ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শংকর লাল দাশ

সরকারী চালকল বহুমুখী সুফলের প্রত্যাশা

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ১১ মার্চ ২০১৮

 সরকারী চালকল  বহুমুখী সুফলের প্রত্যাশা

চালের জন্য বেসরকারী মিল মালিকদের ওপর থেকে নির্ভরতা কমাতে সরকার দেশের প্রতিটি বিভাগে একটি করে চালকল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বরিশাল বিভাগে চালকল স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাছাই কার্যক্রম শুরু হয়েছে। চালকল স্থাপনের স্থান নির্ধারণের লক্ষ্যে গঠিত হয়েছে চার সদস্যের কমিটি। এ কমিটি ইতোমধ্যে পটুয়াখালীর বগা খাদ্যগুদাম এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। কমিটির আরও একাধিক এলাকা পরিদর্শনের কর্মসূচী রয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে সরকারী পর্যায়ে স্থাপিত হতে যাওয়া আধুনিক মানের এ চালকল এলাকাবাসী বিশেষ করে কৃষকদের জন্য অভাবনীয় সুফল বয়ে আনবে। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, সরকারী উদ্যোগে চালকল স্থাপন হলে বরিশাল অঞ্চলের কৃষকরা উৎপাদিত ধানের ন্যায্য মূল্য পাবে। পরিবহন খাতে সরকারের কোটি কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। কর্মসংস্থান হবে বহু মানুষের। ধানচালের নতুন বাজার সৃষ্টি হবে। পুঁজি বিনিয়োগের সম্ভাবনা হবে। ধান-চালের বাজার থাকবে স্থিতিশীল। বেসরকারী চালকল মালিকদের একক আধিপত্য ভেঙে পড়বে। চালের দাম নিয়ে ভোক্তাদের ভোগান্তি হ্রাস পাবে। এর থেকে এমন আরও অনেক প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সুফল মিলবে। বরিশাল বিভাগে চালকল স্থাপনের যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সূত্রে বলা হয়েছে, বরিশাল বিভাগে পুলিশ, আনসার ও ফায়ার সার্ভিসে কর্মরতদের রেশনসহ ভিজিডি, ভিজিএফ এবং সরকারের অন্যান্য খাদ্যবান্ধব কর্মসূচী খাতে প্রতিবছর দেড় লাখ টন চালের চাহিদা রয়েছে। বরিশাল বিভাগের অধিবাসীদের খাদ্য চাহিদা রয়েছে সাড়ে ১৩ লাখ টনের। এর বিপরীতে বরিশাল বিভাগে ১৯ লাখ ৪০ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়। অর্থাৎ বরিশাল বিভাগে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে চার লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকে। চাল উদ্বৃত্ত থাকা সত্ত্বেও বিভাগের চাহিদার অধিকাংশই মেটাতে হয় উত্তরাঞ্চল থেকে আমদানি করা চাল দিয়ে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে-বরিশাল বিভাগে পর্যাপ্ত চালকল না থাকা। প্রয়োজনীয় চালকলের অভাবে দক্ষিণাঞ্চলের জেলা পটুয়াখালীর কৃষক ও ভোক্তারা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তার সহজ একটি হিসেব হচ্ছে- পটুয়াখালী জেলায় বছরে কেবলমাত্র আমন ধান উৎপাদন হয় ৯ থেকে ১০ লাখ টন। কিন্তু এ বিপুল পরিমাণ ধান থেকে চাল উৎপন্নে কোন ব্যবস্থা নেই। এমনকি এ জেলা থেকে সরকারী উদ্যোগে ধান কেনাতেও খুব একটা আগ্রহ নেই। ফলে দক্ষিণের এ জেলা থেকে উৎপাদিত প্রায় সব ধান চলে যায় উত্তরাঞ্চলে। আবার উত্তরাঞ্চল থেকে সে ধান চালে রূপ নিয়ে চলে আসে পটুয়াখালী জেলায়। ধানের চলে যাওয়া। আবার রূপ পাল্টে চাল হয়ে ফিরে আসা। এতে দাম বাড়ে চালের। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসেব অনুযায়ী, পটুয়াখালী জেলায় আবাদি কৃষি জমি রয়েছে ২ লাখ ১৩ হাজার ৬ শ’ হেক্টর। গত বছর রোপা আমন ধানের চাষ হয়েছে ২ লাখ ১০ হাজার ৩৪০ হেক্টর জমিতে। এতে ৯ লাখ টনেরও বেশি ধান উৎপাদন হয়। এর থেকে চাল উৎপন্ন হয়েছে পাঁচ লাখ ৯১ হাজার ৪৮৭ টন। ধান পটুয়াখালী জেলায় উৎপাদন হলেও চাল হয়েছে উত্তরাঞ্চলে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে জেলায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক চালকলের অভাব। পটুয়াখালী জেলায় বর্তমানে চারটি অটো রাইসমিল ও চাল ছাঁটাইয়ের ছোট ১৩টি হাস্কিং মিল রয়েছে। এ মিলগুলো প্রতি মাসে বড়জোর সাড়ে ৬ থেকে ৭ হাজার টন ধান ছাঁটাই করতে পারে। যদিও ধান ছাঁটাইয়ের যে সীমিত ব্যবস্থা রয়েছে, তাও পুরোপুরি কাজে লাগানো হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে মিল মালিকরা বলছেন, পটুয়াখালীর মিল মালিকদের কাছ থেকে সরকার পর্যাপ্ত চাল কিনছে না। সরকার উত্তরাঞ্চলের মিলগুলো থেকেই চাল কিনছে। এতে স্থানীয় মিল মালিকরা ধান ছাঁটাইয়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে। এদিকে, আবার পটুয়াখালীর অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণেও জেলার ধানচাল ব্যবহার হচ্ছে না, এটিও এলাকার ধান-চালের বাজারের একটি বড় সমস্যা। জেলার সরকারী প্রতিষ্ঠান যেমন পুলিশ, আনসার, ফায়ার সার্ভিসে কর্মরতসহ ভিজিডি, ভিজিএফ, ওএমএসসহ সরকারের বিশেষ প্রকল্পে জেলায় চাহিদা রয়েছে ১৫ হাজার ২ শ’ টন চাল। এছাড়া, বর্তমানে সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর পাঁচ মাসে চালের চাহিদা রয়েছে ১৭ হাজার ৭১২ দশমিক ৬ শ’ টন। এতে মোট চালের চাহিদা দাঁড়ায় ৩২ হাজার ৯১২ দশমিক ৬ শ’ টন। অভ্যন্তরীণ এ চালের চাহিদাও পূরণ করা হয় উত্তরাঞ্চল থেকে। এতে ঘাটে ঘাটে দিতে হচ্ছে পরিবহন খরচ। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন গুদাম থেকে ট্রাকে চাল আসে সরকারী স্থানীয় সরবরাহ কেন্দ্র সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি ঘাটে। সেখানে পৌঁছতে শ্রমিক ও পরিবহন বিল বাবদ অর্থ ব্যয় হয়। এরপর পটুয়াখালীতে পৌঁছতে কার্গোতে চাল তোলায় শ্রমিক বিল ও কার্গো পরিবহন বিল পরিশোধ করতে হয়। পরবর্তীতে পটুয়াখালী ঘাটে পৌঁছনোর পর পুনরায় কার্গো থেকে গুদামজাত করতেও শ্রমিকদের শ্রম বিল দিতে হচ্ছে। এতে করে প্রতিটন চালে কমপক্ষে তিন হাজার টাকা সরকারের ব্যয় হয়। এখাতে প্রতিবছর সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়। চাল সরবরাহে বর্তমানে উত্তরাঞ্চলের বেসরকারী চালকল মালিকদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। এ সিন্ডিকেট প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ধান-চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এ সিন্ডিকেটের কারণে এ বছর চালের বাজার অস্তিতিশীল হয়ে পড়ে। বেসরকারী চালকলের ওপর থেকে নির্ভরতা কমাতে তাই সরকার নিজস্ব উদ্যোগে চালকল স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। চলতি বছর একনেকের একটি বৈঠকে প্রতি বিভাগে একটি করে আধুনিক মানের চালকল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় গত ৮ আগস্ট খাদ্য অধিদফতর থেকে এক চিঠিতে প্রস্তাবিত চালকল স্থাপনের বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণের লক্ষ্যে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক, বরিশাল রেজা মোহাম্মদ মহসিনকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেন, খাদ্য অধিদফতরের (সাইলো) উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) মোঃ মনিরুল ও বরিশাল আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক দফতরের রক্ষণাবেক্ষণ প্রকৌশলী ফনীভূষণ দেবনাথ। চার সদস্যের এ প্রতিনিধিদল চালকল স্থাপনের স্থান নির্ধারণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে পটুয়াখালীর বগা খাদ্যগুদাম এলাকা পরিদর্শন করেছেন। খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা মনে করেন সরকারী পর্যায়ে দেশে চালকল না থাকায় অনেক সময়ই বেসরকারী চালকলের মালিকরা খাদ্যগুদামে চালের সরবরাহ দিতে অসহযোগিতা করে। এতে সরকারী চাল বিলি বণ্টনের কাজ ব্যাহত হয়। এর শিকার হয় সাধারণ মানুষ। এ প্রেক্ষাপটে দেশের প্রতিটি বিভাগে অন্ততপক্ষে একটি চালকল স্থাপন করা হলে সরকারের সক্ষমতা বাড়বে এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। এছাড়া, সরকারীভাবে আধুনিক চালকল স্থাপন হলে স্থানীয় পর্যায়ের কৃষক খুব সহজে ধান পৌঁছে দিতে পারবে। এতে কৃষকদের উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হবে এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হবে। স্থানীয় লোকজনদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠী উপকৃত হবে। পরিবহন ব্যয় সাশ্রয় হবে।
×