ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বর্ষা ও ঈদের আগে ক্ষতিগ্রস্ত ৫ হাজার কিমি সড়ক সংস্কার নিয়ে আশঙ্কা ষ গুরুত্বপূর্ণ সব মহাসড়কের অবস্থাই খারাপ

এক হাজার ১৬৬ কোটি টাকা ছাড় না হলে সড়ক মেরামত অনিশ্চিত

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ১০ মার্চ ২০১৮

এক হাজার ১৬৬ কোটি টাকা ছাড় না হলে সড়ক মেরামত অনিশ্চিত

রাজন ভট্টাচার্য ॥ আসন্ন বর্ষা মৌসুম ও রোজার ঈদের আগেই ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ হাজার কিলোমিটারের বেশি সড়ক সংস্কার নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সড়ক ও জনপথের প্রকৌশলীরা বলছেন, এখনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সড়ক সংস্কারে হাত দেয়া সম্ভব হয়নি। তাছাড়া আষাঢ় ও শ্রাবণ বর্ষাকাল হলেও বৈশাখ মাস থেকেই বৃষ্টি বাদল শুরু হয়। অর্থাৎ এপ্রিল থেকেই বৃষ্টির সম্ভাবনা। এই সময়ের মধ্যে সড়কের মেরামত কাজ শেষ করা মোটেও সম্ভব হবে না। যদিও মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আগামী জুনের মধ্যে সড়ক সংস্কারের কাজ শেষ হবে। বর্ষা মৌসুমের আগে ফোর লেন প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় এবারও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে জনদুর্ভোগের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে সড়ক সংস্কারের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে এক হাজার ১৬৬ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। এই অর্থ কবেনাগাদ ছাড় হবে এমন নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না কেউই। তাই অর্থ ছাড় না হলে সড়ক সংস্কারে অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে। পরিস্থিতি বিবেচনায়, দ্রুত সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক মহাসড়ক সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতৃবৃন্দসহ যাত্রী কল্যাণে নিয়োজিত বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন, রাস্তা খারাপ থাকায় ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দুর্ভোগ সবচেয়ে বেশি। এরমধ্যে ঢাকা সিলেট রুটে দুর্ভোগ চলছে প্রায় সাত মাস। টঙ্গী থেকে সিলেট বাইপাস রুটের অন্তত ৩০ কিলোমিটার সড়কের বেহালদশা নিয়ে মালিক সমিতির পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করা হয়েছে। অনেক চিঠি চালাচালির পর সড়কটি সংস্কারে টেন্ডার হয়। দুই মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও ইতোমধ্যে পেরিয়ে গেছে প্রায় সাত মাস। শ্রমিক নেতাদের অভিযোগ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রভাবশালী হওয়ায় নিজেদের ইচ্ছেমতো কাজ করছে। তাছাড়া মন্ত্রণালয়ের তদারকির অভাবে দুর্ভোগ দিন দিন মাত্রা ছাড়াচ্ছে। অথচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাউকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হচ্ছে না। জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, আমরা বারবাই বলে আসছি দ্রুত সময়ের মধ্যে সড়ক সংস্কার করার জন্য। কিছু কাজ দৃশ্যমান হলেও আমাদের আশঙ্কা রয়েছে বর্ষা ও ঈদের আগে শতভাগ কাজ শেষ হওয়া নিয়ে। তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ সড়ক মহাসড়কের কাজ দ্রুত শেষ না হলে এবারও মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছবে। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গতবছর অতি বৃষ্টি ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মহাসড়কগুলোতে মেরামতের কাজ চলছে। আগামী জুন মাসের মধ্যে সব সড়কের খানাখন্দ ঠিক হয়ে যাবে। গত বছরের বন্যায় পাঁচ হাজার কিলোমিটারের বেশি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথাও মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়। দেশে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের (সওজ) আওতাধীন ৮৭৬টি মহাসড়ক আছে। এর মধ্যে ৯৬টি জাতীয়, ১২৬টি আঞ্চলিক এবং ৬৫৪টি জেলা মহাসড়ক। গত বর্ষা মৌসুমে ২২টি জেলার ৬২টি স্থানে ৪ দশমিক ৯২ কিলোমিটার মহাসড়ক বিলীন হয়ে যায় এবং ৭৫টি স্থানে ৬৭ দশমিক ২০ কিলোমিটার মহাসড়ক পানিতে তলিয়ে যায়। এছাড়া তিন পার্বত্য জেলায় ২৫১টি স্থানে পাহাড় ধসে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে; বন্যায় ৫ হাজার ১১৫ কিলোমিটার মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের আওতাধীন সারাদেশে মোট সড়কের পরিমাণ ২১ হাজার ৩০২ দশমিক ৮ কিলোমিটার। বিগত ৯ বছরে লেন বৃদ্ধি ও প্রশস্তকরণসহ বর্তমান সরকারের আমলে মহাসড়কের যে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে তা অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় অগ্রসরমান বলেও দাবি করা হয় সড়ক বিভাগের পক্ষ থেকে। চলতি অর্থবছরে রক্ষণাবেক্ষণ খাতে প্রাপ্ত বরাদ্দ বিভাজন হচ্ছে দৈনন্দিন মেরামতের জন্য ১০০ কোটি টাকা, পিএমপি মাইনর কর্মসূচীর আওতায় ৫৫৯ কোটি টাকা, পিএমপি মেজর কর্মসূচীর আওতায় ১ হাজার ১২৫ কোটি (অতিরিক্ত প্রাপ্ত বরাদ্দ ১০০ কোটি টাকাসহ) টাকা এবং অন্যান্য খাতে ২০ দশমিক ৪৮ কোটি টাকা। সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মোঃ নজরুল ইসলাম বলেন, চলতি অর্থবছরে মহাসড়ক রক্ষণাবেক্ষণ খাতে এক হাজার ৭০৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর আওতায় সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের অনুকূলে ১৩ হাজার ৭০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বন্যা ও অতিবর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত মহাসড়ক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অতিরিক্ত আরও এক হাজার ১৬৬ কোটি টাকার চাহিদা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সড়ক স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে, যার অধিকাংশ কাজ চলমান। মন্ত্রণালয়ের ২৩টি টিমের মাধ্যমে এ কার্যক্রম তদারকি করা হচ্ছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ ৬১ শতাংশ শেষ হয়েছে। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের প্রকৌশলী ও কর্মকর্তারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতিবেদনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে নজরুল বলেন, রবিবার দুদকের রিপোর্ট আমার হাতে এসেছে। দেখে শুনে ব্যবস্থা নেব। দুদক সুনির্দিষ্ট করে কোন ইঞ্জিনিয়ারের নাম বলেনি, কোথায় এমন ঘটনা ঘটেছে তাও বলেনি, তবে তাদের কথার যৌক্তিকতা আছে। রোজার ঈদ সামনে রেখে মহাসড়কের রক্ষণাবেক্ষণে নেয়া কর্মসূচীর ৪০ শতাংশ ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, আগামী এপ্রিলের মধ্যে কাজটা চোখে পড়ার মতো হবে, জুনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাফল্য আসবে। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ১৬ জুন রোজার ঈদ হতে পারে। ঈদযাত্রার মৌসুমে যাতে সড়কে কোন ভোগান্তি না হয়, সেজন্য মেরামতের কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, আমরা বলতে চাচ্ছি, আমাদের কর্মযজ্ঞ চলছে। পত্রপত্রিকায় বলা হচ্ছে রাস্তার এই (বাজে) অবস্থা। এই অবস্থার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দৃশ্যমান হবে। উন্নত সকলের চোখে এটা পড়বে। রাস্তার খানাখন্দ, জুনের মধ্যে এগুলোর মেরামত দৃশ্যমান হবে। ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, আমরা আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে সড়কের সংস্কার কাজ শেষ হবে। কিন্তু বাস্তবে তা কতটুকু সফল হয় তাই দেখার বিষয়। নৌ-সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, অল্প সময়ের মধ্যে শতভাগ কাজ শেষ করা সত্যিই চ্যালেঞ্জ। তবুও জনদুর্ভোগের বিষয়টি মাথায় রেখে তা যে কোন মূল্যে সম্পন্ন করার দাবি জানান তিনি। এদিকে সড়ক ও জনপথের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ থাকলেও আর্থিক সঙ্কট ও সময় সংক্ষিপ্ত হওয়ার কারণে জুলাই মাসের মধ্যে সব কাজ সম্পন্ন করা চ্যালেঞ্জ। তবে জনদুর্ভোগ এড়াতে নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কাজ সম্পন্ন করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও জানান তারা।
×