ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

২০৫০ সালে চায়ের চাহিদা হবে ২১২ মিলিয়ন কেজি;###;বড় বাগানের পক্ষে এই চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়

ক্ষুদ্র উৎপাদকরাই পারেন চা খাতের চিত্র পাল্টে দিতে

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ১৩ মার্চ ২০১৮

ক্ষুদ্র উৎপাদকরাই পারেন চা খাতের চিত্র পাল্টে দিতে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দেশে চায়ের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। ফলে স্বাধীনতার পর সাড়ে চার দশকে দেশে চায়ের উৎপাদন তিনগুণ বাড়লেও কয়েক বছর ধরে আমদানি করে মেটাতে হচ্ছে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা। বর্তমানে বছরে চায়ের উৎপাদন হচ্ছে গড়ে ৬৭ মিলিয়ন কেজি। আগামী ২০৫০ সালে কেবল অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে প্রয়োজন হবে ২১২ মিলিয়ন কেজি চায়ের। বিদ্যমান উৎপাদন ব্যবস্থায় বড় বাগানগুলোর পক্ষে চায়ের বর্ধিত চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। অথচ দেশীয় ক্ষুদ্র উৎপাদনকারীদের পক্ষে চা খাতের এই চিত্র পাল্টে দেয়া সম্ভব। অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি চা-কে আবার রফতানির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য আছে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের। এজন্য প্রয়োজন সরকারের কার্যকর পরিকল্পনা ও নীতি সহায়তা। প্রয়োজনীয় অর্থায়নের পাশাপাশি সহায়ক পরিবেশ পেলে ক্ষুদ্র চা চাষ আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচনেরও সুযোগ করে দেবে। সোমবার রাজধানীর ডেইলি স্টার সেন্টার মিলনায়তনে ‘ক্ষুদ্র চা উৎপাদনকারীদের মূল দল (কোর গ্রুপ) গঠন ও আলোচনা’ শীর্ষক এক কর্মশালায় এমন পরামর্শ ও মত তুলে ধরা হয়। উত্তরবঙ্গে ক্ষুদ্র চা চাষ সম্প্রসারণে নেয়া ‘ইক্যুয়ালি টি’ প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রেইড ক্রাফট এক্সচেঞ্জ ও উন্নয়ন সংগঠন বিকাশ বাংলাদেশ এ যৌথভাবে কর্মশালার আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন-১) রুহিদাস জদ্দার। কর্মশালায় ক্ষুদ্র চা চাষ ও এর উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দৈনিক জনকণ্ঠের নগর সম্পাদক ও ‘পলিসি চেঞ্জেস ফর স্মল স্কেল টি সেক্টর ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রকল্পের পরামর্শক কাওসার রহমান। কর্মশালার শুরুতে বক্তব্য রাখেন ট্রেইড ক্রাফট এক্সচেঞ্জের বাংলাদেশ কান্ট্রি ডিরেক্টর শাহেদ ফেরদৌস। এরপর ক্ষুদ্র চা চাষ সম্প্রসারণে নেয়া প্রকল্পের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন ট্রেইড ক্রাফট এক্সচেঞ্জের প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাবিলা নুসরাত। কর্মশালায় উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার ক্ষুদ্র চা উদ্যোক্তা, চা বাগান মালিক ও চা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা তাদের মতামত তুলে ধরেন। মূল প্রবন্ধে কাওসার রহমান বলেন, ক্ষুদ্র আকারে চা চাষের জন্য বাংলাদেশ টি বোর্ড ১ লাখ ১ হাজার ৭২৪ হেক্টর জমি চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে মাত্র ৬ হাজার হেক্টর জমি রয়েছে প্রচলিত চা বাগান এলাকায়। চাষযোগ্য বাকি জমিগুলো ক্ষুদ্র চা চাষের আওতায় আনা গেলে দেশে বছরে মোট চা উৎপাদন দাঁড়াবে ৫০২ মিলিয়ন কেজি। এই চা দিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়েও বছরে প্রায় ২৯০ মিলিয়ন কেজি চা রফতানি করা যাবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি দেশের নি¤œ আয়ের প্রায় ১১ লাখ মানুষের জীবনমান বদলে যাবে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নে পিছিয়ে থাকা উত্তরাঞ্চলে দারিদ্র্য বিমোচনের বড় সুযোগ এনে দিয়েছে ক্ষুদ্র চা চাষ। পাশাপাশি ক্ষুদ্র চা উৎপাদকরাই এ খাতের চালিকাশক্তি হিসেবে উঠে আসছেন। প্রচলিত চা উৎপাদন এলাকায় চাষ সম্প্রসারণের সীমাবদ্ধতা আছে এবং বাগানগুলোর উৎপাদনশীলতাও কমে গেছে। প্রচলিত বাগানগুলোর গড় উৎপাদন প্রতি হেক্টরে মাত্র ১ হাজার ২৭০ কেজি, যেখানে ক্ষুদ্র চা উদ্যোক্তরা উৎপাদন করছেন হেক্টর প্রতি গড়ে ৩-৪ হাজার কেজি। গবেষণায় দেখা গেছে, উত্তরবঙ্গে সাধারণ কৃষি কাজ করলে তাদের যে আয় হয়, চা চাষে তাদের আয় তার চেয়ে প্রায় ৩৭৫ শতাংশ বেশি। ক্ষুদ্র চা চাষের বিপুল এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সঠিক নীতি কাঠামো প্রণয়নের আহ্বান জানিয়ে কাওসার রহমান বলেন, চা শিল্পের উন্নয়নে সরকার ১৫ বছর মেয়াদী যে পথ নক্সা (রোড ম্যাপ) প্রণয়ন করেছে, তাতে ক্ষুদ্র চা উদ্যোক্তাদের বিষয়টি বাদ দেয়া হয়েছে। দেশে ক্ষুদ্র চা উদ্যোক্তা শ্রেণী গড়ে তুলতে হলে এ সংক্রান্ত সরকারের নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। এক্ষেত্রে জমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইনগত বাধ্যবাধকতা, স্বল্প সুদে ঋণ প্রাপ্তি ও সহজ শর্তের অর্থায়নের ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে ভারত, কেনিয়া ও শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতাও কাজে লাগানো যেতে পারে। ক্ষুদ্র চা চাষের বিকাশে সরকারী-বেসরকারী যৌথ উদ্যোগের ওপর গুরুত্বারোপ করে অতিরিক্ত সচিব রুহিদাস জদ্দার বলেন, চা, পাট এবং চামড়া এক সময় বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য ছিল। চাহিদা বাড়ায় বাংলাদেশ এখন চায়ের আমদানিকারক। বর্তমান পরিস্থিতি ক্ষুদ্র চা চাষীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। এজন্য ক্ষুদ্র চা চাষের সঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরকে কিভাবে যুক্ত করা যায় সেটি ভাবতে হবে। তিনি উত্তরবঙ্গে একটি চা কারখানা প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সহায়তার জন্য একটি তহবিল গঠনের প্রস্তাব সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে তুলে ধরবেন বলেও জানান। কর্মশালার উন্মুক্ত আলোচনা পর্বে ক্ষুদ্র চা চাষের মাধ্যমে নিজেদের দারিদ্র্যমুক্তির কথা তুলে ধরেন পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। পঞ্চগড়ের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা মোঃ ফরমান আলী বলেন, আগে জমিতে আখ চাষ করতাম। আখ বিক্রির সুযোগ পেতাম ১৮ মাসে একবার। সংসার চালাতে দিনমজুরিও করতে হতো। এখন একই জমিতে চা চাষ করি। এখন আমি স্বাবলম্বী। চা চাষ করে একইভাবে আত্মকর্মসংস্থানের কথা জানান বুধিরাম সিং ও জামাল উদ্দিন। ক্ষুদ্র চা চাষের বিকাশে তারা সমিতি পর্যায়ে সেচ পাম্প, স্প্রে মেশিন এবং ভর্তুকি সহায়তা দেয়ারও দাবি জানান। একই সঙ্গে চা পাতার ন্যায্য মূল্য যাতে দেয়া হয় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা কামনা করেন। গ্রিন কেয়ার এগ্রো লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. এএইচএম শফিকুর রহমান বলেন, চা পাতার দর মানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। চা পাতার গুণগত মান রক্ষার্থে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবে সবার আগে প্রয়োজন ক্ষুদ্র চা চাষ সহায়ক একটি কার্যকর নীতিমালার। বাংলাদেশ চা সংসদের ভাইস-চেয়ারম্যান শাহ আলম বলেন, চা-কে বিভিন্ন প্রকার কোমল পানীয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হবে। এজন্য উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি চা পাতার গুণগত মানের দিকেও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মনোযোগী হতে হবে।
×