ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

গোলাম কুদ্দুছ

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ॥ ১১ মার্চ ১৯৪৮ এবং বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ১১ মার্চ ২০১৮

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ॥ ১১ মার্চ ১৯৪৮ এবং বঙ্গবন্ধু

রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু বাংলাকে ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লড়াই দীর্ঘদিনের। এই লড়াইয়ে রাজন্যবর্গ, কবি, লেখক, শিক্ষিত শ্রেণী বিভিন্ন সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বাংলা ভাষার বিকাশ ও প্রচলনে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্-এর বঙ্গদেশে আগমন এবং সিংহাসন দখলের বিবরণী প্রকাশিত হয়। সেনাপতি সৈয়দ হোসেন ‘আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্’ নাম ধারণ করে হিজরি ৮৯৯ এবং খ্রিস্টাব্দ ১৪৩৯ সালে গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর ২৬ বছরের শাসনামলে রাজ আনুকূল্য পেয়ে বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। এ সময় বাংলা ভাষায় বহু গ্রন্থ প্রণীত হয়। সে সময় ফতেয়াবাদ মুল্লুকের জমিদার ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী অর্জুন। ফতেয়াবাদ মুল্লুকের অন্তর্গত ফুল্লশ্রী গ্রামের বিজয়গুপ্ত মনসামঙ্গল রচনা করেছিলেন। সুলতান হোসেন শাহ্-এর সেনাপতি পরাগল খাঁর নির্দেশে কবীন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারতের আদিপর্ব থেকে স্ত্রী-পর্ব পর্যন্ত বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। এ সময় মালাধর বসু ভগবতের দশম ও একাদশ স্কন্ধ বাংলায় অনুবাদ শুরু করেছিলেন। আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্-এর পরবর্তী তাঁর বংশের অন্যান্য সুলতানও বাংলা ভাষার বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করতে শুরু করেন। পরবর্তীকালে আরাকান রাজসভার আনুকূল্য পেয়ে বাংলা ভাষার বেশ কয়েকজন বিখ্যাত কবি তাঁদের কাব্যগুণে ভাষার বিকাশ ও বিস্তৃতিতে যেমনিভাবে অবদান রেখেছেন, একইভাবে বাঙালী মুসলমান সমাজেও নাড়া দিয়েছিলেন। ভিনদেশী ভাষায় বলতে-লিখতে এবং কাজকর্ম চালাতে অভ্যস্ত শিক্ষিত মুসলমান শ্রেণী কিছুটা হলেও মাতৃভাষার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। ভারত বিভক্তি ও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা দ্বি-শত বছরের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য বহু মানুষ নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিল। মানুষের সংগ্রাম ও রক্তদান বৃথা যায়নি। অবশেষে ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অধিবেশনে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন পাস হয়। এর পরদিন ১৯ জুলাই ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতীয় উপমহাদেশকে বিভক্ত করে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান জন্মলাভ করে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গ, পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়। ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন করাচিতে নবনির্বাচিত গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কাছে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। লিয়াকত আলী খান নবপ্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। অবিভক্ত বাংলার চট্টগ্রাম, ঢাকা, রাজশাহী বিভাগের কিয়দংশ, খুলনা জেলা, বনগাঁ বাদে যশোর জেলা এবং করিমগঞ্জ মহকুমা বাদ দিয়ে সিলেট জেলা নিয়ে পূর্ববঙ্গ গঠিত হয়। তখন এই প্রদেশের আয়তন ছিল ৫৫১২৬ বর্গমাইল এবং লোকসংখ্যা ছিল ৪ কোটি ১৯ লাখ। পশ্চিম পাকিস্তানের লোকসংখ্যা ছিল ২ কোটি ৪১ লাখ। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৬ আগস্ট তিনি মন্ত্রিসভা গঠন করেন। মন্ত্রীরা হলেন নুরুল আমিন, আবদুল হামিদ, হাসান আলী, হামিদুল হক চৌধুরী, সৈয়দ মুহম্মদ আফজাল, মুহম্মদ হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী ও মফিজউদ্দিন। ভবিষ্যত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবি উচ্চারিত হয় ব্রিটিশ কর্র্তৃক ভারতবর্ষ ভাগ করে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আলাপ-আলোচনা থেকে। ১৯ মে ১৯৪৭ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, হায়দরাবাদে ‘মজলিস-এ-এত্তেহাদুল মোছলেমিন’-এর বার্ষিক অধিবেশন উপলক্ষে আয়োজিত এক উর্দু সম্মেলনে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির অন্যতম নেতা চৌধুরী খালেকুজ্জামান ভবিষ্যত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। চৌধুরী খালেকুজ্জামানের এ বক্তব্যের প্রায় দু’মাস পর ১৯৪৭ সালের ১৪ জুলাই আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ ভবিষ্যত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার পক্ষে জোরালো বক্তব্য দেন। চৌধুরী খালেকুজ্জামান এবং ড. জিয়াউদ্দিনের বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় বাঙালী মুসলমান লেখকদের মধ্যে। সর্বপ্রথম এ সকল বক্তব্যের বিরোধিতা এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন সে সময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সওগাত’ ও ‘শিশ সওগাত’-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আবদুল হক। এ সময় আবদুল হক ভবিষ্যত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার পক্ষে নানা যুক্তি উপস্থাপন করে ৪টি প্রবন্ধ লিখেন। তিনটি নিজের নামে এবং একটি মিসেস এম এ হক ছদ্ম নামে। প্রথম প্রবন্ধটি দৈনিক ইত্তেহাদে ১৯৪৭ সালের ২২ ও ২৭ জুন, দ্বিতীয়টি দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ৩০ জুন, তৃতীয়টি ইত্তেহাদে ২৭ জুলাই এবং চতুর্থটি ৩ জুলাই ‘বেগম’ পত্রিকায় মিসেস এম এ হক নামে। আবদুল হক তাঁর প্রতিটি প্রবন্ধেই ভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদা, গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং অকাট্য যুক্তি দিয়ে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন। তাঁর বহু যুক্তি বর্তমান সময়েও সমান প্রযোজ্য। ২৯ জুন ১৯৪৭ ইত্তেহাদে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ ‘বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব’-এ তিনি লিখেন- ‘আমরা কেন আমাদের দেশে ইংরেজী-উর্দু-হিন্দী বলতে বাধ্য থাকব? আমাদের দেশে যারা বাস করে সেসব ইংরেজ বা উর্দু-হিন্দী ভাষীরা কেন বাংলা শিখতে বাধ্য হবে না? আমার মত এই যে, এ দেশে যেসব অভারতীয় বা অবাঙালী বাস করবে, তাদের বাংলা শিখতে হবে, যদি তারা এদেশে বাস করতে চায় এবং আমাদের সঙ্গে চলতে চায়। বাংলা শেখা তাদেরই গরজ। তাদের জন্য ইংরেজী-উর্দু-হিন্দী শেখা আমাদের গরজ নয়, বরং আমাদের পক্ষে ঘোর অমর্যাদাকর। আন্তর্জাতিক সম্বন্ধের জন্য এবং আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংযোগের জন্য যতটুকু ইংরেজী-উর্দু-হিন্দী শেখা দরকার, শুধু ততটুকুই আমরা শিখব এবং অন্তত ততটুকু বাংলা পৃথিবীর জাতিগুলোকেও শিখতে হবে।’ লেখক আবদুল হকের প্রবন্ধের পরপরই ২০ জুলাই ১৯৪৭ ইত্তেহাদে মাহবুব জামাল জাহেদীর ‘রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক প্রস্তাব’ নামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়। জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৪৭ সালের ২৯ জুলাই দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লিখেন। আলোচ্য প্রবন্ধে তিনি রাষ্ট্রভাষারূপে ইংরেজী, উর্দু, বাংলার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলেও চূড়ান্ত বিচারে বাংলার পক্ষেই অবস্থান গ্রহণ করেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিনের ‘উর্দু’কে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এছাড়া এ সময় মুহম্মদ এনামুল হক, কাজী মোতাহার হোসেন, এম ওয়াজেদ আলী, ফররুখ আহমদসহ বিশিষ্ট লেখকরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় এবং সংবাদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উচ্চারিত হয়। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা, মতাদর্শ এবং নেতৃত্বের প্রশ্নে ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম লীগ’-এর মধ্যে দুটো ধারা সৃষ্টি হয়। একটি ধারা ধর্মের নামে রাষ্ট্র পরিচালনা এবং ধর্মীয় অনুশাসন ও চিন্তা-চেতনা তথা ইসলামী তাহজিব-তমদ্দুনের ভিত্তিতে দেশ শাসনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই ধারায় পূর্ব বাংলায় নেতৃত্ব দেন মওলানা আকরম খাঁ ও খাজা নাজিমুদ্দিন। অপরদিকে মুসলিম লীগের উদারনৈতিক প্রগতিশীল অংশের নেতা ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম। এই প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসীদের একটি অংশ ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে ঢাকায় এক বৈঠকে কমরুদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক করে ‘গণআজাদী লীগ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলে। এই সংগঠন ‘আশু দাবি, কর্মসূচী, আদর্শ’ নামে একটি মেনিফেস্টো প্রকাশ করে। এতে ভাষা সম্পর্কে বলা হয়, ‘মাতৃভাষার সাহায্যে শিক্ষাদান করিতে হইবে। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষাকে দেশের যুগোপযোগী করিবার জন্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা করিতে হইবে। বাংলা হইবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ স্বাধীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মুহম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে পাকিস্তানের নতুন সরকার যাত্রা শুরু করে। যে ধর্মীয় বিশ্বাস ও আবেগের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের ব্যক্তিগত উচ্চাকাক্সক্ষা, ক্ষমতার মোহ এবং কোটারি স্বার্থের কারণে সে আশা দ্রুতই নিঃশেষ হতে শুরু করে। সাধারণ মানুষের মতামতকে তোয়াক্কা না করে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অবজ্ঞা করে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন নতুন শাসকগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ইচ্ছা এবং ধ্যান-ধারণা মতো পাকিস্তান শাসন করার নীতি গ্রহণ করে। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা না করে শুরুতেই পাকিস্তান সরকার মানিঅর্ডার, পোস্টকার্ড, মুদ্রায় শুধু উর্দু ও ইংরেজী ভাষা ব্যবহার শুরু করে। একই সময় পাকিস্তান নৌবাহিনীতে নিয়োগের ইন্টারভিউয়ের ক্ষেত্রেও বাংলাকে উপেক্ষা করা হয়। ফলে সচেতন, শিক্ষিত এবং প্রগতিবাদী মানুষের মাঝে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ১৪ আগস্টের পর মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম গ্রুপের কলকাতায় অবস্থানকারী কর্মীরা ঢাকায় এসে তখনকার প্রগতিশীল অংশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি যুব সংগঠন গড়ে তোলায় উদ্যোগী হয়। ১৫০ নং মোগলটুলিতে অবস্থিত মুসলিম লীগের অফিস প্রগতিশীল কর্মীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে। নানা প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান খান বাহাদুর আবুল হাসানাত আহমেদের বাড়ির বিশাল লন এবং হলরুমে যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সমগ্র পূর্ব বাংলা থেকে ৭ শতাধিক প্রতিনিধি এ সম্মেলনে অংশ নেন। তসদ্দুক আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার পর অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। উক্ত কর্মী সম্মেলনে ভাষা সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবও গৃহীত হয়। অনেক লেখককে এ প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যেতে দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে ভাষাসৈনিক গাজিউল হক বলেন, ‘৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা থেকে শুরু করে প্রায় পরদিন ভোর পর্যন্ত বিষয় নির্বাচনী কমিটির বৈঠক চলে। এই বৈঠকে পরদিনের গৃহীতব্য প্রস্তাবগুলো আলোচিত হয় এবং পরবর্তীকালে সাধারণ সভায় গৃহীত হয়। বিষয় নির্বাচনী কমিটির ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলোসহ প্রায় সব প্রস্তাবের আলোচনায় মুজিব ভাই বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেন।’ ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো ছিল নিম্নরূপ- ‘পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন-আদালতের ভাষা করা হোক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে সে সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেয়া হোক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হোক।‘ এখানে উল্লেখ্য, প্রস্তাবের শেষ অংশটি ‘জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হোক’ সংযোজনের প্রস্তাব করেন সেদিনকার আপোসহীন সংগ্রামী ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁকে সমর্থন করেন রাজশাহীর যুবনেতা আতাউর রহমান। সুতরাং এই কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র বাইশ দিন পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে যখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার প্রশ্নটি ওঠে এবং যে দাবি জানানো হয়, তখনও বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রথম সারির নেতৃত্বের কাতারেই ছিলেন। {সূত্র : ভাষা আন্দোলনের আর্থ-সামাজিক পটভূমি, সম্পাদনা- ড. আতিউর রহমান (চতুর্থ খ-), ভাষা আন্দোলনে : অংশগ্রহণকারীদের শ্রেণী অবস্থান, ড. আতিউর রহমান ও সৈয়দ হাশমী, পৃ. ৫১} ওই কর্মী সম্মেলনে ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাবটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্পর্কে লেখক ও গবেষক বদরুদ্দীন উমর বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন-আদালতের ভাষা করা হোক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে সে সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত প্রদানের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেয়া হোক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হোক।’ [সূত্র : পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (প্রথম খ-), লেখক : বদরুদ্দীন উমর, পৃ. ২৫] বদরুদ্দীন উমর প্রস্তাবকারী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উল্লেখ না করলেও তাঁর উত্থাপিত প্রস্তাবটিকে সামনে এনেছেন। এই তথ্যটিও প্রকৃত ইতিহাসের সত্য অনুসন্ধানের জন্য বিশেষভাবে গুরত্বপূর্ণ। অধ্যাপক মুস্তাফা নুরউল ইসলাম ওই কর্মী সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাব গ্রহণ এবং কর্মী সম্মেলন সফল করার জন্য শেখ মুজিবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে তিনি মত প্রকাশ করেছেন। তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠা ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের তরুণ শিক্ষক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে তাঁর বাসা ১৯নং আজিমপুরে ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামে একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ইসলামী তাহজিব ও তমদ্দুন প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী এই সংগঠন রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সংগঠনের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’- এ শিরোনামে একটি বই বংশালের বলিয়াদি প্রিন্টিং প্রেস থেকে মুদ্রিত এবং ১৯ নং আজিমপুর থেকে প্রকাশিত হয়। বইটিতে তিনটি প্রবন্ধ এবং সংগঠনের উদ্দেশ্য, আদর্শ ও কর্মসূচি সংক্ষিপ্তাকারে প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধ তিনটি লিখেন অধ্যাপক আবুল কাসেম, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন ও আবুল মনসুর আহমদ। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে গ্রহণের যৌক্তিকতা এবং জনমত সৃষ্টিতে তমদ্দুন মজলিস ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে তমদ্দুন মজলিসের সাহিত্য সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক এ এস এম নুরুল হক ভূঁইয়াকে আহ্বায়ক করে প্রথম ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে এ কমিটি গঠিত হলেও এতে অন্যান্য সংগঠনের প্রতিনিধিও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ১৮ নবেম্বর দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, পূর্ববঙ্গের প্রখ্যাত কবি, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, পেশাজীবী, শিক্ষাবিদদের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি স্মারকলিপি মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের কাছে প্রদান করা হয়। এই স্মারকলিপিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। করাচিতে পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলন পাকিস্তানের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ২৭ নবেম্বর করাচিতে এক শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে বিভিন্ন প্রদেশের কর্মকর্তা এবং প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। এতে পূর্ব বাংলা থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী ও শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদ অংশগ্রহণ করেন। এ সম্মেলনের উদ্দেশ্য, সিদ্ধান্ত ও প্রস্তাব নিয়ে বিভ্রান্তি এবং পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলন শেষে ৫ ডিসেম্বর মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার ও আবদুল হামিদ ঢাকায় এসে পৌঁছেন। বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তারা জানান যে, সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। ৬ ডিসেম্বর দৈনিক ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকায় এ সংবাদ প্রকাশিত হলে সর্বত্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে বেলা দু’টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা এ সমাবেশে অংশ নেয়। তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন মুনীর চৌধুরী, আবদুর রহমান, এ কে এম আহসান, কল্যাণ দাশগুপ্ত, এম আহমদ প্রমুখ। ওই সভায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে চারটি দাবি উত্থান করেন ডাকসুর ভিপি ফরিদ আহমেদ এবং সেগুলো সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। ছাত্রসভা শেষে এক বিরাট মিছিল সচিবালয়ে যায় এবং মন্ত্রীদের কাছে এ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা দাবি করে। শিক্ষা সম্পর্কিত প্রস্তাব নিয়ে সরকারের মন্ত্রীদের মধ্যে পারস্পরিক দোষারোপ প্রত্যক্ষ করা যায়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, শিক্ষক, সাংবাদিক এবং সুধীসমাজ কথিত প্রস্তাবের বিপক্ষে বিবৃতি এবং মতামত ব্যক্ত করেন। করাচির শিক্ষা সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাব নিয়ে যখন বিভ্রান্তি, সভা-সমাবেশ-বিক্ষোভ চলছিল সেই সময় কিছু অনাকাক্সিক্ষত হাঙ্গামা বাঙালীর মনে সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। আপাতদৃষ্টিতে ঘটনাগুলোকে সামান্য মনে হলেও বাঙালীদের প্রতি অবাঙালী এবং শাসকগোষ্ঠীর বিমাতাসুলভ আচরণের প্রমাণ মেলে। ছাত্র-শিক্ষক এবং সচেতন নাগরিকদের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল হতে শুরু করে যে, স্বাধীন পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু বাঙালীরা কি বঞ্চিত-লাঞ্ছিত হবে? ন্যায্য দাবির কথা বলতে গেলে কি বাঙালী বলে নির্যাতিত হতে হবে? তাহলে কি জাতিগত মর্যাদা এবং অধিকারের জন্য সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানেও নতুন করে সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে? আন্দোলনে নামতে হবে? এ সময় ৭ ডিসেম্বর ১৯৪৭ ঢাকা রেল কর্মচারীদের এক সভা ফজলুল হকের সভাপতিত্বে শুরু হয়। বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে সভায় বাঙালী-অবাঙালীদের মাঝে মতপার্থক্য এবং মারামারি সংঘটিত হলে ফজলুল হক সভা ত্যাগ করে চলে যান। এ সময় পরিকল্পিতভাবে প্রচার চালানো হয় যে, ফজলুল হক রেলওয়ের হিন্দু কর্মচারীদের নিয়ে পাকিস্তান ও উর্দুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন এবং হিন্দুদের বাংলাকে মুসলিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত চালাচ্ছেন। অপপ্রচারের প্রতিবাদে ওই দিনই সিরাজুদ্দৌলা পার্কে ফজলুল হকের সভাপতিত্বে এক সমাবেশ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিপর্বে পুরান ঢাকার একদল লোক চেয়ার ছোড়াছুড়ি করে সভাটি পণ্ড করে দেয়। বেশকিছু ছাত্র সে সময় নিগৃহীত হয়। চলবে... লেখক : গবেষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
×