ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাঁধাই খাতায় মুক্তিযুদ্ধ

একাত্তরের দিনগুলোর দেশী-বিদেশী খবর সযতনে লালন...

প্রকাশিত: ০৪:৪৩, ১৩ মার্চ ২০১৮

একাত্তরের দিনগুলোর দেশী-বিদেশী খবর সযতনে লালন...

সমুদ্র হক ॥ ব্যতিক্রমী সংগ্রহ তাঁর। প্রায় তিন শ’ পৃষ্ঠার একটি বাঁধাই খাতা। পাতাগুলো কিছুটা জীর্ণ। রংও কিছুটা পাল্টেছে। সেলাই থেকে কিছু পৃষ্ঠা আলগাও হয়েছে। সযতনে তিনি তা লালন করে চলেছেন- দিন, মাস, বছর যুগ ধরে..। আশা নিয়ে বেঁচে আছেন, একদিন এই সংগ্রহের মূল্য আসবে। মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোর খবরের প্রতিচ্ছবি তার খাতায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রতিদিন তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং বিদেশী বেতার কেন্দ্রের খবরগুলো লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন হাতে লিখে। তার নাম মোঃ শামসুল আলম। বয়স ৬৬ বছর পেরিয়েছে। বাড়ি বগুড়ার শেরপুরের গাড়িদহ (দশ মাইল) এলাকায়। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন যুবক। মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ তাঁর ধমনী শিরা কাঁপিয়ে তোলে। পরের দিন ওই ভাষণ বাংলাদেশ বেতারে (তখন রেডিও পাকিস্তান) প্রচার হওয়ার সময়ই তিনি তা শুনে খাতায় লিখেন। শুরু হলো খবর লিখার পালা। আকাশবাণী কলকাতা, ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (বিবিসি), ভয়েস অব আমেরিকার (ভিওএ) খবরগুলো শুনে তিনি প্রথমে সেদিনের এক্সারসাইজ খাতায় তারিখ ও সময় উল্লেখ করে লিখতে থাকেন। একটি খাতা ভরে গেলে আরেকটি খাতা....এভাবে লিখা ও খাতার সংখ্যা বাড়তে থাকে। এরই মধ্যে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাট যান। সেখান থেকে নিকটের ক্যাম্পে গিয়ে কিছুদিন ট্রেনিং নেয়ার পর গাবতলি এলাকার মুক্তিযোদ্ধা টিএম মুসা পেস্তা তাকে দেশে পাঠিয়ে দেন। দেশের ভিতর থেকেই তখন মুক্তিযুদ্ধ করেন। মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম না থাকায় তিনি আবেদন করেছেন অনেক আগে। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হওয়ার পরও কিছুদিন তিনি খবর লিখে রাখেন এবং যত্ন করে লিখার খাতাগুলো সংগ্রহ করেন। হারিয়ে যেতে পারে এই শঙ্কায় সবগুলো খাতার লিখা একটি ভলিউমে এনে বাঁধাই করে নেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার সঙ্গে থাকত ওই সময়ের ন্যাশনাল রেডিও। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর খবর শুনে লিখা শুরু করেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রচার শুরুর আগে আকাশবাণী কলকাতা, বিবিসি ও ভিওএর খবর শুনে লিখতেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রচার শুরুর পর তিনি এই কেন্দ্রের খবরও লিখা শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি দিনের খবর তার দিনলিপিতে ধরে রেখেছেন। কোন কোন খবর আজও মুখস্ত বলতে পারেন। দীর্ঘসময় এই খাতা তিনি আগলে রেখেছেন কেন! বললেন, এই সংগ্রহকে তিনি অমূল্য সম্পদ মনে করেন। সন্তানরা এই খাতা পড়ে অনেক কিছু জেনেছে। জীবন প্রান্তে পৌঁছে মনে হয়েছে এই লেখা বই আকারে প্রকাশ করা গেলে বর্তমান প্রজন্ম সেদিনের খবরের কথাগুলো শুনে উপকৃত হবে। কোন প্রকাশক উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে এলে তিনি সহযোগিতা করবেন। মোঃ শামসুল আলম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সোসিওলজিতে মাস্টার্স করার পর বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে (আরডিএ) তার কর্মজীবন শুরু। বছর দুই আগে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। স্ত্রী, এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। ছেলে প্রকৌশলী, মেয়ে আরডিএর একটি প্রকল্পে কর্মরত। তার পৈত্রিক বাড়ি বগুড়ার গাবতলি উপজেলার রামেশ্বরপুর গ্রামে। শেরপুরের গাড়িদহে তিনি থাকেন।
×