ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

৫ বছরেও মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ হয়নি

বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ জালিয়াতি হোতারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে

প্রকাশিত: ০৪:১১, ১২ মার্চ ২০১৮

বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ জালিয়াতি হোতারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বিসমিল্লাহ গ্রুপের প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি, মানি লন্ডারিং ও দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের করা ১২ মামলায় মূল হোতারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এ মামলার আসামিদের কেউ কেউ এখনও ব্যাংকের চাকরিতে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। আবার কেউ বা পদোন্নতিও পেয়েছেন। তবে বিগত ৫ বছরেও এ মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ হয়নি। বড় ঋণ জালিয়াতির হোতারা এখন অধরা। সূত্র জানায়, বিসমিল্লাহ গ্রুপ জনতা ব্যাংক ভবন কর্পোরেট শাখা থেকে ফান্ডেড ৩০৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ও নন ফান্ডেড ২৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা, মগবাজার শাখা থেকে ১৭৭ কোটি ১০ লাখ ফান্ডেড ও নন ফান্ডেড এক কোটি ৬০ লাখ টাকা এবং এলিফ্যান্ট রোড শাখা থেকে ফান্ডেড ১৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা আত্মসাত করে। এ ছাড়া প্রাইম ব্যাংক মতিঝিল শাখা থেকে ফান্ডেড ২৬৫ কোটি ৪০ লাখ ও নন ফান্ডেড টাকা ৬১ কোটি ৮ লাখ, প্রিমিয়ার ব্যাংক মতিঝিল শাখা থেকে ফান্ডেড ২৩ কোটি ২২ লাখ ও নন ফান্ডেড ৩৯ কোটি ৩১ লাখ টাকা, যমুনা ব্যাংক লিমিটেডের দিলকুশা শাখা থেকে ফান্ডেড ১০৮ কোটি ৪৪ লাখ ও নন ফান্ডেড ৪৬ কোটি দুই লাখ টাকা এবং শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের ইস্কাটন শাখা থেকে ৯৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা ফান্ডেড ও ১০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা নন ফান্ডেড হিসেবে অর্থ আত্মসাত করে। ২০১৩ সালের ৩ নবেম্বরে দায়ের করা এসব মামলায় আসামি করা হয় গ্রুপটির এমডি খাজা সোলেমান আনোয়ার চৌধুরী, চেয়ারম্যান নওরিন হাসিব, প্রাইম ব্যাংকের ডিএমডি মোঃ ইয়াছিন আলীসহ ৫৪ জনকে। এদের মধ্যে গ্রুপের এমডি, চেয়ারম্যানসহ ১৩ জনকে সবকটি মামলার আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে অন্য ৪১ জন বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকের তিনটি শাখার ১২ জন, প্রাইম ব্যাংকের ৯ জন, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ৭ জন, যমুনা ব্যাংকের ৫ জন এবং শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ৮ কর্মকর্তা রয়েছেন। দুদকের দায়ের করা মামলায় বিসমিল্লাহ গ্রুপের এমডি খাজা সোলেমান ও চেয়ারম্যান নওরিন হাসিব ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন- এমডির বাবা সফিকুল আনোয়ার চৌধুরী ও মা সারোয়ার জাহান, বিসমিল্লাহ গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান মেসার্স হিন্দল ওয়ালী টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের পরিচালক। এ ছাড়া আসামির তালিকায় আছেন, গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) আবুল হোসেন চৌধুরী এবং তিন পরিচালক আবিদা হাসিব, নাহিদ আনোয়ার খান, খন্দকার মোঃ মইনুদ্দিন আশরাফ, উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি ও অথরাইজড সিগনেটরি) আকবর আজিজ মুতাক্কি, মহাব্যবস্থাপক (জিএম ও অথরাইজড সিগনেটরি) মোঃ আবুল হোসাইন চৌধুরী, ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার ও অথরাইজড সিগনেটরি) রিয়াজউদ্দিন আহম্মেদ, নেটওয়ার্ক ফ্রেইট সিস্টেম লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোঃ আক্তার হোসেন, টিডব্লিউ এক্সপ্রেসের মালিক মোঃ মঈন উদ্দিন এবং বে ইয়ার্ন লিমিটেডের মালিক গোলাম মহিউদ্দিন আহম্মেদ। এদের মধ্যে খাজা সোলেমান ও তার স্ত্রী নওরীন হাবিব দুবাইয়ে, আবুল হোসেন মালয়েশিয়ায় ও মইনউদ্দিন জার্মানিতে রয়েছেন। বাকি আসামিরা দেশেই পলাতক রয়েছে। মামলায় জনতা ব্যাংকের তিনটি শাখার ১২ জন আসামির মধ্যে রয়েছেন জনতা ব্যাংক ভবন কর্পোরেট শাখার মহাব্যবস্থাপক ও শাখা ব্যবস্থাপক আবদুস সালাম আজাদ, একই শাখার ডিজিএম আজমুল হক, উপ-মহাব্যবস্থাপক এসএম আবু হেনা মোস্তফা কামাল, দুই এজিএম (রফতানি) অজয় কুমার ঘোষ ও ফায়েজুর রহমান ভুইয়া, রফতানি বিভাগের কর্মকর্তা জেসমিন আক্তার, জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা (এসইও) সৈয়দ জয়নাল আবেদীন, জনতা ব্যাংক মগবাজার শাখার ম্যানেজার রফিকুল আলম, দুই এসইও খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও আতিকুর রহমান, ব্যাংকটির এলিফ্যান্ট রোড শাখার সহকারী মহাব্যবস্থাপক মোস্তাক আহমদ খান এবং এসইও এসএম শোয়েব-উল-কবীর। এদিকে, জনতা ব্যাংক ভবন কর্পোরেট শাখার মহাব্যবস্থাপক ও শাখা ব্যবস্থাপক আবদুস সালাম আজাদ বিসমিল্লাহ গ্রুপের এই ঋণের অনুমোদনের জন্য প্রস্তাব এবং স্বাক্ষর করেছেন। অথচ তিনি আসামি হওয়ার পরই ব্যাংকে বহাল আছেন এবং পদোন্নতি পেয়ে ব্যাংকটির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। মামলায় আসামির তালিকায় প্রাইম ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন ব্যাংটির ডিএমডি মোঃ ইয়াছিন আলী, মতিঝিল শাখার দুই সাবেক ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার) মোঃ মোজাম্মেল হোসেন ও খোন্দকার ইকবাল হোসেন, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট (এসভিপি) ও ফরেন এক্সচেঞ্জের ইনচার্জ ইব্রাহিম হোসেন গাজী, দুই এ্যাসিস্টেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট (এভিপি) এবিএম শাহ জাহান ও কাজী খাইরুল ইসলাম, তিন সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার মোহাম্মদ ইকবাল আজিম কাদরী, মোঃ আবুল কালাম এবং একেএম জান-ই আলম। প্রিমিয়ার ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে মামলার আসামিরা হলেন- মতিঝিল শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার) মুহাম্মদ শাহীনুর রহমান, সাবেক সহকারী ব্যবস্থাপক (ডেপুটি ম্যানেজার) জিএম শাহাদৎ হোসেন, এফএভিপি (ফার্স্ট এ্যাসিস্টেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট) এমএ রহীম, ভিপি ও ডেপুটি ম্যানেজার শাহাবুদ্দিন সরদার, এফএভিপি (বর্তমানে বরখাস্ত) তানজিবুল আলম ও সাবেক এক্সিকিউটিভ অফিসার আবু সালেহ মোঃ আরিফুর রহমান। যমুনা ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন সাবেক ডিএমডি মোজাম্মেল হোসেন, দিলকুশা শাখার চার এসইভিপি রফিকুল হাসান, মুহম্মদ মোর্শেদুর রহমান, এসএম জাহিদুল ইসলাম এবং এএসএম মাশুক। আর শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন ইস্কাটন শাখার ভাইস প্রেসিডেন্ট ও শাখা ব্যবস্থাপক মোঃ আসলামুল হক, সাবেক ডেপুটি ম্যানেজার এএসএম হাসানুল কবীর, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার শহীদুল ইসলাম, জুনিয়র এ্যাসিস্টেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মান্নাতুল মওলা, সাবেক এসইভিপি মোহাম্মদ গোলাম ওহাব, এফএভিপি মোঃ মুনির হোসেন, এসভিপি মোঃ দুলাল হোসেন এবং এসইভিপি মোঃ আনিসুল কবির। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ব্যাংক কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারের কথা জানিয়েছে দুদক। তবে অন্য আর্থিক কেলেঙ্কারির মতো এ ঘটনায়ও জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও অর্থ উদ্ধার সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন সময়ের আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয় পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মামলায় গ্রেফতার, সাময়িক বরখাস্ত কিংবা চাকরিচ্যুত হলেও লাভবান হন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আদালতের রায়ে আত্মসাত হওয়া অর্থ ফেরত পাওয়া না গেলে সম্পদ বাজেয়াফত করারও নির্দেশ থাকে। অধিকাংশ মামলায় দেখা যায়, আত্মসাতকৃত অর্থ ফেরত না দিলে সাজা খাটতে হয় অপরাধী কর্মকর্তাকে। সম্পদ বাজেয়াফত করার নির্দেশ থাকলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার নিজের নামে করা সম্পদ খুঁজে পাওয়া যায় না। যেটুকু পাওয়া যায় তা আত্মসাতকৃত অর্থের তুলনায় খুবই নগণ্য। সে কারণে লোভী কর্মকর্তারা টাকা মেরে দিয়ে গ্রেফতার হলে অনেকটাই বেঁচে যান বলে মনে করেন তারা। যেমন পাওয়া সম্ভব নয় বিসমিল্লাহ গ্রুপের নামে আত্মসাত করা টাকা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জেলে রয়েছেন। চূড়ান্ত রায়ে সাজা হলেও এক সময় ঠিকই বেরিয়ে আসবেন এটা তাদের বিশ্বাস। কারণ অর্থ আত্মসাতের মামলায় ফাঁসি তো আর হবে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিসমিল্লাহ গ্রুপের মামলা পরিচালনাকারী দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, আামাদের দেশের বেশিরভাগ আর্থিক খাতের ক্রিমিনাল কেসগুলো অর্থঋণ আদালতে মামলা হয়। ফলে মামলা নিষ্পত্তি করতে করতে ১০ টাকার জিনিসের মূল্য ১ টাকায় নেমে আসে। তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলো আদালতে মামলা দায়ের করেই খালাস হয়। অথচ সরকারের সম্পত্তি, জনগণের গচ্ছিত অর্থ উদ্ধারে তাদের আর কোন মাথা ব্যথা থাকে না। আবার দুদক মামলা হাতে পেয়েই বিচারের পেছনে দৌড়ায়। অর্থাৎ বিড়ালের গলায় ঘণ্টা কেউ বাঁধে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কঠিন ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকার ও জনগণের টাকা উদ্ধারে প্রয়োজনে ওই সব প্রতিষ্ঠানের কারখানাগুলোতে রিসিভার নিয়োগ দিয়ে কারখানা চালু রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
×