ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রী নিয়ে ফেঁসে যাচ্ছেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান

প্রকাশিত: ০৪:৪৫, ১৩ মার্চ ২০১৮

ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রী নিয়ে ফেঁসে যাচ্ছেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান

বিভাষ বাড়ৈ ॥ দুর্নীতি আর ‘ভুয়া পিএইচডি’ ডিগ্রী নিয়ে শেষ পর্যন্ত ফেঁসেই যাচ্ছেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান। ভুয়া প্রতিষ্ঠান থেকে ‘পিএইচডি’ ডিগ্রী কিনে নামের আগে ‘ড.’ বসিয়ে দাপটের সঙ্গে চললেও সনদ হালাল করতে পারছেন না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক তদন্তে ‘ভুয়া ডক্টরেট’ ডিগ্রীর প্রমাণ মিলেছে। একই সঙ্গে যোগদানের ৬ বছর আগের বিল ও সম্মানী ভুয়া ভাউচারে নেয়াসহ চেয়াম্যানের পুরো মেয়াদে ওঠা সকল আর্থিক অনিয়ম তদন্তে নেমেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশেষ তদন্ত কমিটি। সোমবার নতুন তদন্ত কমিটি আগারগাঁওয়ে কারিগরি বোর্ডে কাজ শুরু করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও তদন্ত কমিটির সদস্যরা জানিয়েছেন, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মোঃ মোস্তাফিজুর রহমানের ডক্টরেট ডিগ্রী যে ভুয়া তা প্রমাণিত হয়েছে। তাকে ইতোমধ্যেই নামের আগে ডক্টর না লেখাসহ অন্যান্য অনিয়মের বিষয়ে কঠোরভাবে শতর্ক করা হয়েছে। তারপরেও সে বেপারোয়া। এ অবস্থায় তার বিরুদ্ধে ওঠা অন্যান্য অনিয়ম দুর্নীতি খতিয়ে দেখার জন্য তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। পিএইচডি ডিগ্রীর ঘটনা তদন্ত করেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমন একজন যুগ্ম-সচিব সোমবার জনকণ্ঠকে বলেন, তার পিএইচডি ডিগ্রী ভুয়া অথচ এটা ব্যবহার করেই তিনি আজ চেয়ারম্যানের আসনে বসতে পেরেছেন। তদন্তে দেখা গেছে, চেয়ারম্যান ঢাকার কাকরাইলের একটি গলিতে অবৈধভাবে গজিয়ে ওঠা আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি নামের একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান থেকে পিএইচডি ডিগ্রী কিনেছেন। অথচ কোন প্রাইভেট ও বিদেশী প্রতিষ্ঠানের শাখার দেশে ডক্টরেট ডিগ্রী দেয়ার কোন সুযোাগ নেই। তদন্ত কমিটি ও সাংবাদিকদের কাছে চেয়ারম্যানের দেয়া বক্তব্যেও বেরিয়ে এসেছে ডক্টরেট কেলেঙ্কারির প্রমাণ। তদন্ত কমিটির কাছে মোস্তাফিজুর রহমান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেছেন, ‘আমি আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি থেকে অনলাইনে পিএইচডি করেছি। যার ক্যাম্পাস ছিল কাকরাইলে। কাকরাইলের সেই ক্যাম্পাস আছে কিনা জানতে চাওয়া হলে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, এখন সেই ক্যাম্পাস আর নেই। এখান থেকে যারা তথাকথিত পিএইচডি করে ডিগ্রী করে সনদ নিয়েছেন তাদের ডিগ্রী তো ভুয়া বা অবৈধ। তাহলে কেন আপনি করলেন ? এ বিষয়ে তিনি কথা বলতে রাজি হয়নি। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন জানিয়ে দিয়েছে, আমেরিকায় এ ধরনের অসংখ্য ইনস্টিটিউট রয়েছে যেগুলোকে সেখানে ব্রিফকেস বা এ্যাপার্টমেন্ট ইউনিভার্সিটি বলে। এগুলো অনলাইনে ডিগ্রী বিক্রি করে। বাংলাদেশে এই ধরনের ইউনিভার্সিটির শাখা বা এজেন্ট রয়েছে বলে জানা গেছে। ইউজিসির বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উপ-পরিচালক জেসমীন পারভীন জনকণ্ঠকে বলেন, এ ধরনের কোন প্রতিষ্ঠানের ডক্টরেট ডিগ্রী দেয়ার সুযোগ নেই। এসব বৈধ নয়। ইউজিসির কর্মকর্তারা এসব ভুয়া প্রতিষ্ঠানের তৎপরতা সম্পর্কে আরও বলেছেন, এসব এজেন্টদের কাছে যদি কোন ধরনের ডিগ্রী চাওয়া হয় তাহলে তারা আগে ডিগ্রীর দাম নির্ধারণ করবে, কি বিষয়ে ডিগ্রী দরকার এবং কতদিনের মধ্যে ডিগ্রী লাগবে তাও সে অনুসারে টাকা নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান ডিগ্রী দেয়। এমনকি যদি কারও বাড়িতে এসে ডিগ্রী দিয়ে যেতে হয় সেক্ষেত্রে বাড়তি ফি দিলে এসব প্রতিষ্ঠান ডিগ্রী দিয়ে দেবে। টাকার বিনিময়ে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে নেয়া সনদ কখনোই ব্যবহার করা যাবে না এবং এটা অবৈধ বলে উল্লেখ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি। এদিকে এ ঘটনা ছাড়াও এ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ওঠা নানা আর্থিক দুর্নীতি তদন্তে সোমবার থেকে মাঠে নেমেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। এ কমিটি ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রী কেনা, যোগদানের ৬ বছর আগের বিল ও সম্মানী ভুয়া ভাউচারে নেয়াসহ চেয়াম্যানের বিরুদ্ধে ওঠা অন্তত এক ডজন খানেক অভিযোগ তদন্ত করবে। সোমবার কারিগরি বোর্ডে প্রথম দিন পার করেছেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। কমিটির প্রধান ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব অজিত কুমান ঘোষ বলছিলেন, আমরা গিয়েছিলাম শিক্ষা বোর্ডে। তবে বিষয়টি বেশ বড় ও উদ্বেগজনক মনে হওয়ায় আরও ভালভাবে সদস্যরা স্টাডি করে কাজ শুরু করতে চাই। আমরা নিজেরা আগে বসছি। দেখা যাক। এখনই কিছু বলার মতো হয়নি। তবে আমরা ওনার (চেয়ারম্যান) বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ও উদ্বেগজনক বিষয়গুলো নিয়েই কাজ করব। এ কর্মকর্তা এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি। তবে কমিটির অপর এক সদস্য বলেছেন, চেয়ারম্যানের পিএইচডি ডিগ্রী যে ভুয়া তা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত। তার পরেও এর সঙ্গে কারা আছে, চেয়ারম্যানের নানা অনিয়মের তথ্য মিলেছে সব কিছু তদন্ত করা হবে। সম্প্রতি রাজশাহী সফর থেকে ফিরে অনেক লোকজনকে বিমান ভাড়াসহ খরচের টাকা দেয়ার প্রমাণ মিলেছে। এসব ঘটনা দেখা হচ্ছে। এছাড়া চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে যোগদানের ৬ বছর আগের বিল ও সম্মানী ভুয়া ভাউচারে নেয়ার প্রমাণ মিলেছে। ইতোমধ্যেই চেয়ারম্যানের সম্মানীর নামে অর্থ লোপাট ও জালিয়াতি করে শিক্ষার্থী পাস করানোর ঘটনা প্রমাণ মিলেছে। ২০১৫ সালের ১০ মার্চ বোর্ডে চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন ড. মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান। যোগ দিয়েই তিনি ভাউচার দিয়ে সম্মানী হিসেবে ২৫ লাখ ১৪ হাজার ৪০০ টাকা তুলে নেন বলে অভিযোগ ওঠে। পরে এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবদুল্লাহ আল হাসান চৌধুরীর নেতৃত্বে তদন্ত পরিচালিত হয়। এতে যোগদানের আগের সময়ে দায়িত্ব পালন বাবদ সম্মানী নেয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এ দিকে সোমবার এসব ঘটনা নিয়ে চেয়ারম্যানের সঙ্গে বহুবার দেখা করার চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। কর্মকর্তাদের কাছে পরিচয় দিলে তারা বলেন, স্যার কথা বলবে না। এরপর তার সেলফোনে অন্তত ১০বার কল ছাড়াও এসএমএস দিলেও সারা দেননি। ঘটনা নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের উপসচিব সুবোধ চন্দ্র ঢালী বলছিলেন, তার পিএইচডি ডিগ্রীর বিষয়ে ইতোমধ্যেই সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাকে ডক্টরেট ব্যবহার না করতে মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে। আরও বেশ কিছু বিষয় আছে সেগুলো তদন্ত করবে নতুন কমিটি।
×