ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সরেজমিন কুতুপালং ও বালুখালী ক্যাম্প পরিদর্শন

বিপন্ন রোহিঙ্গাদের সেবায় সেনা সদস্যরা

প্রকাশিত: ০৪:৪৪, ১৩ মার্চ ২০১৮

বিপন্ন রোহিঙ্গাদের সেবায় সেনা সদস্যরা

ফিরোজ মান্না, কক্সবাজার থেকে ॥ ‘মানুষ মানুষের জন্য জীবন জীবনের জন্য/একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না’। ভূপেন হাজারিকার এই গানটি রোহিঙ্গা শিবিরে দারুণভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। দিনরাত সেনা সদস্যরা শিবিরের নিরাপত্তা, ত্রাণ সহযোগিতায় কাজ করছেন। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভাষা বুঝতে কষ্ট হলেও তারা বিপন্ন মানুষের সুখে দুঃখে পাশে রয়েছেন। দেশ ছাড়া ঘর হারা মানুষের ওপর ছায়া হয়ে কাজ করছে। সোমবার সরেজমিন কুতুপালং ও বালুখালী ক্যাম্প ঘুরে এমন দৃশ্যই চোখে পড়েছে। ছয় মাস ধরে টানা রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরণে শৃঙ্খলা বজায় রেখে যাচ্ছে। গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে সেনা সদস্যরা প্রথম রোহিঙ্গা শিবিরে ত্রাণ বিতরণ, প্রাথমিক চিকিৎসা ও স্যানিটেশনের কাজে হাত দেয়। সেই ধারা এখনও চলমান। উখিয়া ডিগ্রী কলেজ সংলগ্ন এলাকায় জেলা প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ত্রাণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। এখানেই সরকারী-বেসরকারী সব সংস্থার দেয়া ত্রাণ জমা হয়। জমাকৃত ত্রাণ প্রতিদিন এখান থেকে ২১ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সেনা সদস্যদের তত্ত্বাবধানে পাঠানো হয়। কুতুপালংয়ে ৫ ক্যাম্প, ঘুংথুমে ৩টা, বালুখালিতে ২টা, হাকিমপাড়া, লেদা, ময়নারঘোনা, নয়াপাড়া, শামলারপুর, তাজনিমার খোলা, উনচিপ্রাং, জামতলি, সাবরাংয়ে সোমবার প্রতিজনের জন্য ১৫ কেজি করে চাল ডাল তেল লবণসহ নানা কিছু দেয়া হয়েছে। বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে এমন শৃঙ্খলায় ত্রাণ বিতরণ সত্যিই বিরল ঘটনা। কুতুপালং ক্যাম্পে কথা হলো মিয়ানমারের মংডু থানার বড়ছড়া গ্রামের অধিবাসী আব্দুল হাফেজের সঙ্গে। ভাই বোন মা বাবাসহ ১৪ জন জীবন নিয়ে কোন রকমের বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। এখন তারা কুতুপালং ক্যাম্পে রয়েছেন। হাফেজ বললেন, সেনা সদস্যরা যদি তাদের নিরাপত্তা না দিত তাহলে তারা এখানে থাকতে পারতেন না। প্রতিরাতে তাদের ওপর অত্যাচার হত। মেয়ে ছেলেরাও অনিরাপদ থাকত। এক অত্যাচার থেকে পালিয়ে এসে আরেক অত্যাচারের মধ্যে তাদের পড়তে হতো। চুরি ডাকাতি কিডন্যাপসহ নানা অপরাধ সংগঠিত হতো। এসব থেকে রক্ষা হয়েছে সেনা সদস্যদের কারণেই। ত্রাণ বিতরণে সুষ্ঠু ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। মিয়ানমার থেকে ১০ থেকে ১২ লাখ মানুষ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এত মানুষকে সামাল দেয়া কোনভাবেই সম্ভব হতো না, যদি সেনাবাহিনী কাজ না করত। রোহিঙ্গারা প্রথম যখন আসতে শুরু করে তখন কিছুটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করেছে। এটা গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলমান ছিল। এ অবস্থায় সরকারের নির্দেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শৃঙ্খলা ফেরাতে ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে কাজ শুরু করে। সেই থেকে চলছে রোহিঙ্গা শিবিরে সেনা সদস্যদের মানবতার কাজ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে যেমন বিশ্ব মানবতার দৃষ্টান্ত স্থান করেছেন। তেমনি রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সেনা সদস্যরা সেই মানবতা দেখাচ্ছেন। সেনা সদস্যরা আগে ত্রাণ বিতরণের কাজটিকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন। কেননা আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা যেভাবেই হোক উখিয়া ও টেকনাফের বন ভূমিতে ছোটখাটো করে হলেও একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছেন। তাদের এখন দরকার বেঁচে থাকার জন্য খাবার। প্রতিদিনই রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহযোগিতা আসছে দেশের নানাপ্রান্ত থেকে। বিদেশী সংস্থাগুলোও ত্রাণ দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন শত শত ত্রাণবাহী ট্রাক আসছে এখানে। টেকনাফ মহাসড়কের কুতুপালং থেকে থাইনখালী পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার এলাকা এক প্রকার ফাঁকা। এখন আর এই সড়কে কোন জ্যাম নেই। সেনা সদস্যরা কাজ শুরু করার আগে গোটা সড়কে শুধু মানুষ আর মানুষ। আবার ত্রাণ বোঝাই যানবাহন থেকে ত্রাণের প্যাকেট ছুড়ে মারার কারণে পুরো সড়ক জুড়ে এক বিশ্রী দৃশ্য লেগেই ছিল। সড়কের দুই ধারে ত্রাণের অপেক্ষায় ছিল লাখ লাখ রোহিঙ্গা। সেনাবাহিনী সদস্যরা মহাসড়কের যানবাহন নিয়ন্ত্রণে নামায় শহীদ এটিএম জাফর আলম আরাকান সড়ক (কক্সবাজার-টেকনাফ) স্বস্তি ফিরে আসে। রোহিঙ্গাদের ঢলে এলাকায় মানুষ আর মানুষ। ত্রাণের ট্রাক লুটে নেয়া হচ্ছিল। এই মানুষের ঢল সামাল দিয়ে তাদের হাতে ত্রাণ পৌঁছানোর মতো কঠিন কাজটি সেনা সদস্যরা দুইদিনের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। এমন কঠিন কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে সেনা সদস্যরা। মিয়ানমারের অমানবিক আচরণের মধ্য দিয়ে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিয়ে দেশী-বিদেশী নানা গোষ্ঠী শুরুতেই চক্রান্তে লিপ্ত হওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওই চক্রান্তও বাস্তবায়ন করতে পারেনি তারা। এখন বিশ্ব জনমত গড়ে উঠেছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পক্ষে। বিশ্বের অনেক দেশ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব কিছু সম্ভব হয়েছে বিপন্ন রোহিঙ্গাদের শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসা। এ কাজের জন্য সেনা সদস্যদের অবদান অপরিসীম। তারা দিনে রাতে ক্যাম্পগুলোতে টহল দিচ্ছে। ফলে কেউ কোন অপরাধ করার সুযোগ পাচ্ছে না। এ কারণে বিশ্বের অনেক নেতা রোহিঙ্গা শিবির ঘুরে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তারা রোহিঙ্গাদের জীবনমান উন্নয়নে অর্থসহ নানা দিক দিয়ে সাহায্য করছেন। মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করছেন রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে নিতে। সরকারের মানবিক দৃষ্টি যত দিন তারা নিজ দেশে না ফিরছেন ততদিন তাদের ভাল রাখা। এই ভাল রাখার দায়িত্বটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পালন করে যাচ্ছে।
×