ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ বিভ্রান্ত সমাজ জটিল রাজনীতি, উত্তরণ কোথায়?

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ১১ মার্চ ২০১৮

সিডনির মেলব্যাগ ॥ বিভ্রান্ত সমাজ জটিল রাজনীতি, উত্তরণ কোথায়?

জাফর ইকবালের ওপর হামলার নিন্দা করেনি বিএনপি। উল্টো আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করছে তারা। যেকোন সময় যেকোন কিছু ঘটলেই এটা হয়। কে না জানে এতদিন ধরে দেশের রাজনীতিতে যে, উল্টোস্রোত তার মূল চালিকাশক্তি বিএনপি। এখনও সে ধারা বজায় রেখেছে তারা। জঙ্গী বা সন্ত্রাসী যাই বলেন না কেন আখেরে দুর্গ ঐ একটাই। তাই আমাদের বুঝতে হবে এদের রাজনীতি আসলে কি চায়? দেশের রাজনীতির বিষফোঁড়া আসলে কি বা কারা? এই প্রশ্নের উত্তর জাতির জানা জরুরী। আমি মনে করি, আমাদের ইতিহাস বিকৃতি আর আমাদের জাতিকে পাকিকরণের গুরু বিএনপি যে লোকসান করিয়েছে জামায়াতও তা পারেনি। মনে রাখতে হবে দেশ স্বাধীনের পর জামায়াত ছিল না। আর এদিকে উচ্চাভিলাষী জিয়াউর রহমান তার স্বার্থে গতায়ু মুসলিম লীগ আর এদের দলে টেনে এনেছিলেন। পুরনো কাসুন্দি থাক। বলছিলাম আমাদের যে নতুন প্রজন্ম তারা আজ আওয়ামী বিএনপির দ্বন্দ্বে ইতিহাস না জানলে আখেরে কার লাভ? এই যে নিয়ত ইতিহাস বিকৃতি এর বাইরে কত প্রমাণ কত নজির আর কত কত কাহিনী। আমরা কি সেগুলো নবপ্রজন্মের কাছে তুলে ধরছি। দেশ স্বাধীন হয়েছে প্রায় অর্ধশতাব্দি আগে। এখনও আমাদের ইতিহাস বিকৃতি হানাহানি আর লড়াই শেষ হয়নি। আজকের প্রজন্ম এই লড়াই বা নিজেদের বিকৃতির কালে জানেই না কত গভীর আর মমতায় ভরা ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। আমরা নিরস্ত্র দুর্বল আর ভীতি নামে পরিচিত এক জাতি। লড়াই করেছিলাম যুদ্ধবাজ উন্মাদ এক সেনাবাহিনীর সাথে। পুরনো ইতিহাস মানে দুটো বিবদমান দলের কাহিনী না। এটা স্বচ্ছ আর জলের মতো পরিষ্কার বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের চাকায় ধাবমান। যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রাণপণ চেষ্টা করে ইতিহাস শুদ্ধ করার কাজ করেছেন বলে আমরা তাঁকে কোথায় সমর্থন দেব সেটা না করে রীতিমতো বিরোধিতা করে চলেছি। তিনি যখন প্রায়ই সংসদে দাঁড়িয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাবার কথা বলেন আমরা বুঝে নেই এর মর্মার্থ কি। কি নিষ্ঠুর বাস্তবতা আমাদের। ব্যক্তিজীবনে ধর্মের আচরণের বা নিয়মের সঙ্গে থাকা আমরাই বেনিয়মী একজনকে নেতা বানাতে বদ্ধপরিকর। যিনি নিয়ম মানেন যিনি মূলত ধার্মিক তাঁর কাছে বিশ্বাস জমা রাখার ভেতর নেই আমরা। কেন এই হটকারী প্রবণতা? কদিন আগে সামাজিক মাধ্যমে শহীদ আলতাফ মাহমুদের একমাত্র সন্তান শাওন মাহমুদ পাকিস্তানী খেলোয়াড় শহীদ আফ্রিদিকে নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। তাতে তিনি দুঃখ ও রাগ প্রকাশ করে ঝাড়ি দিয়েছিলেন এই খেলোয়াড়কে। যে কিনা অনায়াসে বাংলাদেশকে তার নিজের দেশ বলছে। ভালবেসে কেউ আমাদের দেশকে নিজের দেশ ভাবলে আপত্তির কিছু থাকে না। বরং আমরা আনন্দিত হই। কিন্তু হুমায়ূন আজাদের সেই অমোঘ বাণীর কথা ভুললে চলবে না। যেখানে তিনি বলেছিলেন সাপ আর পকিস্তানীদের বিশ্বাস করা সমতুল্য। এটি কোন ভাবাবেগের কথা না। এর পেছেন হাজারো যুক্তি আছে। যারা এত বছর পরও আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের পরাজয় ও আত্মসমর্পণ মানতে পারে না তাদের আমরা নিজেদের লোক ভাববো কিভাবে। এই সেদিনও ইমারন খান তার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন যুদ্ধাপরাধী বিচার নিয়ে। আমাদের দেশে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে তাদের মাথা নষ্ট হয়ে যায় খেয়াল করবেন খালেদা জিয়া কিংবা ওয়ান ইলেভেনের সময় জঙ্গী তৎপরতা রোধ কিংবা বিচার নিয়ে তারা কোন কথা বলেনি। মূলত তাদের আক্রোশ আওয়ামী লীগের ওপর, যারা পাকিস্তান থেকে এই মাটিকে আলাদা করার সংগ্রাম করেছিল। শাওন কোথায় ভুল বলেছিলেন? তিনি বলার পরপরই দেখলাম গা বাঁচানোর জন্য মেহের আফরোজ শাওন সেই স্ট্যাটাসটি উদ্ধার করে জানিয়ে দিলেন এই শাওন তিনি নন। এই যে হটকারী মনোভাব এটাই প্রমাণ করে আমরা এখন পাকিদের এবং তার দালালদের ভয় পাই। আজ তাই সময় এসেছে আমাদের ইতিহাস নিয়ে নিজেদের বুকের পাটা শক্ত করে দাঁড়াবার। দু’দিন পর বিজয়ের মাস বলে আমরা যখন হৈ চৈ করব তখনও দেখবেন মন জয় করা কোন পাকি ক্রিকেটারের জন্য প্যাকার্দ হাতে ছুটছে নারীর দল। এই কারণে আমাদের প্রকৃত ইতিহাস জানা দরকার। যেসব মানুষ যেসব মনীষা আর যেসব কাহিনীর জন্য বাংলাদেশ উজ্জ্বল তার গৌরব চিরজাগরুক সেগুলো মুছে কেউ এগুতে পারবে না। আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধে জড়িত ত্যাগী কত মানুষের জীবন কাহিনী অজান্তে হারিয়ে যায়। তারুণ্য জানেই না। এই যে অস্ট্রেলিয়ায় সায়িত ডাচ অজি বীরপ্রতীক ওডারল্যান্ড তার মতো ক’জন মুক্তিযোদ্ধা আছে আমাদের? যিনি পঁচাত্তরের পর বঙ্গবন্ধু হত্যায় উল্লাস করার কারণে কর্মী ছাঁটাইয়েও পিছপা হননি। এদের কাহিনীর প্রসার হোক। তখন কোথায় ভেসে যাবে ঘোষক আর কোথায় থাকবে অপইতিহাস। শেষ করব এমনই এক বীরের কাহিনী দিয়ে যার কর্ম আর নিবেদনে আমাদের যুদ্ধ জয় সম্ভবপর হয়ে উঠেছিল। আজ যখন আমরা এত মিডিয়া যোগাযোগের পরও রোহিঙ্গ্যা সমস্যা সমাধানে বিশ্বের মনোযোগ সেভাবে আকর্ষণ করতে পারি না তখন এঁদের জানা ও চেনা জরুরী বৈকি। সে সময় যারা আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁদের অবদান আর সমর্থন ছাড়া আমাদের জয় ছিল প্রায় অকল্পনীয়। তখন এমন মিডিয়া বা যোগাযোগ ছিল না। ছিল না মোবাইল কম্পিউটার কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জয়জয়কার। তারপর ও সেই সুদূর ফরাসী দেশের এই মানুষটি আমাদের হয়ে লড়তে চেয়েছিলেন। সে দেশের মন্ত্রী ছিলেন তিনি। দশ বছর মন্ত্রী থাকা সত্তর বছর বয়সে পা দেয়া মানুষটি বলেছিলেন, আমাকে একটি ফাইটার বিমান দাও, আমি বাংলাদেশের হয়ে যুদ্ধে করব। আমাদের মুক্তি সংগ্রামের আগেও তিনি দেশে দেশে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে দাঁড়িয়েছিলেন। নিজ দেশের সরকারের বিরুদ্ধে ভূমিকা রেখেছিলেন কম্বোডিয়ায়। অনেকে হয়তো জানেন না কম্বোডিয়ার নাম কম্পুচিয়া সে কারণেই। দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে অতিথি হয়ে আসেন তিনি। আমার স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে তো আমি নিশ্চিত চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির ভিত্তি প্রস্তর উৎকীণ করেছিলেন এই মহতী মানুষটি। তাঁর যুদ্ধে যাবার ইচ্ছে কতটা আন্তরিক ছিল তার প্রমাণ দেড় শতাধিক ফরাসী যোদ্ধা নিয়ে গঠিত বাহিনী। পরে শক্তিশালী ভারত যুদ্ধে জড়িত হবার কারণে তিনি সে পরিকল্পনা থেকে সরে আসেন। বাংলাদেশ সফরের সময় আহত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে গিয়ে বেদনার্ত মালরো প্রমাণ করেছিলেন তিনি আমাদের কতটা আপন। বলাবাহুল্য, তাঁর মতো মহতী মানুষদের কারণেই ফ্রান্সের মতো দেশ আপন উজ্জ্বলতায় আমাদের গোড়াতেই স্বীকৃতি দিয়েছিল। স্বনামধন্য লেখক বহু পুরস্কার জয়ী আঁদ্রে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণ হিসেবে বলেছিলেন, এর কারণ শুধু এই নয় যে, বাংলাদেশ এখন ‘সবচেয়ে নির্মম গণহত্যার শিকার আর সবচেয়ে হুমকির মুখে থাকা’ এক জনপদ। কারণ এটাও যে, ‘আপনারা মহান ভারতীয় সভ্যতার অংশ যা কিনা তিন হাজার বছর পুরনো আধ্যাত্মিকতায় সমৃদ্ধ এক সভ্যতা।’ প্রশ্ন রাখি, আমরা কি তাঁকে আদৌ মনে রেখেছি? মনে রেখেছি সম্প্রতি শততম জন্মবাষির্কীর ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনীকে? যিনি না হলে আমরা এই দেশ আদৌ পেতাম কিনা সন্দেহ জাগে। যে সভ্যতা যে আলোর কথা আঁদপে মালরোরা বলেছিলেন আজ আমরা তা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি। আমাদের মার্জনা করবেন আঁদ্রে। আমরা আপনাদের মনে না রাখলেও এই দেশ মাটি পতাকা ভালবাসা যতদিন আলোময় থাকবে ততদিন আপনারা বেঁচে থাকবেন বাংলাদেশের ইতিহাসে। বেঁচে থাকবেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীও। শুধু প্রশ্ন এই শেখ হাসিনা না থাকলে এই দেশ এই ইতিহাস আর সমাজ থাকবে তো? [email protected]
×