ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিব্রত মন্ত্রণালয় ॥ ডজনখানেক অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ

খোদ সরকার নিয়ন্ত্রিত আলিয়া মাদ্রাসায় ব্যাপক অনিয়ম

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১০ মার্চ ২০১৮

খোদ সরকার নিয়ন্ত্রিত আলিয়া মাদ্রাসায় ব্যাপক অনিয়ম

বিভাষ বাড়ৈ ॥ অবৈধভাবে অর্থলোপাট জালিয়াতি, নীতিমালা অমান্য করে অতিরিক্ত অর্থ আদায়সহ ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে সরকার নিয়ন্ত্রিত আলিয়া মাদ্রাসায়। একের পর এক অভিযোগে বিব্রত শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত দুই মাসে ছাত্রীর যৌন হয়রানিসহ ডজনখানেক অভিযোগের বিষয়ে মাদ্রাসা অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্টদের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। কেবল তাই নয়, অধিদফতরের একাধিক তদন্ত নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগ। অনিয়মের বিরুদ্ধে মহাপরিচালককে দফায় দফায় ব্যবস্থা নিতে বলা হলেও সাড়া না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা। অভিযোগের বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মোঃ আলমগীর বলেছেন, অনিয়ম-দুর্নীতি, অবহেলা মেনে নেয়া হবে না। যত বড় কর্মকর্তাই হোন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের সক্ষমতা কম উল্লেখ করে মোঃ আলমগীর বলেন, যারা তদন্ত করছেন তাদের বেশিরভাগেরই অভিজ্ঞতা নেই। প্রশাসনিক যোগ্যতাও নেই অনেকের। নতুন অধিদফতর হওয়ায় দুর্বলতা রয়েছে। তবে দুর্নীতি ও লুটপাটসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে শৈথিল্য ও বাঁচিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হলে ছাড় দেয়া হবে না, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন, দায়ী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা না নেয়ায় নৈরাজ্য বন্ধ হচ্ছে না। জানা গেছে, অবৈধ নিয়োগ, এমপিও জালিয়াতি, সনদ টেম্পারিং, পাবলিক পরীক্ষার কোচিং ফি’র নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়সহ নানা ধরনের জালিয়াতি ও লুটপাট চলছে বেশকিছু আলিয়া মাদ্রাসায়। এমনকি যৌন হয়রানির অভিযোগও রয়েছে মাদ্রাসার শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন আদেশ ও পত্রে মাদ্রাসাগুলোর দুর্নীতির চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। উঠে এসেছে অনিয়ম-দুর্নীতি, লুটপাট ও জালিয়াতি, যৌন হয়রানির নানা অভিযোগের চিত্র। অভিযোগ রয়েছে, নয় বছর চাকরি করার পর ইনডেক্স পরিবর্তন করে ২১ বছরের অভিজ্ঞতা দেখিয়ে অবসরের টাকা ভোগ করেছেন ফরিদপুরের সালথা উপজেলার ইউসুফ চৌধুরী আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মোঃ আবু ছায়েম মোল্লা। দফায় দফায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও ব্যক্তিগত কারণে আবু ছায়েম মোল্লাকে অব্যাহিত দিয়েছেন প্রতিষ্ঠাতা সুপার আব্দুল ওয়াহাব। নীলফামারীর সৈয়দপুর থানার সোনাখুলি মুন্সিপাড়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আ ব ম মনসুর আলী টেম্পারিং করে বয়স কমিয়েছেন দাখিল ও আলিম পরীক্ষার মূল সনদে। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার বুড়িরহাট দাখিল মাদ্রাসার সুপার সোহরাব আলী অবৈধভাবে চাকরি নিয়ে এমপিওভুক্ত হয়েছেন। একই উপজেলার দক্ষিণ রামখানা রহমতিয়া দাখিল মাদ্রাসা শিক্ষকদের নিয়োগ ও এমপিওভুক্তিতে অনিয়ম করা হলেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ২৮ জানুয়ারি দ্রুত ব্যবস্থা নিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ। চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার জায়েমা আদুদিয়া সুন্নিয়া ফাজিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছৈয়দ হোসাইনের কাছ থেকে ১৫ বছর আগের আত্মসাত করা প্রতিষ্ঠানের ৯৭ হাজার ৪৬৩ টাকা আজ পর্যন্ত আদায় হয়নি। গত ১০ জানুয়ারি এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে অধিদফতরকে। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডের বাইতুল ফজল ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসার দরিদ্র তহবিলের এক লাখ ৯৬ হাজার টাকা এবং অধ্যক্ষের হাতে থাকা আরও ২৫ হাজার ৫৪১ টাকা মাদ্রাসার তহবিলে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হলেও তা ফেরত দেয়া হয়নি। গত ১ জানুয়ারি মন্ত্রণালয় অধিদফতরকে প্রতিষ্ঠানের অবৈধ অভিভাবক সদস্যের পদ বাতিলের নির্দেশ দিয়েছে। পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার দুমকি ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষসহ অন্যান্য শিক্ষক সরকারী বেতন-ভাতা উত্তোলনে সরকারী বিধি অমান্য করেছেন। এ বিষয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতর কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ গত ১০ জানুয়ারি মহাপরিচালককে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে। গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার দক্ষিণ হাটবমুনী এনআই দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক সাইদুর রহমানের সনদ জাল প্রমাণিত হওয়ায় চাকরিকালীন উত্তোলন করা টাকা ফেরত নেয়ার ব্যবস্থা নিতে বলেছে মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের জারি করা এক আদেশে বলা হয়েছে, কবে এমপিওভুক্ত হয়েছে, কত টাকা ওই শিক্ষক উত্তোলন করেছেন, তা দ্রুত জানাতে হবে। একইভাবে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার শাহ্ মাজিদিয়া দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক তমিজ উদ্দিন সরকারী কোষাগার থেকে অতিরিক্ত অর্থ উত্তোলন করেছেন। গত ৫ ফেব্রুয়ারি এই অভিযোগের প্রমাণপত্রসহ অধিদফতরকে পাঠাতে বলেছে মন্ত্রণালয়। সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার গাজীপুর-কুড়িগ্রাম আলিম মাদ্রাসার গবর্নিং বডির দাতা সদস্য নির্বাচনে জালিয়াতি ও প্রতারণার আশ্রয় নিলে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডকে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। ঝালকাঠি সদর উপজেলার চাচইর দারুল ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে পাবলিক পরীক্ষার ফরম পূরণে অতিরিক্ত টাকা নেয়ার অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তদন্ত কর্মকর্তা দেশের সব মাদ্রাসাকে সতর্ক করে পরিপত্র জারি করার সুপারিশ করেছেন। মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালককে পরিপত্র জারি করার বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে। ময়মনসিংহের নান্দাইলের ধুরুয়া ডিএস দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক আব্দুল ওয়াহাবের বিরুদ্ধে শ্রেণীকক্ষে পাঠদান না করে জোর করে বেতন উত্তোলন, হালুয়াঘাট ডিএস দাখিল মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত প্রধান ও গবর্নিং বডির সভাপতির অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত করে সুস্পষ্ট মতামত দিতে বলা হয়েছে। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার পটকা দাখিল মাদ্রাসার সুপার মহিউদ্দিন জেলহাজতে থাকলেও তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেনি কমিটি। মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। দুর্নীতি, লুটপাট ছাড়াও প্রতিষ্ঠান প্রধানদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। অভিযোগ প্রমাণের পরও একটি ঘটনায় অভিযুক্তকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়েছে তদন্তে। এ কারণে মন্ত্রণালয় সুস্পষ্ট মতামত চেয়েছে অধিদফতরের তদন্ত কর্মকর্তার কাছে। লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ থানার ফহেতপুর জে ইউ সি ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রমাণিত হলেও তদন্ত কর্মকর্তা অভিযুক্তকে বাঁচাতে গোঁজামিল দিয়ে প্রতিবেদন জমা দেন। এরপর মন্ত্রণালয় সুস্পষ্ট মতামত চেয়েছে অধিদফতরের কাছে। পাঠ্যবইয়ে জঙ্গী উপাদান নিয়ে বোর্ড চেয়ারম্যানের ব্যাখ্যা তলব ॥ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম ছায়েফ উল্যাহর জামায়াতপ্রীতির অভিযোগ এনে পাঠ্যক্রম জঙ্গীবাদ মুক্ত হয়নি মর্মে অভিযোগ করেছেন এক মাদ্রাসা শিক্ষক। অভিযোগকারী আবু নাঈম মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের মাদ্রাসা ইউনিটের আহ্বায়ক। লিখিত অভিযোগে তিনি মাদ্রাসা বোর্ডের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।
×