ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

উল্টো প্রমাণ দেখতে চায়

গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার মিয়ানমারের

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ১০ মার্চ ২০১৮

গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার মিয়ানমারের

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন ও গণহত্যার অভিযোগ নির্লজ্জভাবে অস্বীকার করেছে মিয়ানমার। দেশটি শুধু অস্বীকার করেই ক্ষান্ত হয়নি, উল্টো এই অভিযোগের সপক্ষে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ দেখতে চেয়েছে। জেনেভায় বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা থাউং তুন এই প্রমাণ চেয়েছেন। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে থাউং তুন বলেন, রাখাইনে মুসলিম সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ এখনও সেখানেই বসবাস করছে। যদি সেখানে গণহত্যাই চালানো হত তবে তারা সবাই পালিয়ে যেত। তুন বলেন, জাতিগত নিধন ও গণহত্যার অভিযোগ খুবই গুরুতর এবং এটা হাল্কাভাবে নেয়া উচিত হবে না। সেখানে জাতিগত নিধন ও গণহত্যা হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে রায় দেয়ার আগে আমাদের উচিত আসলেই কি হয়েছে সেটা দেখে নেয়া। যদিও এই দেখে নেয়ার সুযোগ মিয়ানমার সরকারই দিচ্ছে না। তারা এমনকি জাতিসংঘের তদন্ত দলকেও এখনও রাখাইনে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। বাংলাদেশ বা অন্যান্য দেশে আশ্রয় নেয়া রাখাইন শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন। আগামী সোমবার দলটি তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দেবে বলে জানা গেছে। তুন বলেন, মিয়ানমার সরকার রাখাইন থেকে পালিয়ে যাওয়া শরণার্থীদের ফেরত নিতে চায় এবং তাদের যথাযথ নিরাপত্তা ও সম্মান দেয়া হবে। সরকার চায় না তারা দেশের বাইরে থাকুক। রাখাইনের ৩০ লাখ বাসিন্দার মধ্যে খুব কম সংখ্যকই দেশত্যাগ করেছে। পালিয়ে যাওয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ মানুষই আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (এআরএসএ) ভয়ে দেশত্যাগ করেছে বলেও দাবি করেন এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর ওপর হামলা করতে এআরএসএ গ্রামবাসীদের বাধ্য করত। তুন বলেন, তাদের মধ্যে যারা মিয়ানমারের নাগরিকত্ব চাইবে আমরা তাদের খুশি মনে স্বাগত জানাব। কিন্তু তাদের একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তারা এমনি এমনিই নাগরিকত্ব পাবে না। গত বছর আগস্টে রাখাইনে পুলিশ পোস্ট ও সেনাঘাঁটিতে সন্ত্রাসী হামলার পর সেখানে সেনা অভিযান শুরু হয়। গত ছয় মাসে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। অতীতে বিভিন্ন সময় আরও প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এর আগে বুধবার জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান জেইদ রাদ আল-হুসাইন বলেছিলেন, রাখাইনে সেনাভিযান নিয়ে বিশ্বজুড়ে অভিযোগ উঠার পরও মিয়ানমার সেনাবাহিনী তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশে গড়িমসি করছে। আমার দৃঢ় সন্দেহ সেখানে গণহত্যা হয়েছে। রাখাইনে সেনাবাহিনীর দমন অভিযানে জনশূন্য হয়ে পড়া রোহিঙ্গা গ্রামগুলো বুলডোজার দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। এ বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলকে জেইদ বলেন, গণকবর নিশ্চিহ্ন করতে রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে বুলডোজার চালানোর খবরে মনে হচ্ছে, মানবতার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য অপরাধের প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করতে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করে বুলডোজার চালিয়েছে। যদিও মিয়ানমার সরকারের দাবি, পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তারা গ্রামগুলোতে বুলডোজার চালিয়েছে। মিয়ানমারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনেভায় গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করলেও রাখাইনে ইতোমধ্যেই পাঁচটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। রাখাইনে এই গণকবরের সন্ধান পাওয়ায় বিশ্বজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করার দাবিও উঠেছে। ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে জাতিসংঘ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এর আগে রোহিঙ্গা গণহত্যা, ধর্ষণ, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে মিয়ানমার সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক গণ-আদালত। গত বছর ১৮ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারে রোহিঙ্গা, কাচিনসহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর দেশটির সেনাবাহিনী, পুলিশ ও সরকার পরিচালিত গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী, বিশেষজ্ঞ সাক্ষ্য, বিভিন্ন প্রামাণ্য দলিলের ভিত্তিতে ইতালির রোমভিত্তিক সংস্থা পারমানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনাল (পিপিটি) গত ২২ সেপ্টেম্বর ওই রায় ঘোষণা করে বলেছিল, মিয়ানমার সরকারের ওপর জরুরী ভিত্তিতে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে। ওই রায় ঘোষণার ফলে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক চাপেও পড়েছিল। উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছে। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে চুক্তি নির্ধারিত তারিখে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব হয়নি। শত শত বছর ধরে রোহিঙ্গারা রাখাইনে বসবাস করলেও বৌদ্ধ অধ্যুষিত মিয়ানমারের বেশিরভাগ মানুষ এখনও তাদের বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ শরণার্থী বলে মনে করে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের রোহিঙ্গা নয় বরং ‘বাঙালী’ বলে বর্ণনা করে।
×