ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সিন্ডিকেটের হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির তদন্ত হচ্ছে ॥ মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগ

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ১০ মার্চ ২০১৮

সিন্ডিকেটের হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির তদন্ত হচ্ছে ॥ মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগ

ফিরোজ মান্না ॥ প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগে ১০ সদস্যের সিন্ডিকেটের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে যুগ্ম সচিব শাহানেওয়াজ সিদ্দিকীকে। সরকারের বেঁধে দেয়া খরচের বেশি টাকা নেয়া হচ্ছে কিনা তা নিয়ে তদন্ত করা হবে। সম্প্রতি দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত ‘ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেটের কবলে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারÑহাতিয়ে নিয়েছে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের পর মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নমিতা হালদার এ তথ্য জানিয়েছেন। সচিব ড. নমিতা হালদার বলেন, সিন্ডিকেটের বিষয়টি মালয়েশিয়ার তৈরি। মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ১০ জনশক্তি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কর্মী নিয়োগ করা হচ্ছে। এ নিয়ে একটি চুক্তিও মালয়েশিয়ার সঙ্গে হয়েছে। এখন আমাদের দেখতে হবে, আমাদের বেঁধে দেয়া খরচের চেয়ে বেশি টাকা এই প্রতিষ্ঠানগুলো নিচ্ছে কিনা। এজন্য প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে বিষয়টি তদন্ত করে দেখার জন্য যুগ্ম সচিব শাহানেওয়াজ সিদ্দিকীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সরকারের বেঁধে দেয়া খরচের চেয়ে বেশি টাকা নিয়ে থাকে তাহলে তাদের শোকজ করা হবে। এর বাইরেও আরও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। মালয়েশিয়ায় কৃষিক্ষেত্রে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা এবং নির্মাণ ও কারখানায় কাজের ক্ষেত্রে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা বেঁধে দেয়া হয়েছে। বায়রার সাবেক সেক্রেটারি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন প্র্রান্তিক ট্রাভেল, ইউনিক ইস্টার্ন, ক্যাথারসিজ ইন্টারন্যাশনাল, ক্যারিয়ার ওভারসিজ, আমিন এ্যান্ড ট্যুরস, এইএসএমটিস হিউম্যান রিসোর্স, সানজারি ইন্টারন্যাশনাল, রাব্বি ইন্টারন্যাশনাল, প্যাজেস এ্যাসোসিয়েটস ও আল ইসলাম ওভারসিজ Ñএই ১০ প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত এক লাখ ১০ হাজার কর্মী মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছে। বাকি তিন লাখ ৯০ হাজার কর্মী পাঠানোর জন্য তারা প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ কর্মীর কাছ থেকে পাসপোর্ট নিয়েছে। একই সঙ্গে তাদের মেডিক্যাল করার জন্য ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা নেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ কর্মীকে মেডিক্যালে ‘আনফিট’ দেখিয়ে তাদের টাকা মেরে দিচ্ছে এই সিন্ডিকেট। বাকি যাদের মেডিক্যাল করে ফিট করা হয়েছে তাদের তিন মাসের মধ্যে মালয়েশিয়া না পাঠাতে পারলে আবার একই টাকা জমা দিয়ে মেডিক্যাল করতে হচ্ছে। শুধু মেডিক্যাল থেকেই সিন্ডিকেট ২ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কর্মীদের কাছ থেকে পাসপোর্ট নেয়ার সময় তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা নিয়ে নিচ্ছে। স্বচ্ছতা দেখানোর জন্য অল্প কিছু টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে নিচ্ছে। তাদের কর্মকান্ড মাফিয়া চক্রকেও হার মানিয়েছে। এই সিন্ডিকেট কম করে হলেও সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা কর্মীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে। শুধু মেডিক্যাল করার মাধ্যমে তারা ২ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। তাদের কারণে জনশক্তির ব্যবসা এখন আর ব্যবসা নেই। রীতিমত ডাকাতি হচ্ছে। গরিব মানুষের গলা কেটে ১০ জনের সিন্ডিকেট হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিন্ডিকেটের বিষয়ে সরকারের কোন নজরদারি নেই। ব্যবসায়ীরা বরাবরের মতোই বলছেন, মাঠ পর্যায়ের দালালরা অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছেন। আর যে খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা বাস্তবসম্মত নয়। জি টু জি চুক্তির আওতায় মালয়েশিয়ায় যাওয়ার প্রথমে খরচ নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩৩ হাজার টাকা। এই চুক্তির আওতায় মাত্র আট হাজার কর্মী গেলেও তারা অতিরিক্ত টাকা দিয়েছিলেন, এমন অভিযোগ ছিল না। জি টু জি প্লাসে নির্ধারিত খরচ ৪০ হাজার টাকা করা হয়েছে। সর্বশেষ টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে এক লাখ ৬০ হাজার করা হয়েছে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার আগে কয়েক কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের কেউ কেউ সাড়ে চার লাখ আবার কেউ কেউ সাড়ে ৫ লাখ টাকা সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দিয়েছেন। এদের কেউ মধ্যস্বত্বভোগীর মাধ্যমে আবার কেউ সরাসরি জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেই গেছেন। কিন্তু আমাদের বলে দেয়া হয়েছে কেউ যদি জানতে চায় কত টাকায় যাচ্ছ তাহলে তোমরা বলবেÑ সরকারনির্ধারিত যে খরচ, সেই খরচেই যাচ্ছি। এর বাইরে টাকা নিচ্ছে না। সিন্ডিকেটের দুই কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, সরকার নির্ধারিত খরচে কর্মী পাঠিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব নয়, সরকার তো নীতিমালা করার সময় আমাদের কাউকে রাখেনি। রাখলে আমরা আমাদের কথা বলতে পারতাম। তবে শুরুর দিকে কিছুটা এলোমেলো হচ্ছে। ঢাকার বাইরে মধ্যস্বত্বভোগীকে আমরা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। তবে আশা করছি, দ্রুতই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। সরকার নির্ধারিত টাকার চেয়ে কিছু টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে, এটা সত্য। কারণ যারা গ্রাম থেকে কর্মী নিয়ে আসছে তারা কিছু টাকা আমাদের অজান্তে হাতিয়ে নিচ্ছে। এদের বিষয়ে আমরা সজাগ রয়েছি। সিন্ডিকেট এমনই ভয়ঙ্কর যে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার অনুরোধও তারা রাখেনি। ওই কর্মকর্তার এক গরিব আত্মীয়কে মালয়েশিয়ায় পাঠাতে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। ওই প্রতিষ্ঠান তাকে বলেছে, অন্যদের কাছ থেকে চার লাখ টাকা নেয়া হচ্ছে। তবে তার আত্মীয়ের জন্য ন্যূনতম ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা দিতে হবে। এরপরও মন্ত্রণালয় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। যারা এবার ব্যবসা করছে, তাদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ের আসলে খুব বেশি কিছু করার নেই। কারণ, তারা খুব প্রভাবশালী। উল্লেখ্য, নানা অভিযোগে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া বন্ধ করেছিল মালয়েশিয়া। ২০১২ সালের ২৬ নবেম্বর সরকারীভাবে কর্মী পাঠাতে দুই দেশ জি টু জি চুক্তি করলেও তেমন কর্মী পাঠাতে পারেনি। গত বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি বেসরকারী ব্যবসায়ীদের অন্তর্ভুক্ত করে জি টু জি প্লাস সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এর আওতায় গত বছর থেকে এ পর্যন্ত ১০টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এক লাখ ১০ হাজার কর্মী মালয়েশিয়ায় নিয়োগ পেয়েছেন। কিন্তু কর্মীদের যে চাকরির কথা বলে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়েছে তারা কেউ ওই চাকরি পাননি। পেয়েছেন ‘ওয়াটজব’। হারভাঙ্গা পরিশ্রম করেও অনেক কর্মী তাদের নিজেদের খরচ মেটাতে পারছেন না। বাড়িতে টাকা পাঠানোর মতো কোন টাকাই তাদের থাকছে না। এখন অনেক কর্মী দেশে ফিরে আসার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
×