ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

ভারতে বিশাল ব্যাংক জালিয়াতি

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ১৩ মার্চ ২০১৮

ভারতে বিশাল ব্যাংক জালিয়াতি

এ বছরের জানুয়ারির প্রথম দিকে ভারতের পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের (পিএনপি) কর্মকর্তারা পলাতক হীড়ক ব্যবসায়ী নীরব মোদির (৪৭) একটা জালিয়াতির ঘটনা উদ্ঘাটন করেন। গোড়াতে সেই জালিয়াতির পরিমাণ হিসাব করা হয়েছিল ২৮০ কোটি রুপি। কর্মকর্তারা নীরবের ভাই বিশালকে মুম্বাইয়ের সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শাখায় ডাকেন। নীরব ভদ্র-নম্র হিসেবে পরিচিত। তাই আশা করা হয়েছিল এমন বৈশিষ্ট্য তার ছোট ভাইয়ের মধ্যেও পাওয়া যাবে। প্রাথমিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর মূল কথায় এসে কর্মকর্তারা যখন বলেন যে, নীরব ব্যাংক জালিয়াতি করেছে এবং এই অর্থ ফেরত দিতে হবে তখন নিশান উগ্র রূপ ধারণ করে তাদের বলেন, ‘যা খুশি করেন গে।’ পিএনবি কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর (সিবিআই) কাছে ঘটনাটি জানায়। ১৪ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ দাখিলের সময় জালিয়াতির লেনদেনের পরিমাণ ১৭৭ কোটি ডলার বা ১১ হজার কোটি রুপি ছাড়িয়ে যায়। এতে শেয়ার বাজারে আতঙ্ক সৃষ্টি হয় এবং ভারতের সরকারী খাতের ব্যাংকগুলোর কাজ-কারবারের ওপর দীর্ঘ কালো ছায়া পড়ে। বলাবাহুল্য, এসব ব্যাংক ৮ লাখ কোটিরও বেশি অনাদায়ী ঋণ নিয়ে নাস্তানাবুদ হয়ে চলেছে। আরও খারাপ কথা হলো, এই জালিয়াতির অংক আরও বড় হতে পারে। নতুন যে সব রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে তা থেকে মনে হয় ২০ হাজার কোটি রুপি জালিয়াতি করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু নীরবের কোম্পানি নয়, তার স্ত্রী অ্যামি, ভাই বিশাল, চাচা গীতাঞ্জলি জেমসের চেয়ারম্যান মেহুন চোকসির কোম্পানিও যুক্ত। এরা সবাই পলাতক এবং যুক্তরাষ্ট্রে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই কেলেঙ্কারি ফাঁসের মধ্য দিয়ে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ভয়ঙ্কর কিছু গোপন তথ্য সামনে চলে এসেছে। সেগুলো হলো- ব্যাংকিং কার্যক্রমে বিশাল বিশাল অনিয়ম, যাচাই-বাছাইয়ে দুর্বল ব্যবস্থাপনা, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার অভাব এবং অসৎ ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের একটি অশুভ চক্র যারা ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের প্রয়োজন উপযোগী করে আইনকানুন সুকৌশলে বদলে ফেলে। নীরবের জালিয়াতি নিয়ে মিডিয়া যখন বেশ সরগরম তখন আরও নতুন নতুন কেলেঙ্কারির তথ্য বেরিয়ে এসেছে। কলম প্রস্তুতকারক রোটোম্যাকের প্রমোটার বিক্রম মোটারির কথাই ধরা যাক। সিবিআইএর অভিযোগ, তিনি পিএসবির ৩৬৯৫ কোটি রুপি ঋণের অর্থ অপরিশোধিত রেখেছেন। ভারতীয় ব্যাংকগুলোর যেখানে ৯ হাজার কোটি রুপি পাওনা, সেখানে একটি পয়সাও পরিশোধ না করে পলাতক ব্যবসায়ী বিজয়ী মালন্য বেশ আরাম আয়াশে লন্ডনে দিন কাটাচ্ছেন। ঘটনাগুলো সরকারকে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। আর জনসাধারণ ভাবছে, প্রশাসনিক ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের অবস্থা এতই শোচনীয় যে, জালিয়াত ব্যবসায়ীরা প্রচলিত ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তাদের কষ্টার্জিত টাকা মেরে দিচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, এসব কেলেঙ্কারি সরকারের নাকের ডগায় ঘটতে পারল কি করে? কিভাবে নীরব মোদি এত বড় অঙ্কের অর্থ জালিয়াতি করে সেই ২০১১ সাল থেকে এত বছর গোপন রাখতে পারলেন? নীরবের কর্মকা- এভাবে পরিচালিত হয়েছিল। নীরবের ফার্ম-ডায়মন্ড আরইউএস, সোলার এক্সপোর্টস এবং স্টেলার ডায়মন্ডস পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাছে গিয়ে তাদের লেটার অব আন্ডারট্যাকিং বা এলওইউ ইস্যু করার অনুরোধ জানায়। এই এলওইউ তাদের অলঙ্কার তৈরির উদ্দেশ্যে মুক্তা ও হীড়ক আমদানির জন্য বিদেশে মূলধন সংগ্রহের সুযোগ দেবে। বিদেশে মূলধন সংগ্রহের খরচ অনেক কম। ভারতে যেখানে সুদের হার ১০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে সেখানে বিদেশে ঋণ নিতে গেলে সুদ দিতে হয় প্রায় সাড়ে তিন শতাংশ। একটা এলওইউ সাধারণত ৯০ দিনের জন্য ইস্যু হয়। তার অর্থ ক্লায়েন্ট (নীরব ও অন্যরা) খেলাপী হলে ঋণদানকারী ব্যাংকের পুরো অর্থ পরিশোধের গ্যারান্টি এলওইউ ইস্যুকারী ব্যাংককে (এক্ষেত্রে পিএনবি) দিতে হয়। অবশ্য প্রচলিত রেওয়াজ অনুযায়ী এলওইউ কোল্যাটারালের ভিত্তিতে দেয়া হয় যা সাধারণত দাঁড়ায় ঋণের মূল্যের ১০০ শতাংশ। কিন্তু এক্ষেত্রে পিএনবির কিছু কর্মকর্তা নীরব মোদির ফার্মগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজস করে কোল্যাটারাল ছাড়াই এলওইউ ইস্যু করে এবং সেটাও করে এক বছরের জন্য যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি নির্দেশনার লঙ্ঘন। পিএনবি তার নিজস্ব মূল ব্যাংকিং ব্যবস্থা সিবিএসকে পাশ কাটিয়ে এক্সিম ব্যাংক ও এলাহাবাদ ব্যাংকসহ বেশ কিছু ব্যাংকের বৈদেশিক শাখাকে সুইফটের মাধ্যমে বার্তা পাঠিয়ে দেয়। ‘সুইফট’ হলো বিশ্বব্যাপী নিরাপদ আর্থিক বার্তা সার্ভিসের প্রোভাইডার ‘সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশনের’ সংক্ষেপ। স্বাভাবিক অবস্থায় সিবিএসে বার্তা পাঠালে এসব লেনদেনের প্রতিফলন ঘটত। ভারতীয় ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক শাখাসমূহ পিএনবির ‘নস্ট্রো’ এ্যাকাউন্টে অর্থাৎ পিএনবির গ্রাহকদের জন্য বৈদেশিক অর্থ রাখার এ্যাকাউন্টে অর্থ স্থানান্তর করে। কিন্তু তারাও বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণীয় বিষয়গুলো উপেক্ষা করেছিল। পিএনবি এই অর্থ মোদি ও তার ফার্মগুলোকে প্রদান করে। কিন্তু ব্যবসাসংক্রান্ত ক্রয়ে অর্থায়নের জন্য এই অর্থ দেয়া হলেও তারা শুধুমাত্র আগের ঋণ পরিশোধের কাজেই তা ব্যয় করে। পিএনবি গত ১২ ফেব্রুয়ারি এক সতর্কতাসূচক নোটে ৩০টি ব্যাংককে তা জানিয়ে দেয়। এটাও এক ধরনের জালিয়াতি স্কিম। মোদির ফার্মগুলো আগের ঋণগুলোর মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়ে নতুন লেটার অব আন্ডারট্যাকিংয়ের জন্য আবেদন করে। এভাবে ঋণগুলো ‘এভারগ্রিনিং’ হতে থাকে। বছরের পর বছর ধরে এমনি ‘এভারগ্রিনিং’ হতে হতে তা স্ফীত হয়ে বিশাল অঙ্কের রূপ ধারণ করে। এক্ষেত্রে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ১১ হাজার কোটি রুপী। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সিবিআইএরে দায়ের করা এফআইআরএ বলা হয়, পিএনবিকে দিয়ে ১৪৩ লেটার অব আন্ডারট্যাকিং ইস্যু করিয়ে নিয়ে মোদি ও তার ফার্মগুলো শুধু ২০১৭-১৮ সালেই ৪৮৮৬ কোটির ওপর রুপি প্রতারণা করে হাতিয়ে নিয়েছে। পিএনবির যে শাখাটি এ ধরনের বৈদেশিক ঋণের বিষয়টি দেখে সেখানে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের রদবদল করার পরই কেবল এই প্রতারণার ঘটনা প্রকাশ পায়। মোদির ফার্মগুলো নতুন লেটার অব আন্ডারট্যাকিংয়ের জন্য পিএনবির কাছে গেলে তাদের প্রয়োজনীয় পরিমাণ কোল্যাটারাল দাখিল করতে বলা হয়। মোদির ফার্মগুলো তখন এই নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলে, আগেও তো এলওইউ ইস্যু করা হয়েছে। এ নিয়ে তো কোন ঝামেলা করা হয়নি। এতেই পিএনবিতে সতর্ক সঙ্কেত বেজে ওঠে। শুরু হয় অভ্যন্তরীণ তদন্ত। তাতে দেখা যায়, ব্যাংককে প্রতারিত করে ২৮০ কোটি রুপি হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে সিবিআই ৩১ জানুয়ারি মোদি, অ্যামি, নিশান ও চোকসির বিরুদ্ধে প্রতারণা এবং কয়েকজন পিএনবি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র ও জনসেবকদের সরকারী পদমর্যাদার অপব্যবহারের অভিযোগ এনে এফআইআর দায়ের করে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পিএনবি আগের হিসাবে সংশোধন করে জানায় যে, প্রতারণা করে হাতিয়ে নেয়া অর্থের পরিমাণ ১১ হাজার ৪শ’ কোটি রুপি। তাতে পিএনবির শেয়ারের মূল্যে ধষ নামে। ১৭ ফেব্রুয়ারি সিবিআই শেট্টি ও খারাতকে এবং মোদি ও তার স্বজনদের পরিচালিত কোম্পানিগুলোর অনুমোদনপ্রাপ্ত স্বাক্ষরদাতা হিমান্ত ভাটকে গ্রেফতার করে। তাদের ১৪ মার্চ পর্যন্ত সিবিআই হেফাজতে পাঠানো হয়। একই দিন তিনজন ব্যাংক কর্মকর্তাকেও গ্রেফতার করা হয়। তিন দিন পর গ্রেফতার করা হয় নীরবের ফায়ার স্টার ডায়মন্ডের সিএফ ও বিপুল আম্বানিকে। এর আগের দিন মোদি ও চোকসি উভয়ের পাসপোর্ট সাময়িকভাবে বাতিল করা হয়। সিবিআই মোদি ও তার পরিবারকে খুঁজে বের করার জন্য ইন্টারপোলের সাহায্য কামনা করে। গোটা জালিয়াতির ব্যাপারে গুটিকয়েক জুনিয়র অফিসার জড়িত ছিল ব্যাপারটা এমন নয়। তারা বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করেনি বরং এমন এক ব্যাংকিং নেটওয়ার্কের মধ্যে কাজ করেছে সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যাচাই ও ভারসাম্যের বেশ কয়েকটি স্তর আছে। সুতরাং বলা চলে এই পচন আরও গভীর পর্যন্ত গিয়েছিল। নস্ট্রো এ্যাকাউন্টের লেনদেন পিএনবির মূল ব্যাংকিং ব্যবস্থায় প্রতিফলিত যে হয়নি, তা থেকেই এই পচনের মাত্রা বোঝা যায়। এত বিশাল আকারের প্রতারণা ব্যাংকের বেশ কিছু শীর্ষ কর্মকর্তার যোগসাজশ ছাড়া সংঘটিত হতে পারে না বলে ব্যাংক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ক্লায়েন্ট যখন বিশাল অঙ্কের অর্থ সংগ্রহের জন্য এলওইউ ইস্যু করার অনুরোধ জানিয়েছিল তখনই ব্যাংকে সতর্ক সঙ্কেত বেজে ওঠা উচিত ছিল। তা ছাড়া এলওইউ ইস্যু করার মতো এত স্পর্শকাতর একটা পদে একজন অফিসার টানা ৭ বছর ছিলেন কিভাবে? এমন স্পর্শকাতর পদগুলো থেকে তো তিন বছর অন্তর বদলি হয়ে যাওয়ার কথা। কোল্যাটারাল বা ব্যাংক গ্যারান্টি ছাড়া এলওইউ ইস্যু এক বড় ধরনের অয়িম ও বিচ্যুতি। সুইফট বার্তা পাঠানোর জন্য তিন ব্যক্তির পৃথক পৃথক পাসওয়ার্ড-প্রোটেক্টেড একসেস ছিল। অথচ দেখা যায় অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের একজনের এই তিনটি পাসওয়ার্ডের সবই জানা ছিল। সুইফটের বার্তা কেবলমাত্র দু’জনই পাঠিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তাছাড়া সুইফটের মাধ্যমে লেনদেন পিএনবির মূল ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণও ছিল না। ১১ হাজার কোটি রুপির ওপর এই বিপুল অঙ্কের নস্ট্রো লেনদেনের কোনটার ক্ষেত্রেই রেড এ্যালার্ট দেখানো হয়নি। ব্যাংকের হিসাবনিরীক্ষকদের লেনদেন পরীক্ষা করে দেখার কথা। ব্যাংক ম্যানেজাদের সুইফট লেনদেনের রেজিস্টার পর্যালোচনার কথা। ব্যাংকের ইস্যুকৃত এলওইউ প্রতি তিন মাস অন্তর রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ায় পাঠানোর কথা। এসব প্রক্রিয়ার সবই উপেক্ষিত হয়েছিল। ব্যাংকের অপারেশনাল রিস্ক টিমও বহু বছর এই জালিয়াতির কোন হদিস পায়নি। এ সব কিছুই ব্যাংকিং ব্যবস্থার গভীরে পচনের ইঙ্গিত বহন করে। সূত্র : ইন্ডিয়া টুডে
×