ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মিরপুরের বস্তিতে আগুনে হাজারো পরিবারের স্বপ্ন ছারখার

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৪ মার্চ ২০১৮

মিরপুরের বস্তিতে আগুনে হাজারো পরিবারের  স্বপ্ন ছারখার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মিরপুর-১২ নম্বরে ইলিয়াস মোল্লা বস্তিতে পুড়েছে হাজার হাজার পরিবারের স্বপ্ন। জীবন বাঁচাতে তারা ঘর থেকে বের হলেও স্বল্প আয়ের মানুষগুলো রক্ষা করতে পারেননি তাদের কষ্টার্জিত অর্থে কেনা প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রসহ অর্থকড়ি। ঘুমন্ত এসব খেটে খাওয়া মানুষ আগুনের থাবা থেকে বাঁচতে পরিবারসহ ঘর থেকে কোনমতে বেরিয়ে জীবন বাঁচিয়েছেন। আগুন থামলেও তারা কি খুঁজে পেয়েছে তাদের স্বপ্ন? সাত বছরের শিশু তানিয়া। ঘুমন্ত অবস্থায় তার মা ও বাবা তাকে ঘর থেকে বের করে। আচমকায় চোখ খুলে সে দেখতে পায় আগুনের লেলীহান শিখা জ্বলছে। আফসোস করে মাকে বলতে থাকে, ‘আমার বইগুলো পুড়ে যাচ্ছে মা’। অন্যদিকে তার মা আলেয়া বেগম স্তদ্ধ! একটি এনজিও থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে তিনি কিনেছিলেন একটি সেলাই মেশিন। সেটিও পুড়েছে। আর্তনাদ করার মত শক্তিও ছিল না তার। তার স্বামী হাশেম আলীর জমানো পাঁচ হাজার টাকাও ঘর থেকে বের করে আনতে পারেননি। আগুন নিভলে তানিয়া ও তার পরিবার মিলে যে জায়গাটিতে তাদের ছোট্ট ঘরটি ছিল সেখানে খুঁজতে থাকে অবশিষ্ট জিনিসগুলো। তানিয়া তার মায়ের সখের সেলাই মেশিন খুঁজে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা। কিন্তু সেটি পুড়ে গেছে। অবশিষ্ট রয়েছে লোহার দ-ায়মান অংশটি। আর সেটিতে পা রেখে মেশিনের চাকা ঘুরাচ্ছিলো তানিয়া। তানিয়া জনকণ্ঠকে জানায়, ‘আমি ক্লাস টু’তে পড়ি। আমার বাবা রিক্সা চালায় আর মা জামা সেলাই করে। আমার সব বই আগুনে পুড়েছে। মায়ের মেশিনও পুড়েছে। এখন তো আর থাকার জায়গাও নাই। কিচ্ছু নাই।’ কথাগুলো বলে তানিয়া উদাস হয়ে তাকিয়ে ছিল নিজ ঘরের পোড়া স্থানটির দিকে। তানিয়ার মা আলেয়া বেগম জানান, তিন বছর আগে মেয়েকে নিয়ে তিনি গাইবান্ধা থেকে ঢাকায় আসেন। তানিয়ার বাবা গত ৬ বছর ধরেই ঢাকায় রয়েছেন। পেশায় তিনি একজন রিক্সাচালক। আলেয়া বেগম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমি যখন মেয়েকে নিয়ে ঢাকায এলাম তখন মানুষের বাসায় কাজ করতাম। এরপর সেলাইয়ের কাজ শিখে এনজিও থেকে ধার নিয়ে সেলাই মেশিন কিনি। বস্তির অন্যদের জামা কাপড় সেলাই করতাম। মাসে ৪ হাজার টাকার মত রোজগার হত। পরিশ্রমের টাকা দিয়ে ঘরের অনেক জিনিসপত্র কিনেছি। সবই এখন পুড়ে ছাঁই! মেয়েকে স্কুলেও ভর্তি করেছি। ভালই পড়াশোনা করে। কিন্তু এখন তো আর কিচ্ছু নাই। কিভাবে এই শহরে থাকব? এলাকায় ফিরে যাওয়া ছাড়া আর গতি নাই।’ মঙ্গলবার ইলিয়াস মোল্লা বস্তিতে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেল, টিন আর কাঠের ঘরগুলোর এখন পোড়া টিন ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। ঘরের আসবাবের মধ্যে লোহা ও স্টিলের আসবাবগুলো পড়ে আছে দুমড়ে-মুচড়ে। সেসব কুড়িয়ে গুছিয়ে রাখতে ব্যস্ত বস্তির বাসিন্দারা। তাদের চোখে মুখে হতাশা ও ক্লান্তি। সোমবার রাতের সেই ভয়াবহ অগ্নিকা-ের পর থেকে তাদের ঠাঁই মিলেছে খোলা আকাশের নিচে। বস্তির ধ্বংসস্তুপে আগুন থেকে রক্ষা পাওয়া জিনিসপত্র খুঁজছিলেন রাবেয়া। পোড়া টিন সরিয়ে তিনি খুঁজে পেয়েছেন শুধু স্টিলের কিছু জিনিসপত্র। তিনি বলেন, ‘গরীবের উপরই সবসময় গজব আসে কেন? কি দোষ আমাদের এতগুলো মানুষের? এখন আমরা কোথায় যাব, কি করব? সব শেষ হয়ে গেল।’ আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে এই বস্তির পাঁচ হাজার পরিবারের স্বপ্ন। এসব পরিবারের কেউ বিদেশ যাওয়ার জন্য ঋণ নিয়ে টাকা এনে ঘরে রেখেছিলেন, সঙ্গে ছিল পাসপোর্ট-ভিসা। কারও কারও সংসারের খরচ চালানোর টাকা, বেতনের টাকা ছিল ঘরে। এছাড়া কারও কারও সারাজীবনের সঞ্চয়ও ছিল এসব বাসাবাড়িতে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি রবিবার (১১ মার্চ) দিবাগত রাতের আগুনে তাদের বাসাবাড়ির সঙ্গে পুড়ে গেছে এসব নগদ টাকা, শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই থেকে শুরু করে বিদেশগামীর পাসপোর্ট-ভিসাও। তাদের অভিযোগ, উদ্দেশ্যমূলকভাবে কেউ নাশকতা করে বস্তিতে আগুন দিয়ে তাদের স্বপ্ন পুড়ে ছাই করে দিয়েছে। আগুনে মোট চারটি বস্তির ঘর পুড়েছে। সেগুলো হল, হারুনাবাদ বস্তি, কবির মোল্লা বস্তি, নাগর আলী মাতব্বর বস্তি ও সাত্তার মোল্লা বস্তি। প্রতিটি বস্তিতেই দেড় হাজারেরও বেশি ঘর ছিল। এই চার বস্তির একটি ঘরও অবশিষ্ট নেই। সব পুড়ে গেছে। বস্তিতে থাকা নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর মধ্যে আতঙ্ক দেখা গেছে। রেহেনা বেগম নামে এক নারী বলেন, ’১৫ বছর ধরে পোশাক কারখানায় কাজ করি। চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। ছোট ছেলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। ওকে নিয়ে বাড়িতে চলে যাব বলে ঠিক করেছি। কিন্তু সারা জীবনের আয় রোজগার সব পুড়ে গেছে।’ পেশায় গাড়ি চালক মোঃ মিলন শেখের তিনটি রুম ছিল। আগুন লাগার পর ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বের হয়ে জানে বাঁচলেও বাঁচাতে পারেননি ঘরের কিছুই। স্বল্প আয় থেকে টাকা জমিয়ে কেনা ঘরের সব সামগ্রীই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তার। মিলন শেখ বলেন, ‘এক কাপড়ে কোনমতে জীবন নিয়ে বের হয়েছি। ১০ বছরের রোজগার দিয়ে যেসব জিনিসপত্র কিনেছিলাম সব পুড়ে ছাই। এখন ওই জায়গাতেই আবার মোটামুটি একটা ঘর উঠাবেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শহরেতো আর থাকার জায়গা নাই। এখানেই আপাতত মাথার ওপরে একটা চাল উঠাইয়া থাকতে শুরু করি। দেখি কি হয়?’ লোকমান কাজী নামে আরেকজন নাতিকে নিয়ে একই বাটিতে জনপ্রতিনিধির দান করা খিচুরি খাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা দিন আনি দিন খাই, এর মইধ্যে টুকটাক কিছু দিয়া ঘরের জিনিসপত্র কিনেছি। আর কাছে কোন পুঁজি নাই।’ দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে এই বস্তিতেই বসবাস করছিলেন শাহজাহান। দীর্ঘদিনের দিনমজুরের আয় থেকে বস্তিতে ৭টা রুম করেছিলেন। যেগুলো ভাড়া দিয়ে ৭ জনের সংসার চলছিল ষাটোর্ধ শাহজাহানের। তিনি বলেন, ‘আগুনের সময় ঘরে ছিলাম না। দেশের বাড়ি শরীয়তপুর গেছিলাম। খবর পেয়ে এসে দেখি সব শেষ। টিভি, ফ্রিজ থেকে শুরু করে ঘরে সবই পুড়ে গেছে। এখন পোড়া ভিটার ওপর দাঁড়িয়েই ধ্বংসাবশেষগুলো গুছিয়ে রাখছেন তিনি। এখন কি করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইনকাম দিয়ে যা করছি সবই গেছে। এখন কোন ব্যাংক ব্যালেন্সও নাই যে আবার ঘর তুলব। যদি সরকার একটু সাহায্য করে একটা ঘর উঠাইতে পারব। নয়তো কি করব আর উপায় জানা নাই।’ ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে সরকার ॥ ঘটনাস্থলে সেতুমন্ত্রী পল্লবীর মোল্লা বস্তির বাতাসে এখনও পোড়া গন্ধ। শূন্য ভিটায় শুধু সিমেন্টের খামগুলো কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এমন দুর্দিনে সরকারের দেয়া সহায়তা তাদের নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। সরকার তাদের সহায়তা না করলে তাদের রাস্তায় নামা ছাড়া আর কোন পথ ছিল না। এখন অন্তত দু’চার দিন খেয়ে পড়ে কাজের খোঁজ করা যাবে। এদিকে সরকারের তরফ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য একশ টন চাল ও নগদ দশ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সরেজমিনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের তিনি সান্ত¦না দিয়ে বলেছেন, সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার পাশাপাশি বসবাসের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তদন্তে আগুন লাগার কারণ শীঘ্রই বেরিয়ে আসবে। ঘটনার পর থেকেই সরকার দলীয় এমপি ইলিয়াছ মোল্লা লঙ্গরখানা খুলে ক্ষতিগ্রস্তদের খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। পাশাপাশি সাময়িকভাবে থাকার ব্যবস্থাও করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে ক্ষতিগ্রস্তদের সার্বিক পরিস্থিতি দেখতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মঙ্গলবার সরেজমিনে বস্তিতে যান। তিনি সার্বিক পরিস্থিতি দেখে মর্মাহত হন। তাকে দেখে বস্তিবাসীরা ছুটে আসেন। তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের সান্ত¦না দিয়ে বলেন, যে ক্ষতি হয়েছে, তা অত্যন্ত কষ্টদায়ক। এ ব্যাপারে ত্রাণমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে আছে। সরকারের তরফ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য একশ টন চাল ও নগদ ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ঢাকার জেলা প্রশাসককে ক্ষতিগ্রস্তদের দ্রুত তালিকা তৈরি করতে বলা হয়েছে। এরপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। মন্ত্রী আরও বলেন, বস্তিবাসীদের জন্য সরকার স্থায়ী আবাসন করতে কাজ করে যাচ্ছে। ঢাকার বাউনিয়ায় বিরাট এলাকা জুড়ে পুনর্বাসনের জন্য ইতোমধ্যেই কাজ শুরু হয়েছে। যাতে বস্তিবাসীদের জন্য দীর্ঘস্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা হয়। মন্ত্রীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াছ মোল্লা, সাদেক খানসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
×