ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পাকিস্তান গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ১২ মার্চ ২০১৮

পাকিস্তান গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন

১৯৪৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই অধিবেশনে উত্থাপিত প্রস্তাব এবং এ সম্পর্কিত আলোচনা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমগ্র পাকিস্তানে বিশেষ করে পূর্ববাংলার কোন কোন গণপরিষদ সদস্য রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে এবং বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল তাও জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। পূর্ববাংলার কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত কংগ্রেসদলীয় গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এই অধিবেশনেই সর্বপ্রথম উর্দু ও ইংরেজীর পাশাপাশি বাংলাকেও পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর প্রস্তাব উত্থাপন করে সংসদে বলেন, ‘মি. প্রেসিডেন্ট, এ কথা আমি জানি বাংলা একটি প্রাদেশিক ভাষা। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রের কথা যদি আমরা চিন্তা করি তাহা হইলে দেখিব যে, রাষ্ট্রের অধিকাংশ অধিবাসীর ভাষা হইতেছে বাংলা। কাজেই প্রাদেশিক হইলেও যেহেতু রাষ্ট্রের অধিকাংশ অধিবাসীর ভাষা বাংলা, সেই কারণে বাংলা ভিন্ন মর্যাদার দাবিদার। রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার ৬ কোটি ৯০ লাখ অধিবাসীর মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখ অধিবাসী বাংলা বলে। এই যদি অবস্থা হয় তাহা হলে রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ভাষা কী হওয়া উচিত?.. আমাদের ৪ কোটি ৪০ লাখ মানুষ এই সংসদের কার্যবিবরণীর কিছু বুঝিতে অক্ষম। কারণ যে ভাষাতে ইহা পরিচালিত হয় সে ভাষা তাহাদের অজানা। ২৯নং রুলে ইংরেজীর সম্মানজনক উল্লেখ রহিয়াছে।.. তাই যদি হয়, ২৯নং রুলে যদি লিখিত থাকিতে পারে যে সংসদের কার্যবিবরণী উর্দু অথবা ইংরেজীতে পরিচালিত হইবে, তাহা হইলে ৪ কোটি ৪০ লাখ লোকের মুখের ভাষার একটি সম্মানজনক উল্লেখ রুল নং২৯-এ কেন থাকিতে পারিবে না? মি. প্রেসিডেন্ট, আমি তাই আমার এই প্রস্তাব দ্বারা লাখ লাখ মানুষের মনের অনুভূতিকেই প্রকাশ করিতেছি এবং সে কারণেই আমাদের রাষ্ট্রে ‘বাংলা’একটি প্রাদেশিক ভাষা নয়। বাংলা ভাষাকে ‘রাষ্ট্রের’ ভাষা হিসেবে মর্যাদা প্রদান করিতে হইবে। এবং সে কারণে জনাব সভাপতি, আমি প্রস্তাব করিতেছি: ‘ইংলিশ শব্দের পরবর্তীতে ‘বেঙ্গলী’ এই শব্দটিকে ২৯নং রুলে অন্তর্ভুক্ত করা হোক।’ [সূত্র : আসুন আর একবার ওই পথে হেঁটে আসি-লেখক সরদার ফজলুল করিম, ভোরের কাগজ, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮] ২৩ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উত্থাপিত সংশোধনী প্রস্তাবের উপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় ২৫ ফেব্রুয়ারি। এইদিন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এই সংশোধনী প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন, ‘পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করা এবং একটি সাধারণ ভাষার দ্বারা ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা হইতে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করাই এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য।’ [ সূত্র : একুশে ফেব্রুয়ারি, প্রকাশক-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, লেখক-ড. রঙ্গলাল সেন, পৃ. ১২] পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন, ‘উর্দুই একমাত্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হতে পারে বলে পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ লোকের অভিমত। বাংলাকে সরকারী ভাষা করার কোনই যুক্তি নেই। তবে পূর্ববঙ্গে শিক্ষা ও শাসনকার্যের ক্ষেত্রে যথাসময়ে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হইবে।’ [সূত্র : ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস-বশির আল হেলাল, পৃ. ২৪৩] গণপরিষদের কংগ্রেস দলের অস্থায়ী নেতা শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সংশোধনী-প্রস্তাবটি সমর্থন করে বলেন, ‘এতদিন পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল পাকিস্তান জনগণের, সংখ্যালঘু ও সংখ্যগুরু উভয় সম্প্রদায়ের রাষ্ট্র। কিন্তু পরিষদের নেতার বিবৃতি সম্পর্কে অ-মুসলমানদের বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে। শাসনতন্ত্র গঠনে অ-মুসলমানদের কোন অধিকার আছে কিনা সে-কথা এখন তাদের ভেবে দেখতে হবে। সংশোধন প্রস্তাবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিও করা হয়নি। উর্দু ও ইংরেজীর সঙ্গে বাংলাকেও পরিষদের ভাষার অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করা হয়েছে। [সূত্র : ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস-বশির আল হেলাল, পৃ. ২৪৩-২৪৪] গণপরিষদের কংগ্রেস দলের সেক্রেটারি রাজকুমার চক্রবর্তী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশোধনী প্রস্তাবের সমর্থনে বলেন- ‘উর্দু পাকিস্তানের কোন প্রদেশেরই কথ্য ভাষা নয়। তা হচ্ছে উপরতলার কিছুসংখ্যক মানুষের ভাষা। পূর্ব বাংলা এমনিতেই কেন্দ্রীয় রাজধানী করাচী থেকে অনেক দূরে অবস্থিত, তার উপর এখন তাঁদের ঘাড়ে একটি ভাষাও আবার চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। একে গণতন্ত্র বলে না। আসলে এ হলো অন্যদের ওপর উচ্চশ্রেণীর আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা। বাংলাকে আমরা দুই অংশের সাধারণ ভাষা করার জন্য কোন চাপ দিচ্ছি না। আমরা শুধু চাই, পরিষদের সরকারী ভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি। ইংরেজীকে যদি সে মর্যাদা দেয়া হয় তাহলে বাংলা ভাষাও সে মর্যাদার অধিকারী।’ [সূত্র : ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস-বশির আল হেলাল, পৃ. ২৪৪] পাকিস্তানের কেন্দ্রীয়মন্ত্রী গজনফর আলী খান প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন, ‘পাকিস্তানের একটিমাত্র সাধারণ ভাষা থাকবে এবং সে ভাষা হচ্ছে উর্দু। আমি আশা করি যে, অচিরেই সমস্ত পাকিস্তানী ভালভাবে উর্দু শিক্ষা করে উর্দুতে কথাবার্তা বলতে সক্ষম হবে। উর্দু কোন প্রদেশের ভাষা নয়, তা হচ্ছে মুসলিম সংস্কৃতির ভাষা। এবং উর্দু ভাষাই হচ্ছে মুসলিম সংস্কৃতি।’ [সূত্র : ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস-বশির আল হেলাল, পৃ. ২৪৪] গণপরিষদের সহ-সভাপতি মুসলিম লীগ দলীয় সদস্য ফরিদপুরের তমিজুদ্দিন খান কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উত্থাপিত পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার অন্তর্ভুক্তির সংশোধনী প্রস্তাবের সরাসরি বিরোধিতা করে খাজা নাজিমুদ্দিনকে সমর্থন করেন। গণপরিষদ সদস্য প্রেমহরি বর্মা ও ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত তাঁদের বক্তৃতায় নানা বিশ্লেষণ ও যুক্তি দিয়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বক্তব্য সমর্থন করেন। পাকিস্তান গণপরিষদের এই দ্বিতীয় অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন পাকিস্তানের গবর্নর জেনারেল এবং পদাধিকার বলে গণপরিষদের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্। তিনি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আনীত পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার অন্তর্ভুক্তির জন্য সংশোধনী প্রস্তাব ভোটে প্রদান করলে গণপরিষদের অধিবেশনে তা কণ্ঠভোটে বাতিল হয়ে যায়। পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় এবং পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের বাংলা ভাষাবিরোধী অবস্থান নেয়ার সংবাদ প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববঙ্গের সর্বত্র স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ দেখা দেয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে জমায়েত হয়। সেখানে অনুষ্ঠিত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন তমদ্দুন মজলিসের নেতা আবুল কাসেম। বক্তব্য রাখেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দিন আহমদ এবং ফজলুল হক হল ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ তোয়াহা। নেতৃবৃন্দ তাঁদের বক্তব্যে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক বাংলা ভাষাকে অবহেলা করায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাঁরা পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এবং মুসলিম লীগ দলীয় গণপরিষদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সারা পূর্ববঙ্গে মিছিল, সমাবেশ ও ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি তমদ্দুন মজলিস এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের এক যৌথসভায় ১১ মার্চ পূর্ববঙ্গে সাধারণ ধর্মঘট পালনের কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়। তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক আবুল কাসেম, পূর্ব পাকিস্তান মুসিলম লীগের কাউন্সিল সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান, নঈমুদ্দিন আহমদ, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলনে পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলের নেতা আবদুর রহমান চৌধুরী উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ১ মার্চ ১৯৪৮ এক বিবৃতি প্রদান করেন।
×