ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আমার মুক্তিযুদ্ধ -মোহাম্মদ আলী মিয়া

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ১৪ মার্চ ২০১৮

আমার মুক্তিযুদ্ধ -মোহাম্মদ আলী মিয়া

৯ অক্টোবর, ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে টেকনিক্যাল শাখায় শিক্ষানবিস হিসেবে যোগদান করি। আমাদের Training Institute করাচীর অদূরে পাক বিমান ঘাঁটি Training Institute-এ অবস্থিত ছিল। বিমানবাহিনীর ভাষা হলো ইংরেজী। তাই শিক্ষার মাধ্যম ছিল ইংরেজী। অন্য কোন ভাষায় কথা বলা বা শিক্ষা দেয়া নিষেধ। আমরা বাঙালী শিক্ষানবিসরা বরাবরই ইংরেজীতে ভাল ছিলাম। লক্ষ্য করলাম পাকিস্তানী শিক্ষকরা তাদের দেশীয় শিক্ষানবিসদের সঙ্গে পাঞ্জাবী, উর্দুতে শিক্ষা বিষয় নিয়ে আলোচনা করত। বাঙালী শিক্ষকরা ইংরেজীতেই আমাদের সঙ্গে আলোচনা করত। আমাদের কোন অসুবিধা হতো না। কিন্তু একটা বৈষম্য আমরা সর্বদা টের পেয়েছি। জনসংখ্যায় আমরা (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) বেশি হলেও সামরিক বাহিনীতে আমাদের সংখ্যা কম। এমনই আরও অনেক ক্ষেত্রে আমরা বঞ্চিত। রাজনৈতিক ইস্যুতে অনেক কিছু আসে। কিন্তু সামরিক বাহিনীতে নিয়মকানুন ও শৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে চলতে হয়। তাই মনে জেদ আসল, সংখ্যায় আমরা যা-ই হই মানে বা গুণে আমাদের তাদের চেয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এই সঙ্কল্প মনে নিয়ে শিক্ষা কোর্স চালিয়ে যেতে লাগলাম। প্রথম বর্ষেই ব্যাচে আমি সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করলাম। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষেও আমি একই ফলাফল লাভ করলাম। শেষ বর্ষে অর্থাৎ ৩ বছর ৩ মাস পর সমাপনী কুচকাওয়াজে (Apprentices Pass in out Parade) D.S.T (General Service Training), Trade, Education ৩টি শাখায়ই আমি সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষানবিস হিসেবে (All Round Best Trophy) চৌকস ট্রফি অর্জন করলাম। Pakistan TV, The Daily Morning News-এ ফলাও করে আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানের সংবাদ প্রচার হলো। আমার মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকা তৈরি হলো। পাকিস্তানীরা তাদের হিংসাত্মক মনোভাবও প্রকাশ করার কোন সুযোগ সেদিন পেল না। ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তান বিমানবাহিনী ঘাঁটি করাচী, ড্রিগ রোডে আমার পোস্টিং হয়। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান মনে গভীর রেখাপাত করে। কিন্তু সৈনিক জীবনের কঠোর শৃঙ্খলার ভেতর থেকে কিছুই করার ছিল না। ধৈর্যের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তানের খবরের কাগজগুলোতে ‘Landside Victory for Awami League কথাটি জোড়ালোভাবে শিরোনামে আসে। মনের দৃঢ়তা বেড়ে যায়। আমাদের অধিকারের কথা বলার সূবর্ণ সুযোগ আমরা পেতে যাচ্ছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার নামে পাকিস্তান সরকার গড়িমসি করতে থাকে এবং দুরভিসন্ধিতে ব্যস্ত থাকে। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ রাত ৮টায় প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর দোষ চাপাতে থাকে। আমরা তখন বিমান ঘাঁটির টিভি রুমে দাঁড়িয়ে ভাষণ শুনছিলাম। দীর্ঘ ৪৭ বছর পরও তার ভাষণের একটা বাক্য আমি ভুলি নাই। শেখ মুজিবুর রহমানকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘This crime cannot go unpunished.’ আমাদের বুঝ হয়ে গেল। আমরা যার যার ব্যারাকে ফিরে গেলাম। অধিক রাত পর্যন্ত জেগেছিলাম। শুনতে পেলাম কার্গো বিমান ঈ-১৩০ তে অনেক সৈন্য ভর্তি করে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্দেশে রওনা হচ্ছে। ওই কাল রাত্রিতে পূর্ব পাকিস্তানে কি ঘটেছে আমরা বুঝতে পারিনি। ২৬ মার্চ সকালে যখন যথারীতি রুটিন মাফিক আমরা প্যারেড গ্রাউন্ডে সমবেত হলাম, Base Commander তখন নির্দেশ দিলেন ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানীরা আলাদা হয়ে সারিতে দাঁড়িয়ে যাও।’ আমাদেরকে নিরস্ত্র (উরংধৎস) করা হলো। তখন হতে আমরা বাঙালীরা বিমান ঘাঁটির ব্যারাকেই অবস্থান করতে থাকলাম। ঘাঁটির ভেতরেই অডিটরিয়ামে আমাদেরকে দেশাত্মবোধক (পাকিস্তানী) ছবি, গান, ভাষণ, উপস্থাপন করে ব্যস্ত রাখত। গভীর রাতে আমরা কামরায় মশারি টাঙিয়ে গোপনে বিবিসির খবর শুনতাম এবং বাহিরে ২/১ জন বাঙালী ভাইকে পাহারায় রাখতাম। তারা কোন পাকিস্তানীকে হঠাৎ দেখলে আমাদেরকে যেন খবর দেয়। তারপরও বাস্তবে যা বাংলাদেশে ঘটেছে তার অনেক কিছুই জানতে পারতাম না। বিদ্রোহী মন সব সময় সেখান থেকে পালাতে তাড়া দিতে থাকে। সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় রইলাম। ইতোমধ্যে পাকিস্তান বিমানবাহিনী কর্তৃপক্ষ একটি Screening Board বসাল। প্রত্যেক বাঙালীকে এই বোর্ডের সম্মুখীন হতে হল। বিভিন্ন প্রশ্ন করা হলো সেখানে। আমার পরিবারের কেউ EPR বা Police-এ কর্মরত আছে কিনা। কারণ, ২৫ মার্চ রাতে ঊচজ, চড়ষরপব বাহিনীর সদস্যরাই প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনে কেউ যোগ দিয়েছে কিনা ইত্যাদি। যাচাইয়ের পর যাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকবে না তাদেরকে পাকিস্তানে Real Assets হিসাবে গণ্য করবে এবং চাইলে ছুটিতে যেতে পারবে। আল্লাহর রহমতে আমি বোর্ডের যাচাইয়ে টিকে গিয়েছিলাম। এই সুযোগটিকে হাতছাড়া করতে চাইনি। ১৯৭১ এর মে/জুনের দিকে আমার ছুটি মঞ্জুর হলো। ইতোমধ্যে কিছু বিমান সেনা ছুটিতে গিয়ে ফিরে আসেনি। আর কিছু কিছু পাকিস্তানী প্রেমিক/রাজাকার চরিত্রের বিমান সেনা পাকিস্তানী ঘাঁটিতে ফিরে এসেছে। শুনতে পেলাম পাকিস্তান থেকে বাঙালী প্রতিরক্ষা বাহিনীর লোকেরা ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়, তারপর কি হয় কেউ জানে না। যেদিন আমি পাকিস্তান থেকে রওনা হলাম সেই দিনই জাতিসংঘ পর্যবেক্ষণ দল ভাগ্যক্রমে একই বিমানে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করে। পাকিস্তানী সেনা ও বিমানবাহিনীর কড়া নজরের মধ্যেও পূর্ব পাকিস্তানে বিশেষ করে ঢাকায় সেদিন স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজমান দেখা যায়। শুকরিয়া আল্লাহ পাকের দরবারে এ কারণে যে, আমি এই সুযোগটি কাজে লাগিয়েছি। বিমান থেকে নেমে সেনা পাহারাদারদের নাকের ডগা দিয়ে দ্রুত গতিতে কেটে পড়লাম। আগে থেকেই আমার জন্য গাড়ি প্রস্তুত ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের একান্ত সাহায্যকারী আমার ছোট ভাই ডাঃ শওকত আলী আর ২/১ জন যুবক নিয়ে বিদ্যুতবেগে আমাকে নিয়ে উধাও হয়ে গেল। তাৎক্ষণিকভাবে লাগেজপত্র বাড়িতে রেখে মাতৃভূমিকে হানাদার মুক্ত করতে বর্ডার ক্রস করে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় চলে গেলাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে বর্ডার পার হওয়ার সময় এমবুশে পড়ে গিয়েছিলাম। বৃষ্টির মতো গুলি আসছিল। বর্ষা মৌসুম। একটা শ্যালো নৌকা নিয়ে কোন রকমে স্থলে পৌঁছলাম। আমার বয়স তখন ১৯ বছর। সেখানে বঙ্গবন্ধুর একান্ত ছাত্রনেতা আ স ম আব্দুর রবের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি আমাকে সূর্যমনি নগর ‘মিলিটারি হোল্ডিং ক্যাম্পে’ পাঠিয়ে দিলেন। এটা সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সেনাদের জন্য নির্ধারিত ক্যাম্প। এখানে সেনাবাহিনীর লোকের সংখ্যা বেশি। নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্য কম। হাতেগোনার মতো কয়েকজন। আমাদের ইক্যুইপমেন্ট ছিল না। বিমানবাহিনীতে ‘জেনারেল সার্ভিস ট্রেনিং’-এ যা শিখেছি তাই নিয়ে শত্রু মোকাবেলার জন্য মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম। তাই আমি স্থলযুদ্ধেই যোগদান করি। সময়মতো সদ্য ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অপারেশনে চলে যাই। কিছু দিনের মধ্যে বিমানবাহিনীর আরও কয়েকজনের সঙ্গে Military Holdign Camp-এ দেখা হয়। ২নং এবং ৩নং সেক্টরে আমি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। ডিসেম্বরে অর্থাৎ যুদ্ধ শেষের দিকে রূপগঞ্জ ও ডেমরা এলাকায় আমার কার্যকলাপ সীমিত থাকে। ৩নং সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল কেএম শফিউল্যার নির্দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল পিসি সোহানীর গাইড হিসেবে রূপগঞ্জ, ডেমরা ঢাকা অবধি আমি থাকি। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এর সন্ধ্যায় আমরা সবাইকে নিয়ে ঢাকা ঢুকে পড়ি। রেসকোর্স (সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে সমবেত হই এবং পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান উপভোগ করি। বিমানবাহিনীর সদস্য হয়ে ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যোগদান করতে পারায় আমি গর্বিত হই। ব্যথিত মনে বলতে হয়, মুক্তিযুদ্ধের পর ৪৭টি বছর কেটে গেল। অথচ ৩৪ বছর আমরা মুক্তিযোদ্ধারা চরম অবহেলিত ছিলাম। ১৯৭৫ এর বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ক্ষোভ ও ঘৃণায় আমি বিদেশে চলে যাই। বর্তমান সরকারের আমলে দেশে ফিরে আসি। বর্তমান সরকার আমাদের কল্যাণের জন্য সচেষ্ট রয়েছে এবং প্রতিনিয়ত মূল্যায়ন করছে। আমরা সেই জন্য কতৃজ্ঞ। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীও আমাদেরকে মূল্যায়ন করে। বিমানবাহিনী কর্তৃপক্ষ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিমানবাহিনী সদস্যদের দলিলপত্র (আমাদের রেকর্ড) সযত্নে সংরক্ষণ করছে। আমরা তাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। ১৯৭২ সালে বঙ্গববন্ধুই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ঘাঁটি বাশার পরিদর্শন করেন। গার্ড অব অনার প্রদানে আমি অংশগ্রহণ করি। বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর অবদানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। লেখক : প্রাক্তন কর্পোর‌্যাল এবং মুক্তিযোদ্ধা
×