ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আহত ২ শিশু ও ২ নারী ॥ ক্ষতি ৩০ কোটি টাকার মধ্যে ১০ কোটি নগদ টাকাও পুড়েছে

সর্বনাশা আগুনে মিরপুরে মোল্লা বস্তির ১০ হাজার ঘর পুড়ে ছাই

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১৩ মার্চ ২০১৮

 সর্বনাশা আগুনে মিরপুরে মোল্লা বস্তির ১০ হাজার ঘর পুড়ে ছাই

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সর্বনাশা ভয়াবহ আগুনে গৃহহীন হয়ে পড়েছেন অন্তত চল্লিশ হাজার বস্তিবাসী। তারা এখন খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছেন। আগুনে অন্তত দশ হাজার ঘর পুড়ে গেছে। কোন মালপত্রই আর অবশিষ্ট নেই। সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে গেছে। আগুনে প্রায় ৩০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যার মধ্যে অন্তত ১০ কোটি নগদ টাকা পুড়ে গেছে। দুই শিশু ও দুই নারী আহত হয়েছেন। টানা পাঁচ ঘণ্টা চেষ্টার পর সোমবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে। কোনমতে আগুনের গ্রাস থেকে রেহাই পেয়েছে অন্তত পাঁচ হাজার বস্তি ঘর। রবিবার রাত আড়াইটার দিকে রাজধানীর পল্লবী থানাধীন মিরপুর-১২ নম্বর সেকশনের সুজানগরে অবস্থিত মোল্লা বস্তিতে ভয়াবহ এ অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি ঘটে। বস্তিটি আশপাশের এলাকা থেকে অন্তত পাঁচ ফুট নিচু। বস্তিতে কথা হচ্ছিল সেখানকার বাসিন্দা মাদারীপুরের বাসিন্দা শেফালী বেগমের (৫০) সঙ্গে। বলছিলেন, ছেলে মেয়ে মিলিয়ে আমাদের চারটি পরিবার বস্তিটিতে বসবাস করি। আমি নিজেও বস্তিতেই থাকি। রাত আড়াইটার দিকে আচমকা আগুন আগুন বলে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শুনতে পাই। তাড়াহুড়া করে ঘর থেকে বের হই। দেখি বস্তির পশ্চিম দিকে আগুন। আগুনের লেলিহান শিখায় পুরো এলাকা আলোকিত হয়ে গেছে। প্রথমে মনে হচ্ছিল, বস্তি লাগোয়া পশ্চিম দিকে থাকা বিদ্যুত কেন্দ্রে আগুন লেগেছে। পরবর্তীতে দেখা যায়, আগুন পূর্ব দিকে আসছে। মাত্র ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পুরো বস্তিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ শুধু কোনমতে ঘর থেকে বের হতে পেরেছে। কিছু নেয়ার মতো কোন পরিস্থিতি ছিল না। সরু রাস্তায় রীতিমতো হুড়োহুড়ি লেগে যায়। কে কার আগে বের হতে পারবে। বস্তিটিতে যাতায়াতের মোট পাঁচটি রাস্তা আছে। রাস্তাগুলো চারদিকে। কোনমতে মানুষ গিয়ে রাস্তায় দাঁড়ায়। রাত চারটা পর্যন্ত আগুন জ্বলতে থাকে। ততক্ষণে আগুনে বস্তির প্রায় সব ঘর পুড়ে গেছে। ভোর চারটার দিকে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এসে আগুন নেভানো শুরু করে। যে পরিমাণ আগুন তাতে, পানি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছিল, পানিও পুড়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে দমকা হাওয়া পুরো বস্তিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশনস) মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজ ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের জানান, বস্তিতে আট থেকে দশ হাজারের মতো ঘর ছিল। আগুনে অধিকাংশই পুড়ে গেছে। বস্তিতে প্রবেশের বড় রাস্তা না থাকায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পৌঁছাতে এবং কাছাকাছি পানির উৎস না থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হয়েছে। স্থানীয় সরকার দলীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের বলেন, যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের সহায়তা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) শাহিদুজ্জামান জানান, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবারকে ৩০ কেজি করে চাল দেয়া হবে। ফায়ার সার্ভিসের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আতাউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, রাত চারটা থেকে ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভানো শুরু করে। বস্তির ভেতরে গাড়ি যাওয়ার মতো কোন রাস্তা নেই। এজন্য অনেক দূর থেকে পাইপ দিয়ে আগুন নেভাতে হয়েছে। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। অগ্নিকা-ের প্রকৃত কারণ জানা যায়। তা জানার চেষ্টা চলছে। প্রাথমিকভাবে গ্যাসের চুলা বা বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে অগ্নিকা-ের ঘটনাটি ঘটে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, পল্লবী সুজানগরের আবাসিক এলাকা থেকে বস্তিটি শুরু হয়েছে। বস্তিটির অস্তত দুই শতাধিক ঘর আবাসিক এলাকার মধ্যে। এরপর বস্তিটির আরেক অংশ আবাসিক এলাকা থেকে অন্তত পাঁচ ফুট নিচে অবস্থিত। এই বস্তিটিই সবচেয়ে বড়। এখানে হাজার হাজার বস্তিঘর। বস্তিটি লম্বা হয়ে পশ্চিম দিকে গিয়ে বিদ্যুত কেন্দ্র লাগোয়া ঝিল পর্যন্ত চলে গেছে। বস্তিটির মাঝখান বরাবর অন্তত দশ হাজার ঘর পুড়ে গেছে। বস্তিটিতে শুধু হাজার হাজার ইট সিমেন্ট আর রড দিয়ে তৈরি খুঁটি দাঁড়িয়ে আছে। আর সবই মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। বস্তির চারদিকে কিছু বাড়িঘর ছাড়া আর সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। চারদিকে টিন, পোড়া আসবাবপত্রসহ অন্যান্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ঘর বলতে কিছুই নেই। শত শত মানুষ আহাজারি করছেন। তাদের আহাজারিতে পুরো এলাকায় শোক বইছে। পুরো এলাকা ছাইয়ের কালো হয়ে আছে। সেখানকার বাসিন্দা আব্দুল কুদ্দুস (৬৭) বলছিলেন, আমি ১৯৭৪ সাল থেকে এখানে বসবাস করছি। আমাদের পাঁচ পরিবার এখানে বাস করি। সব পরিবারের ঘর পুড়ে গেছে। বস্তিটি প্রায় ৫০ একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে। সেখানে আগে ঝিল ছিল। বস্তিটিতে গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইন ছিল। প্রতিটি ঘরে বৈদ্যুতিক পাখা, খাট, আসবাবপত্র, অধিকাংশ ঘরেই ফ্রিজ ও টেলিভিশন ছিল। কমপক্ষে প্রতিটি ঘরে গড়ে অন্তত ২০ হাজার টাকার মালামাল ছিল। আর প্রতিটি ঘরের দুই থেকে তিন জন অন্তত গার্মেন্টেসে বা রিক্সা চালাত। অধিকাংশ গার্মেন্টেসের বেতন হয় মাসের ৬ থেকে ৭ তারিখের মধ্যে। বস্তিতে বসবাসকারী গার্মেন্টসে চাকরিজীবীদের অধিকাংশই বেতন পেয়েছিল। আর রিক্সাচালকরা রিক্সা চালিয়ে রোজগার করা টাকা বস্তির ঘরেই রাখেন। অনেকেই ঘরের ফ্লোর খুঁড়ে মাটির ভেতরে টাকা রাখেন। গড়ে প্রতিটি বস্তিঘরে অন্তত ১০ হাজার নগদ টাকা আর ২০ হাজার টাকার মালামাল মিলিয়ে অন্তত ৩০ হাজার টাকার মালামাল ছিল। সেই হিসাব অনুযায়ী অন্তত ১০ কোটি নগদ টাকাগুলো পুড়ে গেছে। আর ঘরের কোন মাল ব্যবহার করার মতো অবস্থায় নেই। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সবমিলিয়ে অন্তত ৩০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তিনি আরও বলছিলেন, প্রতিটি ঘরের ভাড়া গড়ে ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত। এসব টাকা সরকার দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য এখলাছ উদ্দিন মোল্লা, ইলিয়াছ মোল্লাদের পরিবার নিয়ে থাকে। ইলিয়াছ মোল্লা ও এখলাছ উদ্দিন মোল্লার ভাড়ার টাকার ভাগ পান। কারণ তারাই এসব জমির মালিক বলে শুনে আসছি। ইলিয়াছ মোল্লা ও এখলাছ উদ্দিন মোল্লাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন সোজাত আলী মোল্লা। তার নাম অনুসারে জায়গাটির নাম হয় সুজানগর। আর বস্তিটি গড়ে ওঠে মোল্লা পরিবারের জমির ওপর। এজন্য বস্তিটির নাম হয় মোল্লা বস্তি। যদিও জায়গার মূল মালিক নিয়ে অনেকেই বলছিলেন, পুরো জায়গা মোল্লা পরিবারের নয়। সরকারের জায়গাও আছে।
×