ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চা শ্রমিকদের দুঃখ কথা

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ১১ মার্চ ২০১৮

চা শ্রমিকদের দুঃখ কথা

বাংলাদেশের ১৬৫টি চা বাগানের মধ্যে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল উপজেলায় বেশিরভাগ চা বাগান রয়েছে। চা শ্রমিকরা দিন রাত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দীর্ঘদিন যাবৎ চা উৎপাদনে নিবেদিত। তাদের জীবন ঘুর পাক খাচ্ছে দারিদ্র্যতার দুষ্টচক্রে। কয়েক দশক পেরিয়ে গেলেও তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন আসেনি। তারা জাতীয় উন্নয়নের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে নিজেদের উন্নয়নকে সম্পৃক্ত করতে পারেননি। পারেননি নিজেদের জীবনকে গোছাতে। যা খুবই বেদনাদায়ক। জানা গেছে, ১৩০ বছর আগে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক প্রধানত দক্ষিণ ভারত, বাকুরা, উত্তর প্রদেশ, মাদ্রাজ, আসাম, উড়িষ্যা, তামিলনাডু থেকে এই শ্রমিকদের চা বাগান করতে এ দেশে নিয়ে আসে। দীর্ঘ সময় ধরে কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন রকম বৈষম্যের শিকার হতে হতে তাদের জীবন এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যে স্থান থেকে তারা ফিরতে পারছে না। এই জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কোন বেসরকারী সংস্থা বা কোনো সরকারী সংস্থা কেউ এগিয়ে আসছে না। কেন এই বিমাতাসূলভ আচরণ! চা বাংলাদেশের এক অর্থকরী ও রফতানি পণ্য। জাতীয় অর্থনীতিতে জন্ম থেকে চা শিল্প ইতিবাচক ভূমিকা রেখে আসছে। তাই যে শ্রমিকরা এ দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে তাদেরকে কোন অবস্থায় অবহেলা করা উচিত নয়। এদেরকে নিয়ে ভাবতে হবে কিভাবে এ শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে এদের উন্নয়ন করা যায়। তা না হলে এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা কষ্টসাধ্য হবে। চা শ্রমিকদের থাকার ভাল বাসস্থান নেই চা বাগানে ভ্রমণ করলে দেখতে পাওয়া যায়, একই বাগানের শ্রমিকের বাসস্থান একেক রকমের। যে এলাকায় তাদের বাসস্থান তাকে লেন বলা হয়। একেক চা বাগানের ঘরের একেক রকম ডিজাইন এবং একেক রকম কাঁচামাল দিয়ে তৈরি। কোন বাগানে দেখা যাবে সকল ঘরগুলো ছন ও বাঁশের তৈরি, মাটির দেয়াল, আবার কোন কোন বাগানে মাটির দেয়াল এবং টিনের ছাদ ও পাকা দেয়ালের তৈরি ঘর দেখা যায়। সব ক্ষেত্রে ভিটা/মেঝ স্যাঁতসেঁতে মাটির। একেক লেন বা সারিতে কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫টি বাড়ি থাকে। বাড়িগুলো এমনভাবে তৈরি যে, ঐ বাড়ির চৌহদ্দিতে একটি স্যানিটারি ল্যাট্রিন তৈরি করার জায়গা থাকে না। কোন কোন বাগানে দেখা যায় যে ঘরগুলো অনেক পুরনা মেরামতের কোন চিহ্ন নেই এবং কোন কোন বাগানে দেখা যায় ঘরগুলো নতুন। এই সমস্ত ঘরগুলোতে বসবাস করা মোটেও আরাম দায়ক নয়। বহু ঘরের আঙ্গিনা থেকে পানি যাওয়ার জন্য কোন ড্রেনেজ নেই। তাই বছরের ৬ মাসই বাড়ির আশপাশে কর্দমাক্ত ও স্যাঁতসেঁতে থাকে। বাড়ির আশপাশ মশা প্রজননের খুবই উপযুক্ত। চা শ্রমিকদের অনেকেরই মশার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মশারি ক্রয় করার সামর্থ্য তাদের নেই। শ্রীমঙ্গল কমলগঞ্জ ম্যালেরিয়া আক্রান্ত অঞ্চল বলে স্বীকৃত। এখানকার প্রতি ঘরেই থাকে ছোট ছোট দুইটি কক্ষ। এক কক্ষ পরিবারের সকল সদস্যকে ঘুমানোর জন্য এবং অন্য কক্ষটি বরাদ্দ থাকে রান্নার জন্য। পিতা-মাতাসহ অন্য সকল সদস্যই একসঙ্গে এক মেঝেতে ঘুমায়। যখন কোন পরিবারের কোন ছেলে বিয়ে করে তখনই সমস্যা দেখা দেয় কারণ তাদের ঘুমানোর জন্য আলাদা কোন ঘর থাকে না, সে পর্যায়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ছন/বাঁশ এর ছাদ দিয়ে বাড়ির সীমানার মধ্যে আর একটি ঘর তৈরি করতে হয়। তাও সকল পরিবার দারিদ্র্যতার কারণে তৈরি করতে পারে না। চা বাগানে সাধারণত ১০ফুট প্রস্থ এবং ২১ ফুট চওড়া ঘর দেখতে পাওয়া যায়। অধিকাংশ চা শ্রমিকের ঘরে ঘুমানোর খাট নেই। সাধারণত তারা মেঝেতে ঘুমায়। এতে তাদের কোন দুঃখবোধ নেই এটাই তাদের জীবন বলে তারা মনে করে। বংশানুক্রমে চা শ্রমিকরা চা বাগানে বাস করছে কিন্তু তাদের থাকার ঘরের জায়গার মালিকানা তাদের নয়। কোন শ্রমিক মারা গেলে বা অবসর নিলে ঐ ঘরটি অন্য শ্রমিকের জন্য খালি করে কোম্পানিকে সপে দিতে হয়ে। বাংলাদেশ ভূমি আইনে আছে কোন ব্যক্তি যদি সরকারী খাস ভূমিতে একটানা বার বছর বা তারও অধিক সময় ধরে বসবাস করে তবে সে ঐ জায়গার মালিক হয়ে যায়। কিন্তু চা বাগানে এর কোন প্রয়োগ নেই। যদিও তারা প্রতিবার জাতীয় নির্বাচনে ভোটার হিসেবে ভোট দেয়। চা বাগানের অধিকাংশ শ্রমিক ঘুমানোর জন্য কোন রকম লেপ তোষক ব্যবহার করতে পারে না। তোষকের পরিবর্তে তারা জুট ব্যাগ নিচে দেয় এবং লেপের পরিবর্তে তারা আর একটি জুট ব্যাগ উপরে দিয়ে ব্যবহার করে। কোন শ্রমিকের বাড়িতে কোন ধরনের আসবাবপত্র পাওয়া যায় না, কদাচিৎ এক লাইনে একটি বাড়ি পাওয়া যাবে যেখানে একটি ঘুমানোর খাট ও একটি বসার চেয়ার আছে। চা বাগানের শ্রমিকদের বাড়িতে বিদ্যুত সরবরাহ আছে কিন্তু বিদ্যুতের ভোল্টেজ খুবই কম, বিদ্যুতের বিল পরিশোষ করতে না পারায় অনেক শ্রমিক বিদ্যুত ব্যবহার করতে পারে না। একটি বিদেশি কোম্পানির চা বাগানের শ্রমিক ফুল চাঁদ রবি দাশ বলেন, বৃষ্টির দিনে ছাদ দিয়ে পানি পড়ার কারণে রাতে আমাদেরকে কয়েক বার ঘুমানোর স্থান পরিবর্তন করতে হয়। কারণ ছাদের ছিদ্র দিয়ে পানি পড়ে। স্যানিটেশন ব্যবস্থা নেই পূর্বেই বলা হয়েছে চা বাগানের কোন শ্রমিকের বাড়িতে ল্যাট্রিন বসানোর কোন জায়গা নেই। তাছাড়া অজ্ঞতা হেতু কেউ ল্যাট্রিন বসানোর প্রয়োজন মনে করে না। সকাল বেলা সকলে পার্শ্ববর্তী জঙ্গল, ছড়ার পাড়, এবং চারা গাছের গোড়ায় প্রাতঃকাজ শেরে আসে। শতকরা ১০০% শ্রমিক ল্যাট্রিন থেকে এসে সাবান ব্যবহার করে না। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এখানে সেখানে খালি জায়গায় পায়খানা করে পরিবেশ দূষণ করে চলেছে। বর্তমানে চা শ্রমিকরা নলকূপের পানি পান করে, কুয়ার পানি দিয়ে বাসন পত্র ধোয়া মোছা করে। পানি বাহিত রোগ সম্পর্কে তাদের ধারণা খুবই নিম্ন পর্যায়ের। চা বাগানের কর্তৃপক্ষ আজ পর্যন্ত চা শ্রমিকদের জন্য পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে পারেনি। চা বাগানের অধিকাংশ লেইনে ঘোরাঘুরি করলে দেখা যাবে, বিভিন্ন ধরনের পানির কুয়া, কোনটা ময়লা আবর্জনায় ভর্তি, কোনটা সদ্য নির্মিত, কোনটা ব্যবহার হচ্ছে, কোনটা ব্যবহার হচ্ছে না যা শ্রমিকরা নিজেই ব্যবহারের জন্য তৈরি করে থাকে। চা শ্রমিকদের প্রধান সমস্যা সাধারণত সকল চা বাগানে চা শ্রমিকদের সমস্যা প্রায় একই রকম। শতকরা ৯৮ ভাগ শ্রমিক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, তারা বাংলাদেশের সবচেয়ে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী। নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত এদের জীবন। চা শ্রমিকদের জন্য এনজিও বা সরকারী কোন বাস্তবসম্মত কর্মসূচী নেই-যা ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় উৎসাহ দেয়ার মতো। এসব স্থানে কোন ব্যাংকের শাখাও নেই। অর্থাৎ ব্যাংকিং সুযোগ-সুবিধা থেকে এরা বঞ্চিত। চা বাগান ছাড়া আর কোন উৎস থেকে আয় করার কোন সুযোগ নেই তাদের। শিক্ষা নেয়ার সুযোগ খুবই সীমিত। বেকারদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা একেরারেই কম। গার্ডেন ম্যানেজমেন্টের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা শিশু জন্মের হার অত্যধিক মদ্যপানে নেশা, সকল পুরুষ শ্রমিকরা নিয়মিত মদ পান করে। সবদিকেই স্বাস্থ্যগত সমস্যা দৃশ্যমান ভূমির মালিকানা চা শ্রমিকদের নেই। অধিকাংশ শিশু অপুষ্টির শিকার। দেশের প্রধান জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা বাঙালী নতুন বসবাসকারী এবং পুরনো চা শ্রমিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, চা বাগানে গাছ কাটার হিড়িক, বিশেষ করে ব্যক্তি মালিকানা চা বাগানে। চলবে... লেখক : আমেরিকা প্রবাসী
×