ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

স্বজন ও শুভাকাক্সক্ষীদের চোখেমুখে বিষাদের ছায়া

অনেক স্বপ্নের সমাধি

প্রকাশিত: ০৫:২১, ১৪ মার্চ ২০১৮

অনেক স্বপ্নের সমাধি

ওয়াজেদ হীরা ॥ বিয়ে হয়েছে মাত্র ১৩ দিন। এখনও বুঝে উঠাই হলো না সংসার নামের বিষয়টি। নেপালে মধুচন্দ্রিমায় গিয়ে ফিরতে হচ্ছে লাশ হয়ে। আঁখি মনি ও তার স্বামী মিনহাজ বিন নাসিরের এমন অকাল মৃত্যু শোকে স্তব্ধ তাঁদের পরিবার। শুধু এই দম্পত্তিই নয় বিমান বিধ্বস্তে প্রকৌশলী-শিক্ষক, সাংবাদিক, সরকারী বেসরকারী কর্মকর্তাসহ ২৬ জন নিহত হয়েছেন। এই মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে অনেক স্বপ্নেরও সমাধি হলো। পরিবার-স্বজন ও শুভাকাক্সক্ষীদের চোখে মুখে শুধুই বিষাদের ছায়া। যেখানে সমাজের জন্য দেশের জন্য অনেক অবদান রাখতে পারতো মৃত্যুর মিছিলের এই যাত্রীরা। প্রতিটি পরিবারে এখন শোকের মাতম। বাবা, ভাই, বোন, বন্ধু কিংবা স্বজন হারিয়ে বাকরুদ্ধ প্রতিটি শোকাহত পরিবার। একটি দুর্ঘটনা এমন বিষাদ এনে দিয়েছে। অথচ কত আনন্দ আর উচ্ছ্বাস নিয়ে হিমালয় কন্যা নেপালের উদ্দেশে যাত্রা করেছিল সবাই। ইতোমধ্যেই নেপালে ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনায় হতাহত বাংলাদেশী যাত্রী ও ক্রুদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। নেপালে বাংলাদেশ দূতাবাস মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে এ তালিকা প্রকাশ করে। ওই ফ্লাইটের বাংলাদেশীদের মধ্যে ৩২ জন যাত্রী এবং চার জন পাইলট ও ক্রু ছিলেন। তাদের মধ্যে ২৬ জন নিহত হয়েছেন। আর ১০ জন আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বলেও জানা গেছে। ইউএস-বাংলার জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কামরুল ইসলাম মঙ্গলবার বারিধারায় করপোরেট অফিসে ২৬ জন বাংলাদেশী নিহতের তথ্য জানান। বাংলাদেশী যারা নিহত ॥ ফয়সাল আহমেদ, আলিফউজ্জামান, বিলকিস আরা, বেগম হুরুন নাহার বিলকিস বানু, আখতারা বেগম, নাজিয়া আফরিন চৌধুরী, মোঃ রকিবুল হাসান, সানজিদা হক, মোঃ হাসান ইমাম, মোঃ নজরুল ইসলাম, আঁখি মনি, মিনহাজ বিন নাসির, এফ এইচ প্রিয়ক, তামারা প্রিয়মনি, মোঃ মতিউর রহমান, এস এম মাহমুদুর রহমান, তাহারা তানভীন শশী রেজা, পিয়াস রায়, উম্মে সালামা, অনিরুদ্ধ জামান, মোঃ নুরুজ্জামান ও মোঃ রফিকুজ্জামান। এছাড়া ইউএস-বাংলার নিহত পাইলট ও ক্রুরা হলেনÑ ফ্লাইটের পাইলট আবিদ সুলতান, প্রিথুলা রশীদ, খাজা হুসাইন, এইচ এম শাফেয়ী। বাংলাদেশী যারা আহত ॥ শাহরিন আহমেদ, শাহীন বেপারী, ইয়াকুব আলী, রেজওয়ানুল হক, মেহেদি হাসান, ইমরানা কবীর হাসি, কবীর হোসেন, সৈয়দা কামরুন্নাহার স্বর্ণা, শেখ রাশেদ রোবায়েত ও আলমুন নাহার এ্যানি। তাদের মধ্যে রেজওয়ানুল হক ওম হাসপাতালে ও ইয়াকুব আলী নরভিক হাসপাতালে ভর্তি আছেন। বাকিরা ভর্তি আছেন কাঠমান্ডু মেডিক্যাল কলেজে (কেএমসি)। এদিকে, স্বজন হারানো পরিবারগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে একেক পরিবারের একেক সদস্য নানা স্বপ্ন চোখে গিয়েছিলেন নেপাল। কেউ প্রয়োজনে কেউ আবার শুধুই ভ্রমণ বা ছুটি কাটাতে। নবদম্পত্তি আঁখি মনি ও তার স্বামী মিনহাজ বিন নাসিরের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি হলুদ আর ৩ মার্চ রিসিপশন হয় আঁখি মনি ও মিনহাজ বিন নাসিরের। জাঁকজমকপূর্ণ ওই অনুষ্ঠানের পর পরিবারের উদ্যোগে তাদের নেপালে হানিমুনে পাঠানো হয়। হানিমুনে যাওয়ার পর যে খবর পরিবার পায় তা শুধুই বেদনার। শুধু নব দম্পত্তিই নয় অবসর কাটাতেও কেউ কেউ যাত্রা করেন নেপালে। কিন্তু অবসরের ছুটি হয়ে পরিণতি পেল চিরদিনের ছুটিতে। ব্যাংক কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম ও অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব হাসান ইমাম অবসরের ছুটি কাটানোর উদ্দেশ্যেই নেপাল যাত্রা করেছিলেন। স্ত্রীসহ তারা গিয়েছিলেন। কিন্তু অবসর ভ্রমণ তাদের জন্য হয়ে গেল কাল। অবসর থেকে চিরবিদায় নিয়ে না ফেরার দেশে এখন তারা সবাই। নিহত নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের কর্মকর্তা ছিলেন। বছরখানেক আগে তিনি অবসরে যান। তার স্ত্রী আক্তারা বেগম ছিলেন রাজশাহী সরকারী মহিলা কলেজের শিক্ষিকা। তিনিও অবসরে যান মাস ছয়েক আগে। অবসর ভ্রমণ কাটাতে মূলত নেপালে যান তারা। অন্যদিকে, নিহত হাসান ইমাম সর্বশেষ ভূমি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ছিলেন। এর আগে তিনি শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক ছিলেন। তিন বছর আগে তিনিও অবসরে যান। তার স্ত্রী হুরন নাহার বিলকিস আরা নাটোরের গোপালপুর কলেজের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষিকা। তারা চারজনই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। একসাথে একই বিমানে সহযাত্রী হয়ে সবাই এখন একত্রে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) সহকারী অধ্যাপক ইমরানা কবির হাসি ও তার স্বামী একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী প্রকৌশলী রকিবুল হাসান যাচ্ছিলেন নেপাল। এর মধ্যে স্বামী রকিবুল মারা গেছেন। হাসপাতালে ভর্তি আছেন ইমরানা কবির হাসি। মৃত্যুর খবরে রকিবুল হাসানের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলায় বাঘুটিয়ার ইউনিয়নের পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। রকিবুল হাসান ঢাকায় একটি বেসরকারী সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করতেন। জানা গেছে, ১৫ দিনের ছুটি নিয়ে রকিবুল ও হাসি নেপালে বেড়াতে যাচ্ছিলেন। মৃত্যুর এই মিছিলে আছেন বৈশাখী টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার আহমেদ ফয়সাল (২৮)। নিহতের পরিবার সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। নিহত আহমেদ ফয়সাল শরীয়তপুরের ডামুড্যা পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ ডামুড্যা গ্রামের সামসুদ্দিন সরদারের ছেলে। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে ফয়সাল বড়। তিনি বৈশাখী টেলিভিশনের প্রধানমন্ত্রী বিটের সাংবাদিক ছিলেন। জানা গেছে, পাঁচ দিনের ছুটি নিয়ে ফয়সাল নেপালে বেড়াতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এর মধ্যেই বিমান বিধ্বস্ত হয়। এ ঘটনায় ফয়সালের বাড়িতে ও এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। এছাড়া রাজধানীতে কর্মরত সাংবাদিকরাও সহকর্মীর এমন খবরে শোকাহত। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজনের) সহযোগী সমন্বয়কারী ছিলেন সানজিদা হক। এই মৃত্যুর মিছিলে স্বামী ও সন্তানসহ নিহত হয়েছেন। সানজিদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোক প্রশাসন বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন। তাঁর স্বামী রফিক উজ জামান ঢাকায় প্রতিবন্ধীদের অধিকার বিষয়ক কর্মসূচীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন। একমাত্র ছেলে অনিরুদ্ধকে নিয়ে রাজধানীর শুক্রাবাদ এলাকায় থাকতেন তাঁরা। অনিরুদ্ধ রাজধানীর ধানমন্ডি গবর্মেন্ট বয়েজ স্কুলের ছাত্র ছিল। ছেলেকে নিয়ে নেপালে বেড়াতে যাচ্ছিল এই পরিবার। কয়েক দিন আগে মেডিকেল কলেজের চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষা শেষ করেছেন পিয়াস রায়। ফলাফল প্রকাশের আগে চলছে বিরতি। এই ফাঁকে একটু ঘুরতে নেপাল গিয়েছিলেন। হযরত শাহজালাল অন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিজের ছবি তুলে তা ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন। শিক্ষক মা-বাবার দুই সন্তানের মধ্যে পিয়াস বড়। বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার দাড়িয়াল ইউনিয়নের মধুকাঠি গ্রামের বাসিন্দা সুখেন্দু বিকাশ রায়ের ছেলে এই পিয়াস। পরিবার জুরে শুধুই কান্না। বিমান বিধ্বস্তে রানার অটোমোবাইলসের হেড অব সার্ভিস এস এম মাহমুদুর রহমানসহ আরও দুই দক্ষকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। এ তিন কর্মী হারিয়ে রানার পরিবারে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। নিহত তিন কর্মী হলেন- রানার অটোমোবাইলসের হেড অব সার্ভিস ও সিনিয়র ম্যানেজার (কাস্টমার কেয়ার) এস এম মাহমুদুর রহমান, এ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার মোঃ মতিউর রহমান ও জুনিয়র এ্যাসিসটেন্ট ফোরম্যান নুরুজ্জামান বাবু। তাদের বাড়ি যথাক্রমে ফরিদপুর, ফেনী ও পাবনা। ১৭ মার্চ ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটেই দেশে ফেরার কথা ছিল।
×