ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

লাখো হেক্টর জমি ধু-ধু বালুচর

প্রকাশিত: ০৭:০০, ১০ মার্চ ২০১৮

লাখো হেক্টর জমি ধু-ধু বালুচর

স্টাফ রিপোর্টার, দিনাজপুর ॥ দিনাজপুরের খরস্রোতা পুনর্ভবা-আত্রাইসহ উত্তরাঞ্চলের শতাধিক নদ-নদী এখন পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। পানির অভাবে বিলীনের পথে অনেক নদ-নদীর অস্তিত্ব। ফলে এসব নদীতে কোন মাছ নেই, চলছে না কোন নৌকা। এ অবস্থায় নদী অববাহিকার লাখ লাখ মানুষ নিজেদের পেশা হারিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে এখন পথে বসেছে। পাশাপাশি পানি সঙ্কটের কারণে আবাদি জমির পরিমাণ কমে গিয়ে ধু ধু বালুচরে পরিণত হয়েছে প্রায় ১ লাখ হেক্টর জমি। অথচ এসব নদীতে এক সময় পানি প্রবাহের গতি এতটাই প্রবল ছিল যে, নদী পার্শ্ববর্তী হাজার হাজার হেক্টর জমি বছরের ৬ মাসই পানির নিচে তলিয়ে থাকত। নদীতে নৌ চলাচল স্বাভাবিক ছিল। মাঝি-মাল্লাদের কণ্ঠে ভেসে উঠত ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতি ও ভাটিয়ালি গানের সুর। নদীর ওপর নির্ভরশীল মৎস্যজীবীরাও পরিবার-পরিজন নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করত। অথচ বর্তমানে এ অঞ্চলের নদ-নদী মরে যাওয়ার উপক্রম হওয়ায় পাল্টে গেছে সার্বিক পরিস্থিতি। সরেজমিন জানা যায়, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও কুড়িগ্রামসহ উত্তরাঞ্চলের পুনর্ভবা, আত্রাই, তিস্তা, ঘাঘট, ধরলা, করতোয়া, দুধকুমার, স্বতী ঘাঘট, নীলকুমার, বাঙালী, বরাই, মানাস, কুমলাই, ধুম, বুড়িঘোড়া, সোনাভরা, হলহলিয়া, লহিতা, ঘরঘরিয়া, নলেয়া, জিঞ্জিরাম, ফুলকুমার, কাঁটাখালি, সারমারা, রায়ঢাক, যমুনেশ্বরী, চিতনী, মরা করতোয়া, ইছামতি, আলাই, কুমারীসহ শতাধিক নদ-নদী আজ মৃতপ্রায়। মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে এসব নদ-নদী। শুকনা মৌসুমে নদ-নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় চারদিকে ধু ধু বালুচরে পরিণত হয়েছে হাজার হাজার হেক্টর জমি। ফলে কমে গেছে আবাদি জমির পরিমাণ। দিনাজপুর সদর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে সবই নদী বেষ্টিত। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় এ জেলার কৃষক, জেলে, মাঝি-মাল্লারা বেকার হয়ে পড়েছেন। পুনর্ভবা ও আত্রাই নদীর বিশাল এলাকাজুড়ে জেগে উঠেছে বিশাল বিশাল বালুচর। পানির অভাবে আত্রাই প্রকল্পে আধুনিক সেচ সুবিধা থাকলেও পানি প্রবাহ না থাকায় আত্রাই অববাহিকার লাখ লাখ মানুষের জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়েছে। নদীর ওপর নির্ভরশীল এসব মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চরম হাহাকার। এক সময় আত্রাই ও পুনর্ভবা নদের পানি প্রবাহে এ অঞ্চলে সবুজের সমারোহ বিরাজমান ছিল। এসব বহমান নদীর দু’পারে ছিল অসংখ্য খেয়াঘাট। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ পারাপার হতো খেয়াঘাট দিয়ে। সেসব খেয়াঘাটের অনেক স্থানে এখন ব্রিজ নির্মাণ করে রাস্তাঘাট করা হয়েছে। গঙ্গাচড়া উপজেলার আলমবিদিতর, সদর থেকে পীরগাছা উপজেলার প্রায় ৮০ কিলোমিটার বিস্তৃত ছিল মানাস নদ। বর্তমানে এর কোন অস্তিত্ব নেই। একই অবস্থা ঘাঘট নদের। ঘাঘট নদকে কেন্দ্র করে এক সময়ের গড়ে ওঠা বন্দর বিলীন হয়ে গেছে। ১৮২০ সালের পর থেকে এ অঞ্চলের প্রমত্তা করতোয়া নদ ক্ষীণ হয়ে আজ প্রায় মরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। পীরগাছা দিয়ে এক সময়কার প্রবাহিত আড়াইকুমারীর কোন অস্তিত্বই আজ আর নেই। শুধু রংপুর বিভাগেই প্রায় ৩৪টি নদ-নদী শুকিয়ে গেছে। ধ্বংস হয়ে পড়েছে কৃষিক্ষেত্র। প্রতিটি জেলায় দেখা দিয়েছে মৎস্য ঘাটতি। নদ-নদীগুলো মরে যাওয়ার উপক্রম হওয়ায় দিনাজপুরসহ উত্তরাঞ্চলজুড়ে মরুকরণ সৃষ্টির লক্ষণ দেখা দেয়ায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন পরিবেশবিদরা। পরিবেশবিদদের মতে, বাঁধ নির্মাণ করে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ অঞ্চলের নদ-উপনদ, শাখা-প্রশাখা, ছড়ানদ এবং নদীখালগুলোকে বাঁচিয়ে তুলতে পর্যাপ্ত পানির প্রবাহ বজায় রাখতে হবে। পাশাপাশি নদীগুলোর অবৈধ বাঁধ অপসারণ, তলদেশ খনন, ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে উৎসমুখ খোলাশা করে কৃত্রিম ক্যানেলের মাধ্যমে ছোট নদীগুলোর সঙ্গে বড় নদীর সংযোগ করা প্রয়োজন। দ্রুত সমস্যা সমাধান করতে না পারলে এক সময় উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হতে পারে বলে পরিবেশবিদদের আশঙ্কা।
×