ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কুড়িগ্রামে নিরীহ ছাত্রের কারাবাস, তদন্তকারী কর্মকর্তাকে শোকজ

প্রকাশিত: ০৪:৪৮, ১৩ মার্চ ২০১৮

কুড়িগ্রামে নিরীহ ছাত্রের কারাবাস, তদন্তকারী  কর্মকর্তাকে  শোকজ

স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম ॥ কুড়িগ্রাম অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এনামুল হক বসুনিয়ার রোষানলে পড়ে বিনা অপরাধে ৮দিনের কারাবাস করতে হলো হতদরিদ্র একাদশ শ্রেণীর ছাত্র আশেক আলী ওরফে বাবুকে। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় আদালতপাড়ায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। পুলিশের যোগসাজশে বিচারক গত ৫মার্চ তার খাস কামরায় ডেকে এনে ঐ শিক্ষার্থীকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও শারীরিক নির্যাতনের পর একটি গরু চুরির মামলায় সোপর্দ করে। আদালত তাকে জেলহাজতে প্রেরণ করে। সোমবার কুড়িগ্রাম সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মিজানুর রহমানের আদালতে জামিন শুনানি করেন বারের (আইনজীবী সমিতি) সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন। বিচারক জামিন মঞ্জুর করে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে এক দিনের সময় বেঁধে দিয়ে শোকজের আদেশ দেন। এছাড়া বিষয়টি নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের আবেদনটির শুনানি অন্তে আদেশ হবে মঙ্গলবার বলে জানা যায়। অনুসন্ধানে জানা যায়, গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার রামডাকুয়া গ্রামের মোসলেম উদ্দিনের পুত্র আশেক আলী ওরফে বাবুকে গরু চুরির মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয় পুলিশ। অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এনামুল হক বসুনিয়ার নির্দেশে এ তুঘলকী কারবার ঘটে। কথিত আসামি বাবুর পিতা মোসলেম উদ্দিন অভিযোগ করেন-গত ৩মার্চ বিকেলের দিকে উলিপুর উপজেলার বজরা এলাকায় তিস্তা নদীর ঘাটে যায় সুন্দরগঞ্জে নিজ বাড়িতে যাওয়ার জন্য উপস্থিত হয় কুড়িগ্রাম অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এনামুল হক বসুনিয়া। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন একজন অফিস স্টাফ। নদী পারাপার নিয়ে বচসাকে কেন্দ্র করে বিচারক এনামুল হক উলিপুর থানার অফিসার ইনচার্জকে নির্দেশ দেন ঐ ঘাটের ইজারাদারকে পরদিন তার চেম্বারে হাজির করার জন্য। রবিবার (৪/৩/১৮) সকাল সাড়ে ১০টায় ইজারাদার আকবর আলী তার খাস কামরায় উপস্থিত হলে তিনি অশালীন ভাষায় গালমন্দ করেন। পরে আকবর আলীকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় পরদিন ঘটনার দিন নৌকার মাঝি আশেক আলী বাবুকে হাজির করার শর্তে। সোমবার (০৪/০৩/১৮) বিকেল ৩টার দিকে উপস্থিত হলে আকবর আলী ও এ্যাডভোকেট কার্ত্তিক চন্দ্র দাসের উপস্থিতিতে বাবুকে গালমন্দ এবং পুলিশ ডেকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। একই সঙ্গে পুরাতন একটি চুরি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়। এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন বজরা নদী ঘাটের ইজারাদার আকবর আলী ও প্রত্যক্ষদর্শী এ্যাডভোকেট কার্ত্তিক চন্দ্র দাস। যে মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়-উলিপুর থানার মামলা নং-৩ তারিখ-০১/০১/১৮ইং। মামলার বাদী মোস্তাফিজার রহমান। মোস্তাফিজার রহমান গরু চুরির মামলায় তিন আসামির নাম উল্লেখ করলেও সেখানে বাবুর নাম ছিল না। কুড়িগ্রাম আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন জানান, কুড়িগ্রাম অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এনামুল হক বসুনিয়া ছাত্রজীবন থেকে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। বিচারক হিসেবে যোগদানের পর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কুটূক্তি করায় গাইবান্ধায় তার বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের নির্দেশে কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা ও দায়রা জাজ গোলাম মোর্শেদ বিষয়টি তদন্ত করেন। তিনি বাবু নামে নির্দোষ এক যুবককে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন-তিনি প্রকাশ্য আদালতে অযাচিত বিচারকার্য বর্জিত অতিকথন এবং অশালীন কথা বলেন। পছন্দ না হলেই বাদী-বিবাদীকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ আক্রমণাত্মক কথা বলেন। তুচ্ছ কারণে প্রকাশ্য আদালতে বাদী কখনও বিবাদীকে পিঠমোড়া করে হাতে হ্যান্ডকাপ পরাতে পুলিশকে বাধ্য করেন। এছাড়া অকারণে বিভিন্ন থানার পুলিশ অফিসারদের আদালতে ডেকে ভর্ৎসনা করেন। মহিলা আইনজীবী দেখলে অযাচিতভাবে ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলেন। যা অনেক সময় অসম্মানজনক অবস্থায় দাঁড়ায়। জনৈক এ্যাডভোকেট লিজাকে প্রকাশ্য আদালতে বলেন-‘বিচারক ও আইনজীবীর সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মতো।’ বেবী নামে একজন এ্যাডভোকেটকে প্রকাশ্য আদালতে তুমি বলে সম্মোধন করেন। অনেক বয়স্ক ব্যক্তিকে তুই- তোকারী করেন। এ্যাডভোকেট লিজা বলেন, ঘটনার পর থেকে ঐ আদালতে আমার খুব একটা যাওয়া হয় না। আর মহিলা মানুষ হিসেবে ঝামেলায় যেতে চাচ্ছি না। একজন সিনিয়র আইনজীবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই বিচারক নিজেকে সব সময় সৎ বলে দাম্ভিকতা দেখান। আইনত এ্যাডভোকেটরা কোর্টের অফিসার। অথচ তার কাছে কোন সম্মান নেই। বিচারকের যে গুণ থাকা দরকার তা হলো-‘বিনয়ী এবং কোর্টের ভাষা জানতে হবে। ব্যক্তিগত রাগ-অভিমান ও ক্ষোভের উর্ধে থাকতে হবে।’ তিনি আদালতে কারো স্বামী হতে চান, কাউকে বউ বানাতে চায় এবং তুই-তুমি বলে সম্মোধন করেন। উলিপুর থানার অফিসার ইনচার্জ এসকে আব্দুল্লাহ আল সাঈদ আদালতের বিষয় বলে এড়িয়ে যান। বলেন- আমি চাকরি করি সবই বোঝেন। মামলার এজাহারে উল্লেখিত বিষয়ের বাইরে আমার কোন বক্তব্য নেই। কুড়িগ্রাম আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং পাবলিক প্রসিকিউটর আব্রাহাম লিংকন এ ব্যাপারে মৌখিকভাবে অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, আইনের উর্ধে কেউ নয়। আমি আশা করি আনিত অভিযোগের বিষয়ে বিচার বিভাগ তার নিজস্ব প্রক্রিয়ায় তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অভিযুক্ত বিচারক অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এনামুল হক বসুনিয়ার বাড়ি গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ধমাইটারী গ্রামে। তিনি তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগগুলো অস্বীকার করে-নিজেকে সৎ ও সাচ্চা বিচারক হিসেবে দাবি করেন।
×