ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আতঙ্কে নগরবাসী মামলা নিতে পুলিশের গড়িমসি

চট্টগ্রামে হঠাৎ ছিনতাই বৃদ্ধি

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ১০ মার্চ ২০১৮

চট্টগ্রামে হঠাৎ  ছিনতাই  বৃদ্ধি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বন্দর নগরী চট্টগ্রামে গত কয়েক দিনে হুট করে বৃদ্ধি পেয়েছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। প্রকাশ্যে ঘটছে এসব ছিনতাইয়ের ঘটনা। ব্যবহার করা হচ্ছে ধারালো অস্ত্রের পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্র। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিদেশী নাগরিক কেউই বাদ যাচ্ছে না ছিনতাইকারীদের হাত থেকে। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়ছে বলে সাধারণ মানুষ অভিযোগ করছেন। তবে পুলিশের দাবি ছিনতাই রুখতে যথেষ্ট তৎপর রয়েছেন তারা। অন্যদিকে সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, ছিনতাইয়ের ঘটনার ফলে বিঘিœত হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা। এ পরিস্থিতির উত্তরণ এখনই ঘটানো না গেলে ভবিষ্যতে সমাজে বিশৃঙ্খলার পরিমাণ আরও বাড়বে। জানা গেছে, গত শনিবার ভোরে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানা থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পারিবারিক এক কর্মচারী। তাকে ছুরিকাঘাত করে সঙ্গে থাকা ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। এই ব্যাগে প্রতিমন্ত্রীর ছোট ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী ও মেয়ের তিনটি পাসপোর্ট এবং দুই হাজার টাকা ছিল। ওই দিন রাতে নগরীর বাকলিয়া থানার রাহাত্তারপুল থেকে পাসপোর্টগুলো উদ্ধার করে পুলিশ। তবে রাহাত্তারপুলের ওই আস্তানা থেকে কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। অন্যদিকে এই ঘটনার মাত্র ১৮ ঘণ্টা আগে শুক্রবার (২ মার্চ) দুপুরে আনোয়ারা উপজেলার রাঙাদিয়া ইউনিয়নে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পে কর্মরত ছয় চীনা নাগরিক। প্রকাশ্যে তিন-চারজন ছিনতাইকারী অস্ত্রের মুখে তাদের কাছ থেকে দামী মোবাইল ও নগদ টাকা ছিনিয়ে নেয়। এ ঘটনায় এখনও কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি আবারও ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন এক ব্রিটিশ নাগরিক। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ভোরে নগরীর খুলশী থানার আমবাগান এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ছিনতাইকারীদের গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। এ সময় অস্ত্রসহ আহত অবস্থায় দুই ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। তবে পুলিশের হাতে ধরা পড়েও দমছে না ছিনতাইকারীরা। সাত মাস আগে নগরীর আগ্রাবাদে এক চীনা নাগরিকের মালামাল ছিনতাইয়ের ঘটনায় মোহাম্মদ সেলিম নামের এক ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গত ২৮ জানুয়ারি দুপুরে হালিশহর কে ব্লকের ৯ নম্বর রোডে প্রকাশ্যে ছিনতাইয়ের শিকার হন এক নারী উদ্যোক্তা। পরে ওই নারী ছিনতাইকারীর পরিচয় নিয়ে স্থানীয় থানায় গেলেও ছিনতাইয়ের মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানান হালিশহর থানার ওসি মাহফুজুর রহমান। এই খবর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশের পর টনক নড়ে পুলিশ প্রশাসনের। শেষ পর্যন্ত নগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় আলোচিত দুই ছিনতাইকারী, যার একজন আবুল হাশেম (৪০) এর আগে অন্তত দশবার জেল খেটেছে ছিনতাইয়ের দায়ে। হুট করেই চট্টগ্রামে ছিনতাইয়ের ঘটনা ও ছিনতাইকারীদের অস্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় আতঙ্কের মুখে রয়েছেন নগরবাসী। মামুনুল করিম নামের এক বেসরকারী চাকরিজীবী বলেন, ‘চাকরির কারণে বেশির ভাগ সময় বাইরে থাকতে হয় আমাকে। কিন্তু দিন দিন যেভাবে ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়ছে তাতে সন্ধ্যার পর জীবনহানির শঙ্কা নিয়ে চলাফেরা করতে হচ্ছে।’ মীনা জামান নামের এক স্কুল শিক্ষিকা বলেন, ‘সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদে দেখেছি, ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ছেন সমাজের উচ্চ পর্যায়ের মানুষ। এমনকি বিদেশী নাগরিকরাও। পুলিশের সঙ্গে ঘটছে বন্দুক যুদ্ধের ঘটনা। ছিনতাইকারীরা যখন সাধারণের সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে, যখন আইনের রক্ষকরা নিজেরাই নিরাপদ নয়, সেখানে আমারা কতটা নিরাপদে রয়েছি?’ অন্যদিকে ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়তে থাকলেও পুলিশ ছিনতাইকারীদের আটকের ক্ষেত্রে ততটা তৎপর নয় এবং কিছু ক্ষেত্রে তারা মামলা নিতেও রাজি হন না বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। আর মামলা না নিয়ে সাধারণ ডায়েরি করলে ছিনতাইয়ের ঘটনার কোন সুরাহাই হয় না বলেও অভিযোগ তাদের। পুলিশের এমন ‘নীরব’ ভূমিকা সমাজে ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মুনিরুল হাসান। তিনি বলেন, ‘সমাজের নৈতিক অবক্ষয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জবাবদিহিতার অভাব এবং ছিনতাইকারীদের আইনের আওতায় না নিয়ে আসায় অপরাধীরা আরও বেশি সাহস পেয়ে মেতে উঠছে অপরাধমূলক কর্মকা-ে। এটা সমাজের শৃঙ্খলা নষ্ট করছে। এখনই এসব অপরাধ রুখতে না পারলে ভবিষ্যতে সমাজে আরও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।’ হুট করে ছিনতাইয়ের ঘটনা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার ইকবাল বাহার সাংবাদিকদের বলেন, ‘ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে বলার সুযোগ নেই। ছিনতাইকারীদের ধরতে পুলিশের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে। তালিকা করে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। নগরবাসীর আতঙ্কিত হবার কিছু নেই।’ সাম্প্রতিক একটি ঘটনা নজরে এনে ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা নিতে পুলিশের গড়িমসির বিষয়ে জানতে চাইলে সিএমপি কমিশনারের উত্তর, ‘বিষয়টি জানা নেই, থানা মামলা না নিলে উর্ধতন কর্মকর্তাদের অভিযোগের সুযোগ রয়েছে।’ অস্ত্রের ব্যবহার প্রসঙ্গে পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘দু’একটা ক্ষেত্রে হচ্ছে’। এ বিষয়ে অধ্যাপক মুনিরুল হাসান বলেন, ‘পুলিশের গড়িমসির বিষয়টি নতুন কিছুই নয়। পুলিশের মধ্যে এখনও এমন নিয়ম রয়েছে, যে থানায় অভিযোগের পরিমাণ কম থাকে সেই থানার কর্মকর্তারা বেশি তৎপর তথা সেই থানা বেশি ভাল। কোন অভিযোগ তদন্তের পর কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে সেটা পরের বিষয় কিন্তু সমাজের প্রত্যেকটা মানুষের অভিযোগ দেয়ার স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন। বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে তা সমাজের জন্য খারাপ ফল বয়ে আনবে।’.
×