ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টা ॥ উদ্ধারকৃত ট্যাব মোবাইল ও মেমোরি কার্ডের ফরেনসিক পরীক্ষা করা হবে

ফয়জুর ও এনামুলকে সামনাসামনি জিজ্ঞাসাবাদ

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১১ মার্চ ২০১৮

ফয়জুর ও এনামুলকে  সামনাসামনি জিজ্ঞাসাবাদ

শংকর কুমার দে ॥ বিশিষ্ট লেখক ও সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালকে হত্যা চেষ্টা মামলায় গ্রেফতারকৃত ফয়জুল হাসানের ভাই এনামুল হাসানকে গাজীপুর থেকে গ্রেফতারের পর তার কাছ থেকে উদ্ধার করা মোবাইল, ট্যাব ও মেমোরি কার্ড ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে রহস্য উন্মোচনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। উদ্ধার করা একটি ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস থেকে আল-কায়েদা এবং আইএসের নানারকম ভিডিও, ইরাক-সিরিয়ার ভিডিওসহ নানারকম জঙ্গীবাদী প্রপাগা-া প্রচারণার উপাদান পাওয়া গেছে। এ ছাড়া মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে হামলাকারী ফয়জুল হাসান ও তার ভাই এনামুল হাসানকে। জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় ব্যবহৃত ছুরি, রক্তমাখা কাপড়, ফয়জুরের ব্যবহৃত সাইকেল এরইমধ্যে আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়েছে। বহুল আলোচিত জাফর ইকবালকে হত্যা চেষ্টায় হামলার ঘটনার রহস্য উন্মোচনে তদন্ত করছে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব, সিআইডি, পিবিআই এবং ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গাজীপুর থেকে ফয়জুরের বড় ভাই এনামুলকে আটক করার সময়ে তার কাছ থেকে মোবাইল, ট্যাব ও মেমোরি কার্ড উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার করা মোবাইল, ট্যাব ও মেমোরি কার্ড পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার এনামুল হাসানকে গাজীপুর থেকে আটক করার পর শুক্রবার রাতে সিলেটে আনার পর তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারী ফয়জুল হাসান ও তার ভাই গাজীপুর থেকে গ্রেফতার করা এনামুল হাসানকে মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। হামলাকারী ফয়জুর ঘটনার সময়ে গণপিটুনিতে আহত অবস্থায় আটক হওয়ার পর এনামুল সিলেট থেকে পালিয়ে গাজীপুরে চলে আসে। তবে হামলাকারী ফয়জুরের বাবা শফিকুর রহমান, মা মিনারা বেগম থানায় এসে আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু ভাই এনামুল হাসান ফয়জুরের মোবাইল ফোন, ট্যাব, মেমোরি কার্ড নিয়ে পালিয়ে গাজীপুর চলে আসে কেন সেই বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশ কয়েকটি ইউনিট দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রেখেছে ফয়জুরকে। ফয়জুর কোন জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, এর নেপথ্যে কারা, তাদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে। ভাই এনামুলকেও এই বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনায় ফয়জুরের পরিবারের চার সদস্য বাবা আতিকুর রহমান, মা মিনারা বেগম, মামা ফজলুর রহমান, ভাই এনামুল ও শাবিপ্রবি গ্রন্থাগারের নিরাপত্তা প্রহরী খালেকুজ্জামান, বাইসাইকেল কারিগর জাহিদ পুলিশ হেফাজতে আছে। তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে রেখে জাফর ইকবালের ওপর হামলার নেপথ্যের ঘটনা ও নায়কের রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করা হচ্ছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ফয়জুল হাসানের দাখিল পাসের পরপরই পরিবর্তন দেখা যায় তার আচরণে। ধর্মীয় নানা বিধিনিষেধ মানতে শুরু করে কঠোরভাবে। অনলাইনে জড়িয়ে পড়ে জঙ্গীবাদে। নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এবং আনসার আল ইসলামের অনলাইন গ্রুপ দাওয়া ইলাল্লাহর সঙ্গে যুক্ত হয় সে। পাঠ নেয় সাংগঠনিক কার্যক্রমের। দাওয়া ইলাল্লাহর নির্দেশনা অনুসারে জাফর ইকবালের ওপর হামলার জন্য প্রস্তুতি নেয় সে নিজে নিজেই। জিজ্ঞাসাবাদে ফয়জুর বলছে, জাফর ইকবালের ওপর হামলা চালানো ওই হামলায় তার সঙ্গে অন্য কেউ ছিল না। দাওয়া ইলাল্লাহ ফোরামের নির্দেশনা অনুযায়ী সে হামলা চালিয়েছে। তবে তার কথায় আস্থা রাখতে পারছেন না তদন্তকারীরা। তদন্তকারীদের ধারণা, জাফর ইকবালের ওপর এই হামলা পরিকল্পনার সঙ্গে আরও কেউ সরাসরি যুক্ত ছিল। বৃহস্পতিবার ফয়জুরকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ফয়জুল হাসান ধার্মিক পরিবারে বেড়ে উঠেছে। ২০১৬ সালে পাল্টাতে শুরু করে সে। তখন থেকেই সে অনলাইনে আহলে হাদিস সম্পর্কিত বিভিন্ন লেখালেখি পড়ে এবং একপর্যায়ে কট্টরপন্থী হয়ে যায়। র‌্যাডিক্যালাইজড হয়ে যাওয়ার পর সে প্রাথমিক ধাপেই জাফর ইকবালকে হত্যার পরিকল্পনা করে। দাওয়াহ ইলাল্লাহ ফোরাম তাকে এই কাজে উৎসাহিত করে। ফয়জুল হাসান গত দুই বছরে সে যাদের সংস্পর্শে ছিল তারা আহলে হাদিসের অনুসারী। ২০১৬ সালে দাখিল পাস করে সিলেট আলিয়া মাদ্রাসায় আলিম শ্রেণীতে ভর্তি হলেও এটি সঠিক পথ নয় বলে লেখাপড়ায় ইতি ঘটায় সে। মঈন কম্পিউটার্স নামে যে প্রতিষ্ঠানে ফয়জুর কাজ করতো সেই প্রতিষ্ঠানের মালিক মঈনও ছিল আহলে হাদিসের অনুসারী। মাঝে বেশ কয়েক মাস কাজ করেছে সিলেটের কুরআন-সুন্নাহ রিসার্চ সেন্টার নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। দুনিয়াজুড়ে আহলে হাদিস বা সালাফি মতবাদের বেশিরভাগ অনুসারীই উগ্রপন্থায় জড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশেও নিষিদ্ধঘোষিত জেএমবি বা নিউ জেএমবি এবং আনসার আল ইসলামসহ বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের সদস্যদের অধিকাংশ আহলে হাদিস বা সালাফি মতবাদের অনুসারী। ফয়জুরসহ তার বাবা-মা, চাচা এবং এক মামাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন সিটিটিসির এই কর্মকর্তা। ফয়জুল হাসানসহ তার বাবা-মা ও মামা, চাচাকে জিজ্ঞাসাবাদকারী সিটিটিসির কর্মকর্তা বলেন, ফয়জুল হাসান সালাফি বা আহলে হাদিস থেকে জঙ্গীবাদে যোগ দেয়ার পর হামলাকারী তার নিজের পরিবারেও জঙ্গীবাদের দাওয়াত দিয়েছিল। ফয়জুরের বাবা হাফেজ আতিকুর রহমানের সে সময় ফয়জুরের বাবা ছেলেকে তার মতবাদ নিয়ে চলাফেরা করতে বলেন। তিনি নিজে জঙ্গীবাদের দিকে পা বাড়াননি। তবে ফয়জুর তার বোনকে তার মতবাদে বিশ্বাসী চমন ওরফে সুমনের সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিল। ওই হামলার পর থেকে পলাতক সুমন নামের সেই তরুণকেও খোঁজা হচ্ছে। ফয়জুল হাসানকে জিজ্ঞাসাবাদে অনেক কিছুই এড়িয়ে গেছে বলে তাদের মনে হয়েছে। তারা ইতোমধ্যে ফয়জুরের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ও ট্যাব উদ্ধার করার পর ফরেনসিক পরীক্ষা করে তার কার কার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল সেই রহস্য উন্মোচন করার চেষ্টা করছেন বলে তদন্ত কর্মকর্তার দাবি। প্রসঙ্গত গত ৩ মার্চ শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে একটি অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টায় হামলায় চালায় ফয়জুর। হামলার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হামলাকারীকে আটক করে। জাফর ইকবাল বর্তমানে আশঙ্কামুক্ত অবস্থায় রাজধানীর সিএমএইচে চিকিৎসাধীন। এই হত্যার চেষ্টায় হামলার ঘটনায় দ্বিতীয় দিনের মতো রাজধানী ঢাকা, সিলেট ছাড়াও ছাত্র-শিক্ষক, প্রগতিশীল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, সমাবেশ করে হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচারে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আন্দোলন চলছে।
×