ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এস এম মুকুল

শতরঞ্জি ॥ ঐতিহ্য থেকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির উৎস

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ১১ মার্চ ২০১৮

শতরঞ্জি ॥ ঐতিহ্য থেকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির উৎস

চিরায়ত বাঙলার নয়নাভিরাম নকশার শতরঞ্জির নান্দনিকতা এখন আধুনিক বাংলাদেশে এমনকি বিদেশেও সমাদৃত। রংপুর জেলার তাঁতীরা এক ধরনের মোটা কাপড় তৈরি করে যা শতরঞ্জি নামে পরিচিত। শতরঞ্জি বা ডুরি মূলত এক প্রকার কার্পেট, এক সময়ে সমাজের অভিজাত শ্রেণীর গৃহে, বাংলো বাড়িতে বা খাজাঞ্চিখানায় বিশেষ আসন হিসেবে শতরঞ্জি ব্যবহৃত হতো। বর্তমান আধুনিক সমাজে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে এখনও ব্যবহৃত হচ্ছে। শতরঞ্জি ফার্সী ভাষার শব্দ শতরঞ্জ শব্দ থেকে এসেছে। দাবা খেলার ছককে শতরঞ্জ বলা হয় এবং দাবা খেলার ছকের সঙ্গে শতরঞ্জির নকশার মিল থাকার কারণে এটাকে শতরঞ্জি নামে নামকরণ করা হয়। ইংরেজীতে যাকে ঈড়ঁৎংবংঃৎরঢ়বধ ঈড়ৎস ঈধৎঢ়বঃ বলা হয়। শতরঞ্জি শুধুমাত্র রংপুরের ঐতিহ্য নয়, এটি বাংলাদেশেরও ঐতিহ্যবহনকারী পণ্য। আশার খবর হচ্ছে রংপুরের অজপাড়াগাঁয়ের হস্তশিল্প শতরঞ্জি বিদেশে রফতানি হচ্ছে। ডলার আয়ের পাশাপাশি কর্মসংস্থান হচ্ছে হাজারো মানুষের। প্রাণ ফিরে পেয়েছে দেশীয় ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পটি। স্ব-পেশায় ফিরে আসছেন পুরনো এই শিল্পের কারিগররা। শতরঞ্জির গোড়াপত্তন যেভাবে শতরঞ্জির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে জানা যায়, ১৯৭৬ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সা’দত মোহাম্মদ সায়েমের নির্দেশে প্রথম সরকারীভাবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) মাধ্যমে নিসবেতগঞ্জ গ্রামে শতরঞ্জি তৈরির প্রকল্প গ্রহণ করে। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৫ সালে প্রথম সরকারীভাবে বিসিক শতরঞ্জি শিল্পে জড়িত ৪৫ জন শ্রমিককে কারিগরি শিক্ষা প্রদান করা হয়। এরপর থেকে অবহেলিত শতরঞ্জি শিল্পটি সরকারের দৃষ্টিতে আসেনি। বলা যায় অবহেলার শিকার হয়ে বিলুপ্ত হতে যাওয়া শিল্পটির প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে বেসরকারী উদ্যোক্তারা। তারপরও নানা প্রতিকূলতায় এ পেশার সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার শ্রমিক বাপ-দাদার ঐতিহ্যবাহী পেশাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। তবে বিসিকের উদ্যোগে এই শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলেও পরবর্তীতে ঢাকার এক ব্যবসায়ী বিসিকের এই কেন্দ্রটি লিজ নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে রংপুর শহরের কারুপণ্যের মালিক সফিকুল আলম সেলিমের আন্তরিক প্রচেষ্টায় শতরঞ্জির ব্যবহার আরও বহুমুখী হয়ে উঠে। তারও পরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার মধ্যদিয়ে খ্যাতিসম্পন্ন ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেলের উদ্যোগে ইউরোপীয়ান কমিশনের মাধ্যমে ইউরোপের বাজারে রংপুরের শতরঞ্জির পরিচয় ঘটে। তবে শতরঞ্জি শিল্পকে জাগরিতকরণে যার ভূমিকা অনন্য তিনি শতরঞ্জির স্বপ্নদ্রষ্টা- কারুপণ্যের স্বত্বাধিকারী সফিকুল আলম সেলিম। কেননা তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শতরঞ্জি শিল্প বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে বাংলার ঐতিহ্য থেকে গৃহসজ্জার সৌখিন নান্দনিকতায়। তার দেখানো পথ ধরেই পৃথিবীর প্রায় ৪০টি শতরঞ্জির শৈল্পিক কারুপণ্য রফতানির মাধ্যমে প্রায় অর্ধশত লাখ ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে। সফিকুল আলম সেলিম শতরঞ্জি শিল্পের ২০ জন কারিগরকে খুঁজে বের করে রংপুরের নিসবেতগঞ্জ গ্রামে বিসিকের বন্ধ থাকা একটি দোচালা কারখানা ভাড়া নিয়ে ১৯৯১ সালেই রংপুরে কারুপণ্য নামের একটি দোকান দিয়ে ‘শতরঞ্জি’ বুননের নতুন জাগরণের গোড়াপত্তন কাজ শুরু করেন।
×