ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এক অনন্য ঘটনা ॥ সাম্প্রতিক উন্নয়ন ইতিহাসে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১১ মার্চ ২০১৮

এক অনন্য ঘটনা ॥ সাম্প্রতিক উন্নয়ন ইতিহাসে বাংলাদেশ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) জানিয়েছে, ২০২৪ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে বিদেশী বিনিয়োগ ও মানব উন্নয়নের ওপর জোর দিতে হবে। এক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য মোকাবেলাসহ সুশাসন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করছে সংস্থাটি। সিপিডি বলছে, এলডিসি থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশ হলে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বাংলাদেশ। এলডিসি থেকে বের হলে উচ্চসুদে ঋণ নিতে হবে। আবার বাণিজ্যসুবিধা কমে গেলে তা পুষিয়ে নিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশ যখন এলডিসি থেকে বের হচ্ছে তখন বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরিবেশ অনুকূলে নয়। তাই একটি উত্তরণকালীন কৌশল ঠিক করা উচিত বলে মনে করছে সিপিডি। নিম্ন মধ্য আয়ের দেশ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশ ও ২০২৪ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের যাত্রায় বাংলাদেশ। চলতি মাসেই আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে আবেদন করবে বাংলাদেশ। এ উপলক্ষে শনিবার রাজধানীর গুলশানে খাজানা রেস্টুরেন্টে একটি সংলাপের আয়োজন করে সিপিডি। এতে জানানো হয়, বাংলাদেশ এমন সময় উন্নয়নশীল দেশ হতে চলেছে যখন বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরিবেশ অনুকূলে নয়। স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ায় বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা থেকে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা (জিএসপি) পেয়ে আসছে। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে গেলে জিএসপি সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে রফতানিতে বিশেষ ভর্তুকি দেয়ার যে সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ, সেটি আর থাকবে না। এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নাম লেখার সঙ্গে সঙ্গে রফতানি করা পণ্যে অতিরিক্ত ৬.৭ শতাংশ শুল্ক বসবে। এতে বছরে রফতানি কমবে ২৭০ কোটি ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। আলাদা দুটি প্রবন্ধে এসব উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন সিপিডির দুই সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও মোস্তাফিজুর রহমান। সিপিডি সংলাপটি এমন সময়ে আয়োজন করল যখন চলতি সপ্তাহে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) থেকে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতার স্বীকৃতিপত্র আসার কথা রয়েছে। মিয়ানমার থেকে নতুন করে বাংলাদেশে প্রবেশ করা সাত লাখ রোহিঙ্গা অনেক হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিতে পারে; এমন উদ্বেগও প্রকাশ করা হয় সংলাপে। তাহলে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হবে না?- সংলাপে উঠে আসা এমন প্রশ্নে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমরাও চাই, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হোক। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাচ্ছে; সাম্প্রতিক উন্নয়ন ইতিহাসে এ এক অনন্য ঘটনা। তবে মনে রাখতে হবে, এর আগে যত দেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছেছে, তারা ছিল ছোট ছোট দেশ। তাদের জনসংখ্যা ছিল কম। উৎপাদনের পরিমাণও ছিল কম। তাদের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সব দেশে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর প্রবৃদ্ধির পতন হয়েছে। বৈদেশিক সাহায্য ও রেমিটেন্সের পতন ঘটেছে। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যেতে যেসব প্রস্তুতি নেওয়া দরকার, তারও একটি পথ নক্সা দেয়া হয়েছে সিপিডি থেকে। সিপিডির দুই সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কয়েক দশক ধরে আমরা রফতানি পণ্য শুধু পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল। এক পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে পণ্যে বৈচিত্র্য আনা জরুরী। বাংলাদেশে রাজস্ব আদায়ের হার দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় কম। অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ের ওপর জোর দিতে হবে। চীনের উদ্যোগে গঠিত এআইআইবি ব্যাংকসহ যেসব দেশ ও সংস্থা থেকে সহজশর্তে ঋণ পাওয়া যাবে, সেদিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর মাধ্যমে নতুন শিল্প গড়ে তুলতে হবে। বাড়াতে হবে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ। এলডিসি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর জিএসপি সুবিধা, সহজশর্তের ঋণ যাতে অব্যাহত থাকে সেজন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তাদেরকে বোঝানোর পরামর্শ দেন দেবপ্রিয় ও মোস্তাফিজুর রহমান। সংলাপে মোট তিনটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন সিপিডির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন, প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা গওহর রিজভী, ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন, ইউএনডিপির বাংলাদেশের আবাসিক সমন্বয়ক মিয়া সেপো ও সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। প্রথম অধিবেশনে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার বিষয়টি ছাপিয়ে আলোচনায় উঠে আসে দেশে সুশাসনের ঘাটতি, অসমতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়টি। রেহমান সোবহান তার বক্তব্যে বলেন, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করা জরুরী। দেশে সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে উল্লেখ করে রেহমান সোবহান বলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক সংস্থাগুলোতে ঘাটতিটা প্রকট’। এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ হওয়াটা কতটা টেকসই হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেন, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে যাচ্ছে এটা অনেক বড় অর্জন। আমাদের ধারাবাহিকভাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে। মাথাপিছু জাতীয় আয়ও বাড়ছে। তবে একই সময়ে দেখা যাচ্ছে অসমতা বাড়ছে। আয়ের বৈষম্য বাড়ছে। আমাদেরকে যেভাবেই হোক, অসমতা কমাতে হবে। এদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। তিনি বলেন, গত এক দশকে দেশে দারিদ্র্যের হার অনেক কমে গেছে। তবে পাল্লা দিয়ে সুশাসন নিশ্চিত করা যায়নি। আমাদেরকে সুশাসন বাদ দিয়ে এগুনো ঠিক হবে না। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ধারাবাহিকতাও জরুরী বলে মত দেন তিনি। ড. জাহিদ হোসেন তার বক্তব্যে বলেন, এলডিসি থেকে বের হলে রফতানিতে বড় ধরনের আঘাত আসবে। ৮ শতাংশ রফতানি কমে যাবে বলে আশঙ্কা তার। ড. দেবপ্রিয় তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, সরকার থেকে বলা হচ্ছে, ২০২১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হবে। কিন্তু কারিগরিভাবে এটি সঠিক নয়। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাবে ২০২৪ সালে। এর আগে তিন বছর করে মোট ছয় বছর জাতিসংঘ বাংলাদেশের তিনটি সূচকে নজরে রাখবে। ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশে যাওয়ার ঘোষণা আসবে। যদিও বাংলাদেশ সব ধরনের সুবিধা পাবে ২০২৭ সাল নাগাদ। তার মতে, দেশের ভেতরে যদি স্থিতিশীলতা না থাকে, ঐকমত্য না থাকে, তাহলে এলডিসি থেকে উত্তরণের সুফল পাওয়া কঠিন হবে। দ্বিতীয় অধিবেশনে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, ভৌগোলিকভাবে রাজনীতি ও অর্থনীতিতে পরিবর্তন ঘটছে। বাংলাদেশেও অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বেশ চালেঞ্জ হবে। তবে সব কিছু ছাপিয়ে যাবে ১১ লাখ রোহিঙ্গা। এটা শুধু অর্থনীতির ওপরই প্রভাব পড়বে না। এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতাও নষ্ট হতে পারে। দিনের দ্বিতীয় সেশনে ‘উত্তরণের পথ ও আরও কিছু প্রসঙ্গ’ শীর্ষক এই অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান ও গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। এই অধিবেশনের সভাপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হলে আমাদের বেশ কিছু সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হবে। এই ঘাটতি পূরণে আমাদের সামনে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। বর্তমানে দেশে বেসরকারী বিনিয়োগ জিডিপির ২২ শতাংশের ঘরে। তা বাড়াতে হবে। কেনো বিনিয়োগ বাড়ছে না তা সরকারকে খুঁজে বের করতে হবে। উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। বিদেশী ঋণের পরিমাণ আমাদের অনেক কম। তা কেন বাড়ানো যায় না দেখতে হবে। শ্রমিক পাঠানোর সংখ্যা প্রতিবারই বাড়ছে। দক্ষ শ্রমিক যাচ্ছে কেমন তাও দেখতে হবে। কিন্তু আয়ের হিসাবে সেভাবে রেমিটেন্স বাড়ছে না। তিনি বলেন, ব্যবসায়ী ও সরকারী হিসেবে আমাদের রফতানিকৃত পণ্যের সংখ্যা হচ্ছে ৩০০টি। কিন্তু মাত্র একটি পণ্যর ওপর নির্ভর করছে ৮০ শতাংশ। বাকিগুলো কেন বেশি রফতানি করা যাচ্ছে না। রফতানি পণ্যর এই একক নির্ভরতা দ্রুত কমিয়ে আনতে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগ প্রয়োজন। রফতানি পণ্য বহুমুখীকরণ করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে মির্জ্জা আজিজুল বলেন, ব্যবসায় পরিবেশের সহায়ক দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক নিচে। এখানে ব্যবসার খরচ অনেক বেশি। কিন্তু স্বল্পোন্নত অন্যান্য দেশে বাংলাদেশের চেয়ে ব্যবসায়িক খরচ অনেক কম। বিষয়টি সরকারের নজরে নিতে হবে। এছাড়াও ব্যবসায়িক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। তা হলেই আমরা যথাসময়ে উন্নয়নশীল দেশে যেতে পারব। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. ফরাসউদ্দিন বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী, নির্দিষ্ট সময়ে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে। আমাদের বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। সরকারকে খুঁজে বের করতে হবে, বেসরকারী বিনিয়োগে ব্যবসায়ীরা এতটা অনাগ্রহী কেন। অর্থপাচার ঠেকাতে হবে। সরকারী ব্যবস্থাপনা, পর্যবেক্ষণ, মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ ও উৎপাদনশীলতা এই কয়টি বিষয়ে সরকারের নীতিমালা স্পষ্ট থাকতে হবে। এই চারটি বিষয়ে সরকারকে সব সময় সজাগ থাকতে হবে। পর্যবেক্ষণ নীতি কেমন হবে তা ঠিক করতে হবে। তিনি বলেন, শিল্প কারখানায় নতুন প্রযুক্তি সংযোজিত হচ্ছে। এতে কিছু মানুষ কর্ম হারাবে। তাদের জন্য অর্থনীতির আরও অনেক খাত রয়েছে, তাতে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব। পাশাপাশি দক্ষ কর্মী তৈরি করতে হবে। এজন্য মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরেই কর্মমুখী (ভোকেশনাল) শিক্ষার সিলেবাস সংযোজন করতে হবে। কারিগরি জ্ঞাননির্ভর নতুন কর্মী তৈরি করতে এর বিকল্প নেই। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি বলেন, বেশ কয়েকটি সূচকে বাংলাদেশ ভাল করছে। কিন্তু কর্মসংস্থানের সূচকটি ভাল নয়। কর্মসংস্থান তৈরিতে পণ্যর বহুমুখীকরণ প্রয়োজন। রফতানি পণ্যে বাইসাইকেল, আমাদের ফুল, সবজি, মাছ ও রান্না করা খাবার সহজেই যোগ করা যেতে পারে। এজন্য সরকারের ভাবতে হবে বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গবর্নর।
×