখে কথা বলেছি। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গে কাজ করতে এসে তাকে যেভাবে দেখেছি, এতে মনে হয়েছে তিনি একজন ব্যক্তি নন, তিনি একটি প্রতিষ্ঠান।
×