ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফিরে আসুক পাটের সুদিন

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ১২ মার্চ ২০১৮

ফিরে আসুক পাটের সুদিন

কয়েক বছর আগেও পাট নিয়ে কথা বলার কিছু ছিল না। এক সময়ের সোনালি আঁশ তখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল। হালে পাট আবার নতুন করে আশা জাগিয়েছে। পাট নিয়ে কথা বলার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে, এই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন ইমাজউদ্দিন প্রামাণিক ও মির্জা আজমের যৌথ নেতৃত্ব। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা। আজকে পাটের যে গণজাগরণ তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত ইচ্ছারই ফসল। কারণ, তার বাবা এদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাটকে ভালবাসতেন। তিনিও পাটকে ভালবাসেন। তাইতো দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসেই তিনি বন্ধ সব পাটকল চালু করে দিয়েছেন। শুধু পারেননি এদেশের এক সময়কার গর্ব আদমজী জুট মিল চালু করতে। কারণ, অতীতের সরকার আদমজী জুট মিলকে শুধু বন্ধ করেই ক্ষান্ত হয়নি, সেটা ধ্বংস করে সেখানে গড়ে তুলেছে আদমজী ইপিজেড। এই পাট বাংলাদেশ সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত। কারণ, বাংলাদেশের উৎপাদিত পাট বিদেশে রফতানি হতো, আর তার রফতানি আয় ভোগ করতো পাকিস্তান। রফতানি আয়ের টাকা দিয়ে উন্নয়ন হতো পাকিস্তানের। আর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে কৃষক পাট চাষ করত, যে শ্রমিক পাট পণ্য উৎপাদন করত তারা থাকত অনাহারে। এই অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট হয়ে ওঠার কারণেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ পৃথক হওয়ার আন্দোলন শুরু হয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানীদের ফেলে যাওয়া পাটকলগুলো ভাল উদ্দেশ্যেই সরকারীকরণ করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন এদেশের উদোক্তারাই পাটকল করবে, এদেশের মানুষই পাটের ব্যবসা করবে, এদেশের মানুষই পাটকল পরিচালনা করবে। এদেশের চাষী যে পাট উৎপাদন করবে, শ্রমিক তা দিয়ে পাট পণ্য তৈরি করবে, তার সুফল তারাই ভোগ করবে। কিন্তু এক শ্রেণীর সরকারী কর্মকর্তা এবং শ্রমিক নেতারা মিলে সেই পাটগুলোকে লুটপাটের হাতিয়ার হিসাবে পরিণত করে। যে কারণে লোকসানের ভারে জর্জরিত হতে থাকে এ দেশের সোনালি আঁশ নির্ভর পাটকলগুলো। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর এদেশের পরাজিত শক্তি আবার মাথাচারা দিয়ে উঠে। তারা এদেশের পাটকে পুরোপুরি ধ্বংস করার চক্রান্তে মেতে উঠে। কারণ, পাটই বাংলাদেশের অর্থনীতির মূলশক্তি। একে ধ্বংস করতে পারলে বাংলাদেশই ধ্বংস হয়ে যাবে। ফলে ওই সময়কার সরকারগুলোরও পাট খাতের ধ্বংসলিলায় মেতে উঠে। অথচ তাদের দায়িত্ব ছিল প্লাস্টিক পণ্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে পাট থেকে বিকল্প কিছু উদ্ভাবন। প্রথাগত ব্যবহার থেকে বেরিয়ে এসে পাট দিয়ে নতুন নতুন পণ্য উদ্ভাবন। যাতে প্লাস্টিকের কাছে হারানো বাজার পাট আবার ফিরে পায়। কিন্তু সরকারগুলো তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে পাট খাত ক্রমেই ধংসের দিকে এগিয়ে গেছে। আর এ ধ্বংসযজ্ঞে শেষ পেরেক ঠুকে দেয় বিশ্বব্যাংক। যারা স্বাধীনতার পর বলেছিল, বাংলাদেশ যদি উন্নতি করতে পারে, তবে পৃথিবীর কোন দেশই আর গরিব থাকবে না। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সেই বিশ্বব্যাংক সংস্কারের নামে পাট শিল্প বেসরকারী খাতে বিক্রি ও বন্ধের প্রেসক্রিপশন নিয়ে হাজির হয়। তাদের প্রেসক্রিপশনে আশির দশকে প্রথমে কিছু পাট কল ব্যক্তি খাতে স্থানান্তর করা হয়। আর নব্বইয়ের দশকে এসে একের পর এক পাট কল বন্ধের মিশন শুরু হয়। ১৯৯৪ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ জুট সেক্টর এডজাস্টমেন্ট ক্রেডিট চুক্তি করে। ওই চুক্তির শর্তই ছিল পাটকলগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। বিনিময় ২৪৭ মিলিয়ন ডলার ঋণ পাবে। শেষ পর্যন্ত পেয়েছে মাত্র ৫২ মিলিয়ন ডলার। আর ২০০১ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে বিশ্বব্যাংক আবারও সেই একই সংস্কার কর্মসূচী নিয়ে হাজির হয়। এবার বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশনে বন্ধ করা হয় এশিয়ার বৃহত্তম পাট কল আদমজী। অথচ একই সময়ে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নেই ভারতে গড়ে উঠে নতুন নতুন পাট কল। আদমজী পাট কল থেকে প্রতি বছর আড়াই লাখ টন পাট পণ্য রফতানি হতো। ঠিক একই পরিমাণ পাট পণ্য উৎপাদনের জন্য বিশ্বব্যাংক ভারতকে অর্থায়ন করে। যাতে ভারত সেই বাজার দখল করতে পারে। আর একটি বিষয় লক্ষণীয়, আগে পাট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন কেবলই বাংলাদেশ পাট কল কর্পোরেশন। তাদের দায়িত্ব ছিল যেন শুধু পাটকল কর্পোরেশন দেখভাল করা। কারণ, তারা পুরো পাটখাত নিয়ে কখনও ভাবতেন না। অর্থাৎ সত্যিকার পাটের মন্ত্রী তারা ছিলেন না। যতটা পাট টিকে রয়েছে, যতটা বহুমুখীকরণ হয়েছে তা শুধুমাত্র বেসরকারী উদ্যোক্তাদের আগ্রহেই। এখন অবশ্য সেই প্রেক্ষাপট বদলেছে। এক সময় পাট নিয়ে আলোচনা কিংবা পাট নিয়ে লেখালেখি করা মানেই কিভাবে পাট খাত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, কিভাবে এই ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা যায় -এসব বিষয় প্রাধান্য পেত। আর এখন প্রাধান্য পাচ্ছে পাটের সম্ভাবনা। আলোচনা হচ্ছে কিভাবে ফিরে আসছে পাটের সুদিন, পাটের বহুমুখীকরণে কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। পাট নিয়ে এখন হা-হুতাশের দিন শেষ হয়েছে। এখন সময় এসেছে পাট নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। আমি মনে করি, পাট নিয়ে আজকের যে জাগরণ তার সূত্রপাত ২০১৫ সাল থেকে। ওই বছরের ১৭ ডিসেম্বর পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন ২০১০ বাস্তবায়নে যে কোন পরিমাণ ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার ও চিনি সংরক্ষণ ও পরিবহনে বাধ্যতামূলকভাবে পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে সরকারী নির্দেশনা জারি করা হয়। শুধু তাই নয়, এই ছয়টি পণ্যে পাটের ব্যাগ ব্যবহারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা শুরু হলে ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয় এসব পণ্যে পাটের ব্যাগ ব্যবহার করতে। এ সময়ে অবশ্য ভারত হঠাৎ করেই বাংলাদেশ থেকে কাঁচাপাট নেয়া বন্ধ করে দেয়। ফলে দেশের অভ্যন্তরে পাটের ব্যবহার বাড়াতে পাট মন্ত্রণালয় তড়িত বাধ্যতামূলক পাটের মোড়ক ব্যবহার আইন বাস্তবায়নে যায়। আর এতেই পাটের চিত্র পাল্টে যায়। বাড়তে থাকে পাটের ব্যাগের চাহিদা। পরবর্তীতে ওই ছয় পণ্যের সঙ্গে আরও ১১ পণ্য অর্থাৎ পেঁয়াজ, আদা, রসুন, ডাল, আলু, আটা, ময়দা, মরিচ, হলুদ, ধনিয়া এবং তুষ-খুদ-কুড়ার মোড়ক হিসেবে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। সবমিলিয়ে এখন ১৭ পণ্যে পাটের মোড়ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক। কোন প্রতিষ্ঠান এই আইন না মানলে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদ- বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দ-ের বিধান রয়েছে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে শাস্তি সর্বোচ্চ দ-ের দ্বিগুণ হবে। মূলত এই আইন বাস্তবায়নের কারণেই দেশে পাটের চাহিদা বেড়ে যায়। চাহিদা বৃদ্ধির করণে কৃষক এখন তার উৎপাদিত পাটের ভাল দাম পাচ্ছে। যে কারণে কৃষক আবার পাট চাষে ঝুঁকছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ২০১৭ সালে রেকর্ড পরিমাণ জমিতে অর্থাৎ ৮ দশমিক ১৭ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। অথচ ২০১৫ সালেও মোট পাট চাষ হয়েছিল ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৬৭৮ হেক্টর জমিতে। আর পাট উৎপাদন হয়েছিল ৭৫ লাখ ৫৮ হাজার ৯৩৪ বেল। এবার শুধু রেকর্ড পরিমাণ জমিতে পাট চাষই হয়নি, রেকর্ড পরিমাণ অর্থাৎ ৯১ লাখ ৭২ হাজার বেল পাট উৎপাদিত হয়েছে। গত বন্যায় কয়েকটি জেলায় পাটের ক্ষতি না হলে এই উৎপাদন এক কোটি বেল ছাড়িয়ে যেত। বাংলাদেশে অতীতে কখনও এত পাট উৎপাদিত হয়নি। সবচেয়ে আশার বিষয় হলো, পাট শিল্পগুলোর প্রচলিত পাটপণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাও বহুমুখী পাট পণ্য উৎপাদনে আশাপ্রদভাবে এগিয়ে আসছে। বর্তমানে দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি মিলে ৭ শতাধিক প্রতিষ্ঠান বহুমুখী পাটজাত পণ্য তৈরির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এ পণ্য রফতানিতে ২০ শতাংশ প্রণোদনা দেয়ায় এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ফলে সরকারের পাটের ব্যাগের বাধ্যতামূলক ব্যবহারের পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের নতুন ব্যবসার পরিকল্পনাতেও ঠাঁই করে নিয়েছে আমাদের সোনালি আঁশ। বস্ত্র, সুতা, কার্পেটের মতো পণ্যের বাইরেও সোনালি আঁশ পাট দিয়ে তৈরি হচ্ছে নান্দনিক সব পণ্য। ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন ধরনের পোশাক, শাড়ি, জুতা, ব্যাগ, টেবিল ম্যাটের মতো দরকারি পণ্য ছাড়াও বানানো হচ্ছে পাটের তৈরি কাগজ, পাটের ভিজিটিং কার্ড, র‌্যাপিং শিট, দাওয়াতপত্র, অফিস আইটেম, ফাইল ফোল্ডার, ব্যাগ, কার্ড হোল্ডার, পেপার ফোল্ডার, ফাইলবক্স, টিস্যুবক্স, ডেক্স ক্যালেন্ডার, স্কুলব্যাগ, ল্যাপটপ ব্যাগ, লেডিস পার্স, শপিংব্যাগ, মোবাইল-পাসপোর্ট ব্যাগ, ভ্যানিটি ব্যাগ, গ্রোসারি ব্যাগ, ট্রাভেল ব্যাগ, স্যুটকেস, ব্রিফকেস, মানিব্যাগসহ নোটবুক, ফটো এ্যালবাম, ল্যাম্প শেড ও পুতুলসহ দৃষ্টিনন্দন শোপিস তৈরি করছে তারা। বর্তমানে পাট থেকে এ ধরনের ২৪০ প্রকার পাটপণ্য তৈরি হচ্ছে। এগুলো অনেক সুন্দর ও পরিবেশবান্ধব। এসব পণ্য ইউরোপ ও আমেরিকায় বাজারজাত হচ্ছে। এমনও উদ্যোক্তা আছেন, যারা ১০০ ভাগ উৎপাদিত পণ্যই ইউরোপে রফতানি করেছেন। অথচ আমরা নিজেরাই অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করছি না। এটা দুর্ভাগ্যের বিষয়। আমরা নিজেরা যদি বিদেশী জিনিসের পরিবর্তে দেশীয় পাটের পণ্য ব্যবহারে উদ্যোগী হই, তাহলে পাটের এই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারই পাট অর্থনীতির চালিকা শক্তি হিসাবে পরিণত হবে। তবে, এই ক্ষুদ্র উদ্যোগ দিয়ে পাটের সত্যিকারের সুদিন ফিরিয়ে আনা যাবে না। সুদিন ফিরিয়ে আনতে হলে পণ্য দিয়ে বড় কিছু করতে হবে। ইতোমধ্যে পাট থেকে পচনশীল পাট পলিব্যাগ উৎপাদন শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের এক পরমাণু বিজ্ঞানীর এ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। বর্তমানে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে মাসে ৫ হাজার পিস এ ব্যাগ তৈরি হচ্ছে। এ পলিব্যাগ উৎপাদনে আধুনিক কারখানা করার চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশের পাট দিয়ে বছরে ১৬০ বিলিয়ন টন পচনশীল পাট পলিব্যাগ উৎপাদন সম্ভব। যা বিশ্বের পলিবাগ চাহিদার চারভাগের এক ভাগ। আর এ বাজারকে ধরতে পারলে আর পাট নিয়ে পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। এছাড়া, বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে পাটের তৈরি ফাইবার দিয়ে ঢেউটিন, চেয়ার-টেবিলসহ বিভিন্ন আসবাবপত্রও তৈরি করে দেখিয়েছেন। কিন্তু বেসরকারী উদ্যোক্তার অভাবে বাণিজ্যিকভিত্তিতে এসব পণ্য তৈরি করা সম্ভব হয়নি। পাটের সুদিন ফিরিয়ে আনতে হলে পাট দিয়ে এ ধরনের বড় কিছু করতে হবে। এই বড় কিছু করার পথ খুলে দিয়েছেন প্রায়ত বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম। তিনি ও তার সঙ্গীরা পাটের জন্মরহস্য (জেনম) আবিষ্কার করে পাটের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। যার ফলে পাটের গুণগত মান আরও উন্নত করা সম্ভব হবে। বাড়বে পাটের বহুমুখী ব্যবহার। এছাড়া দেশীয় পাটের চাষাবাদ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন খরচও কমবে। যা পাটের সোনালি সুদিন ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু বড় কিছু তৈরির ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হচ্ছে উদ্যোক্তা আর বিনিয়োগ। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা কেউ গবেষণামূলক কাজে বিনিয়োগ করতে চায় না। সবাই চায় রেডিমেট বিনিয়োগ করতে। এক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারী উদ্যোগে এসব পণ্য বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদন করে লাভজনক হিসাবে দেখাতে হবে। তবেই বেসরকারী খাত এগিয়ে আসবে। পাট নিয়ে অনেক কিছুই লেখার আছে। সবকিছু একটি লেখায় লিখে শেষ করা যাবে না। তাই পাটের কয়েকটি ইস্যুর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমি আমার লেখা শেষ করছি। ১. পাটের প্রধান ইস্যু বীজ। ভাল মানের পাট উৎপাদন করতে হলে ভাল বীজের প্রয়োজন। পাট উৎপাদনের প্রধান উপকরণ বীজের প্রায় ৮০ শতাংশই ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। ভারতীয় বীজের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। ভারতীয় বীজের ওপর নির্ভর করতে গিয়ে দেখা যায়, প্রতি বছরই কৃষক প্রতারিত হয়। তাই ভাল মানের পাট উৎপাদন করতে মানসম্পন্ন পাট বীজের নিশ্চয়তা দিতে হবে। বীজ সঙ্কট দূর করতে সরকারকেই জরুরী উদ্যোগ নিতে হবে। ২. পাটপণ্য উৎপাদন, বৈচিত্র্যকরণ ও রফতানিতে বেশি করে উৎসাহ দেয়া প্রয়োজন। এজন্য ইনসেনটিভের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ৩. ১৭ পণ্যে পাটের মোড়ক যেমন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, তেমনি সরকারী-বেসরকারী খাতে জিও টেক্সটাইল ব্যবহারও বাধ্যতামুলক করা উচিত। কারণ প্রতি বছর দেশে প্রায় ৮ কোটি ৫০ লাখ ডলারের জিও টেক্সটাইল ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে প্রতিবছর বিভিন্ন বিভাগে ১২ কোটি ৭০ লাখ বর্গমিটার উন্নত ধরনের চট (জুট জিও টক্সটাইল) লাগে। ৪. প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাট শিল্পের সঙ্গে দেশের প্রায় চার কোটি মানুষ জড়িত। তাই এ শিল্পে ২ শতাংশ সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ৫. পাট দিয়ে বহুমুখী পণ্য তৈরি করতে হলে নিত্যনতুন নক্সা উদ্ভাবন প্রয়োজন। বিশেষ করে, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে হলে নক্সায় বৈচিত্র্য আনতে হয়। এজন্য সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে একটি নক্সা কেন্দ্র স্থাপন করা প্রয়োজন। ৬. ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মূলধন সঙ্কট প্রকট। সহজ শর্তে তাদের ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। ৭. পাট শিল্পে দক্ষ জনশক্তির অভাব। এ অভাব পূরণে পাট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা প্রয়োজন। ৮. পাট উৎপাদন ও পাট গবেষণা কৃষি মন্ত্রণালয়ের হাতে। আর পাট দিয়ে পাট পণ্য উৎপাদন, বিপণন, বাজারজাতকরণ পাট মন্ত্রণালয়ের হাতে। যার ফলে সমন্বয়ের অভাব হয়। পাট সংক্রান্ত সবকিছু এক মন্ত্রণালয়ে আনার ব্যবস্থা করা যায় কিনা তা জোড়ালভাবে সরকারের বিবেচনা করতে হবে। ৯. পাট একটি কৃষজাত পণ্য। অথচ এটি কৃষি পণ্যের স্বীকৃতি পাচ্ছে না। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাটকে প্রক্রিয়াজাত কৃষি পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ তালিকায় আরও ৪০টি পণ্য থাকা সত্ত্বেও গত দুই বছরেও প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশ কার্যকর হয়নি। এ নির্দেশ বাস্তবায়নে প্রধান বাধা পাটের প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের নেতিবাচক ধারণা। পাটের সুদিন ফেরাতে হলে এ ধারণা পাল্টাতে হবে। দ্রুত পাটকে প্রক্রিয়াজাত পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাহলে এ খাতের উদ্যোক্তারা সরকার প্রদত্ত সুবিধাদি ভোগ করতে পারবেন। ফলে পাট পণ্যের উৎপাদন খরচ কমে আসবে। আন্তর্জাতিক বাজারে পাট পণ্য প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। ১০. সর্বোপরি, দেশের ভেতর পাটের পণ্য ব্যবহারে সচেনতা সৃষ্টি প্রয়োজন। এক্ষেত্রে জাতীয় পাট দিবস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এর পাশাপাশি আরও বেশি বেশি মেলার আয়োজন করা যেতে পারে। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়, এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো, জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন কাউন্সিল ও এসএমই ফাউন্ডেশন- একসঙ্গে কাজ করলে দ্রুতগতিতে পাটপণ্যের সম্প্রসারণ হবে। খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীনের সেই কবিতা দিয়ে আমি আমার লেখা শেষ করছি। নিশ্চয়ই আপনাদের সেই কবিতার কথা মনে আছে। ‘বোনকে দেব পাটের শাড়ি মাকে দেব রঙ্গিণ হাঁড়ি’। বাস্তবে হয়ত পাটের শাড়ি সীমিত আকারে তৈরি হচ্ছে। কিন্তু খরচ পড়ছে অনেক বেশি। তবে কবিতার এই বাণী শীঘ্রই সত্যি হতে চলেছে। বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে তুলার সমতুল্য পাট উৎপাদনের নতুন জাত উদ্ভাবনে কাজ করছেন। ওই পাট বীজ উদ্ভাবিত হলেই দেশের বস্ত্র খাতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। সেই সঙ্গে পাট থেকে কাঠ তৈরির প্রযুুক্তি নিয়ে কাজ চলছে। এভাবে পাটকে বড় কাজে ব্যবহারের উপযোগী করা গেলে- এই পাটই আবার দেশের অর্থনীতির মূল শক্তিতে পরিণত হবে। পাট ‘গোল্ডেন ফাইবার’ নয়, ‘প্লাটিনাম ফাইবারে’ পরিণত হবে। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×