প্রাচ্যের কবির ‘গীতাঞ্জলি’ হাতে আসার আগেই পাশ্চাত্যের ভিক্তোরিয়া ওকাম্পোর জীবনে ঘটে গেছে অনেক কিছু। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির প্রাক-পর্বের মানসিক যন্ত্রণা, সৃজনশীল বিকাশের জন্য নিজের প্রস্তুতি, টানা দশ বছর একই বাড়িতে স্বামী-স্ত্রীর অভিনয়ে ক্লান্ত হয়ে শেষে আলাদা বাড়িতে চলে যাওয়া। এই ব্যক্তিগত সঙ্কটে তাকে জীবনমুখী থাকতে সহায়তা করেছে প্রাচ্যের কবির ‘গীতাঞ্জলি’। এমনই এক সঙ্কটে অনেক কাল আগে সে কবির নতুন বৌঠান স্বেচ্ছায় পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। নিজের মর্মবেদনা প্রকাশের ভাষা থাকলেও পথ ছিল না তার। দু’জনার জন্ম কাছাকাছি সময়ে হলেও দেশ, সমাজ ও পরিবেশ ছিল আলাদা। কাদম্বরী দেবীর জন্ম ভারতে আঠারো শ’ একান্ন সালে আর ভিক্তোরিয়ার আর্জেন্টিনায় আঠারো শ’ নব্বইয়ে। ভারতের আঠারো শ’ আর আর্জেন্টিনার আঠারো শ’র মধ্যে পার্থক্য একজনকে আত্মঘাতী করেছে আরেকজনকে ঊননব্বই বছরের দীর্ঘ আয়ু দিয়ে সৃষ্টিশীল মানুষ বানিয়েছে। ইউরোপে শার্ল ফুরিয়ে যখন মানুষের মুক্তির জন্য সমাজ বদলের পথ খুঁজে বলছেন, নারী মুক্তি হচ্ছে সামাজিক ন্যায় বিচারের ব্যারোমিটার, আমাদের এ অঞ্চলে তখন চিতার আগুন থেকে নারীকে বাঁচাতে হাত বাড়িয়েছেন রামমোহন রায়ের মতো মানুষেরা। শার্ল ফুরিয়ের অনেক আগেই যদিও মেরি ওলস্টোন ক্রাফট ‘দি ভিন্ডিকেশন অফ দি রাইটস অব উইমেন’ লিখে গেছেন তবু ভিক্তোরিয়া ওকাম্পোদের পথও মসৃণ ছিল না মোটেই।
নারী যখনই মুক্ত চিন্তা নিয়ে এগিয়ে যেতে চেয়েছে তখনই সামাজিক সঙ্কীর্ণতা এসে পথ রোধ করেছে। আসলে শুধু নারী নয়, পুরুষও যখন সামাজিক পশ্চাৎপদতা ভেঙ্গে মানবিক ও যুক্তিনির্ভর আধুনিক দৃষ্টি নিয়ে এগোতে চেয়েছে, তাকে পায়ে পায়ে বাধা পেরোতে হয়েছে। নারীদের বেলা বাধার রূপটা আরও জটিল ও বিভিন্নমুখী। এই জটিলতার মূল রয়েছে অন্যখানে। সে কথা বলেছেন ফ্রেডরিক এঙ্গেলস আঠারো শ’ চুরাশি সালে, ‘পরিবার ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ বইয়ে।
চাওয়া-পাওয়ার সীমানা একবিন্দুতে মেলানোর জন্যই মানুষের যাবতীয় সংগ্রাম। জীবনময় যুদ্ধ, কখনও সরাসরি কখনও অন্তর্গত।
সরাসরি লড়াই এক সময় শেষ হয়, অন্তর্গত লড়াই চলতেই থাকে। এর অর্গল খুলতে বাইরের লড়াই অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এ অঞ্চলে সে লড়াই শুরু হয়েছিল সেই ঔপনিবেশিক আমলে। সময়ের স্রোতে গড়াতে গড়াতে গত শতকের পঞ্চাশের দশকে তা আবছা থেকে ক্রমশ স্পষ্ট আকার পেতে থাকে। ততদিনে ব্রিটিশরা এ অঞ্চল থেকে তাদের রাজ্যপাট গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। নতুন উপনিবেশ গড়ার স্বপ্ন কিংবা ষড়যন্ত্র নিয়ে যাদের ঘাড়ে চেপেছিল তাদেরও বিদায় সুর বেজে উঠেছে। অন্তর্গত লড়াইয়ের রূপও এ সময় থেকে ক্রমশ স্পষ্টতর হতে থাকে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী উপলব্ধি করে সংঘবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই। কারণ তাদের বঞ্চনার কথা কেউ বলে না, বলে না তাদের অবদানের কথা। ভিন দেশী বণিকরা রাজা সেজে পিতা, পিতামহ ও প্রপিতামহকে ঠকিয়েছে। সে কথা ইতিহাসে লেখা হয়েছে। কিন্তু তাদের বঞ্চনার কথা কেউ লেখেনি। পিতা নয়, প্রপিতা নয়, সন্তানও নয়। উপলব্ধি হয় নিজেদের পাওয়া বা না পাওয়ার কথা, কেবলই দিয়ে যাওয়ার কথা বলতে হবে নিজেদেরই। নয় মাস যুদ্ধ হলো। স্বাধীন ভূখ- মনের জোর বাড়িয়ে দেয়। আত্মপরিচয় খোঁজার রাস্তায় এতকাল খুঁড়িয়ে চললেও স্বাধীন দেশে হঠাৎই যেন আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে। বিশ্বাসে বাস্তবে সে এক অন্যরকম সময়। যুদ্ধে পরাজিত শত্রুরা চলে গেলেও বিভীষণ কিছু ঘাপটি মেরে রয়ে যায়। তারা চোরাবালির মতো গ্রাস করতে চায় স্বাধীন চলা। প্রাণপণ আঁকড়ে টেনে রাখে উল্টো দিকে, অন্ধকারের পথে, উন্নয়নশীল অনেক দেশের নারীর পক্ষে এই প্রেতছায়া মাড়িয়ে পুরোপুরি শক্ত পায়ে হাঁটা সম্ভব হচ্ছিল না। পথের বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করতে সহায়তার হাত বাড়ায় জাতিসংঘ গুরুত্বপূর্ণ কিছু সনদ অনুমোদন করে। সদস্য দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তাতে স্বাক্ষর করে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা করে নারী উন্নয়নকে আলাদা গুরুত্বে নেয়া হয়। নারীরা তখন অনেক পরিণত। নিজেদের ইস্যুতে নানা ধরনের কাজ করছেন। নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা অর্জন করলেও অন্য দেশের নারীদের সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই। অভিজ্ঞতা শেয়ারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। জানতে হবে বিশ্বের অন্যান্য নারীদের অবস্থা।
এক সঙ্গে বসার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল জাতিসংঘই, উনিশ শ’ পঁচাত্তর সালে মেক্সিকোতে প্রথম বিশ্ব নারী সম্মেলন ডেকে। তার আগে বছরটিকে বিশ্ব নারী বর্ষ ঘোষণা করেছিল ওই জাতিসংঘই। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সেই প্রথম পরিচয়। এ সংযোগে গুণগত অর্জন তেমন না হলেও আরেকটি সম্মেলনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করিয়েছিল। আশি সালে কোপেনহেগেনে দ্বিতীয়বারের মতো একত্রিত হয় বিশ্বের নারীরা পঁচাশি সালে, নাইরোবিতে।
তার আগের বছর বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘ সিডও সনদ অর্থাৎ নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদে স্বাক্ষর করে। অবশ্য এ স্বাক্ষর ছিল সনদের একটি ধারা ও তিনটি উপধারা বাদ দিয়ে, পরে উনিশ শ’ সাতানব্বই সালে দুটো উপধারা থেকে সংরক্ষণ তুলে নিলেও একটি ধারা ও একটি উপধারায় এখনও সংরক্ষণ রয়েছে। সাতানব্বই সালে প্রণীত হয় জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি। দু’বছর আগে পঁচানব্বই সালে বেজিংয়ে নারী উন্নয়নের প্লাটফর্ম ফর এ্যাকশন নেয়া হয়। পঁচানব্বইয়ের পর থেকে নারী বিষয়টি একটু একটু করে যেন রূপ বদলাতে থাকে। এ সময় থেকে নারী উন্নয়নকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এতে ক্রমশ ভাঙ্গতে থাকে নারী আন্দোলনের নিজস্বতা। কর্পোরেট অফিসের একঝাঁক পরিশীলিত স্মার্ট নারীকর্মী বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার একগুচ্ছ তরতাজা সম্ভাবনাময় নারী সাংবাদিক সমাজের প্রচলিত চেহারায় ধাক্কা দিয়েছে নিঃসন্দেহে। একটি মেয়ে কাজ শেষে রাত করে বাসায় ফিরবে সে বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। অফিস আদালতে নারীদের বিচরণ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। নারী পুলিশ, নারী স্থপতি, বৈমানিক ইত্যাদি সব পেশাতেই নারীর উজ্জ্বল অংশগ্রহণ বেড়েছে। প্রায় সব পেশাতেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করা নারীর সংখ্যাও নিছক কম নয়। লাভক্ষতির ঝুঁকি নেয়া পেশা ব্যবসাতেও সফল নারীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।
তবে এই সাফল্য ও দক্ষতার পাশাপাশি নির্যাতন ও সহিংসতার চিত্রও সমান তালে চলছে। কেন এ বৈপরিত্য? আজও এই চল্লিশ বছর পরও? এসিডে ঝলসে যাচ্ছে, ইভটিজিংয়ে বীভৎস ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে, হয়রানি, নিপীড়ন সমানতালে চলছে।
কেন? তাহলে কি বড় কোন গলদ রয়েছে কোথাও? গলদটা বোধহয় মানসিকতায়। ধর্ম ও শরিয়া আইনের দোহাই দিয়ে সিডও সনদের ১৬.১ (গ) এবং ২ নম্বর ধারায় এখনও সংরক্ষণ আরোপ রয়েছে। ১৬.১ (গ) ধারায় বিয়ে ও বিয়ে বিচ্ছেদে নারীকে পুরুষের সমান সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। সিডও সনদে স্বাক্ষর দেয়া বহু মুসলিম দেশে এ আইন কার্যকর করা হয়েছে। ধারা দুইয়ে সম্পত্তিতে সমানাধিকারের কথা বলা হয়েছে। এখানেও বাধা সেই শরিয়া আইন। সতেরো বছর আগে ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড বা অভিন্ন পারিবারিক আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছিল। কত সরকার এলো গেল আজও সেই খসড়া অনুমোদন পায়নি। কেন এমন হলো? আন্দোলনের সেই সক্রিয় রূপটি কি তাহলে ক্ষীণ হয়ে এসেছে?
যে দেশে সংবিধানের চার মূলনীতির অন্যতম ছিল সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতা, সে দেশের মানুষের বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার দিকে এগোনোর কথা। শুরুতে নারী আন্দোলনও সে পথে এগিয়েছে। বিপ্লবী রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে। শোষণমুক্ত সমাজে নারী-পুরুষ পাশাপাশি সম্মানজনক বসবাসের দিকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওই ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর বেশিরভাগ তাদের কমিটমেন্ট থেকে সরে গেছে নারী আন্দোলনও ক্রমশ আদর্শ বিচ্যুত হয়েছে।
অধিকার আদায়ের সেই সামগ্রিকতা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে মনে হয়। এখন সব কিছু ইস্যুভিত্তিক, প্রকল্পনির্ভর, প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ থাকে। তার হিসাব দিতে হয়। এ কাজে মেধা বা কমিটমেন্ট নয়, দক্ষতাই মূল বিবেচ্য। সারা পৃথিবীতেই এ অবস্থা চলছে।
গত দশ থেকে বিশ বছরে নারী আন্দোলন এক পা এগোলে দশ পা পিছিয়েছে। যে পথে যাওয়ার কথা ছিল তা থেকে বিচ্যুত হয়েছে। বিভ্রান্ত হচ্ছে নারী আন্দোলন। ইউরোপ দু’শ’ বছরে যা করেছে, আমরা বিশ বছরে তা অর্জন করেছিলাম। হঠাৎ করে পিছিয়ে যাচ্ছি যেন। নারী উন্নয়নের যেসব পূর্বশর্ত থাকলে নারীরা অগ্রসর হতে পারে এর সবই বাংলাদেশে আছে। এদিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ।
নারী ও পুরুষ শ্রমিকের মধ্যে উপার্জনের সাম্য এখনও আনা সম্ভব। সে বাস্তবতা বাংলাদেশে আছে। নারী অধিকারের কথা বলতে গিয়ে আমরা যেন সামগ্রিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ি সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আমরা রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চাই না। সরকারেরও অংশ হতে চাই। রাজনৈতিক দল যা না পারে, সরকার তা করতে পারে। সরকার গঠনের পর নারীরা যাতে কার্যকর অংশ নিতে পারে সে ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হবে।
নারী আন্দোলনকে মূলধারার আন্দোলনে থাকতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজজীবনের গুরুত্বপূর্ণ সব ইস্যুতে যুক্ত হতে না পারলে বিচ্ছিন্নতা ক্রমশ বাড়বে। শুধু নারীকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে বলেই নারী আন্দোলনে স্থবিরতা এসেছে। সামগ্রিকতার অংশ হতে হবে। সমঅংশীদারিত্বের কথা বললে, মেজর অংশে থাকতে হবে। বিচ্ছিন্ন ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনে সমাধান আসবে না। বৃত্তের বাইরে গিয়ে মূল ধারার সঙ্গে থাকতে হবে। কথা বলতে হবে সরাসরি তবেই সমান্তরাল চলার পথ মসৃণ হবে।
শীর্ষ সংবাদ: