ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হাতিয়ে নেয়া টাকা বিদেশে পাচারের চেষ্টা করছে ইউনিপে

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ১০ মার্চ ২০১৮

হাতিয়ে নেয়া টাকা বিদেশে পাচারের চেষ্টা করছে ইউনিপে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ মাল্টি লেভেল মাকেটিং কোম্পানি ইউনিপে টু ইউ’র কার্যক্রম থেমে নেই। দৃশ্যমান কোন কার্যক্রম না থাকলেও গোপনে তাদের কার্যক্রম রয়েছে। কোম্পানিটি মানুষকে প্রতারিত করে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। সেই টাকার অধিকাংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। হাতিয়ে নেয়া টাকা ব্যাংকে নানা নামে গচ্ছিত রয়েছে। সেই গচ্ছিত টাকা নতুন করে বিদেশে পাচারের চেষ্টা চলছে। কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনেকেই বিদেশে পলাতক। তাদের ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কোম্পানিটির দুই কর্মকর্তা ও দুই এজেন্টসহ মোট চারজন গ্রেফতার হয়েছে। তাদের তিন দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করছে সিআইডি। জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। গত বুধবার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিট এমএলএম কোম্পানিটির নির্বাহী কর্মকর্তা ইকবাল আলী, জুনিয়র নির্বাহী কর্মকর্তা দেওয়ান মোঃ মঞ্জুর কবীর, এজেন্ট এ এস এম জিয়াউল হক ও সহকারী এজেন্ট মিলন হাসানকে গ্রেফতার করে। পরে তাদের ঢাকার সিএমএম আদালতে সোপর্দ করে দশ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে। আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, বাংলাদেশে এমএলএম কোম্পানি ইউনিপে টু ইউসহ কিছু কোম্পানি ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ব্যবসা করে। এরমধ্যে ইউনিপে টু ইউ নামের এমএলএম কোম্পানিটিরও ব্যাপক কার্যক্রম ছিল। কোম্পানিতে থাকা চক্রের সদস্যরা মানুষকে তাদের কাছে টাকা গচ্ছিত রাখলে তা দ্বিগুণ হবে বলে আশ্বাস দিত। কম্পিউটারের কারসাজিতে টাকা জমা এবং যারা টাকা রাখছেন তাদের এ্যাকাউন্টে পয়েন্টের সঙ্গে টাকা জমা হওয়ার ভুয়া রেকর্ড দেখাত। বিশেষ করে কোম্পানিটি গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মালয়েশিয়ায় স্বর্ণ কিনে রাখলে তা দ্বিগুণ লাভ হওয়ার লোভ দেখাত। এতে অনেকেই দ্বিগুণ লাভের আশায় টাকা রাখত। আর এমন প্রক্রিয়ায় মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা। পরবর্তীতে এসব ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। এ ব্যাপারে পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করে। তদন্তে অর্থ আত্মসাত ও অস্বাভাবিক লেনদেনের বিষয়টি ধরা পড়ে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক কোম্পানিটির বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেয়। সেই প্রতিবেদনের সূত্রধরে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে তারা তদন্ত করছে। তিনি আরও জানান, কোম্পানিটির অস্বাভাবিক লেনদেনের বিষয়ে চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক একটি প্রতিবেদন দেয়। ওই প্রতিবেদনের সূত্রধরে তারা তদন্ত করছেন। তদন্তে কোম্পানির দুই কর্মকর্তা ও দুই এজেন্টের বিরুদ্ধে প্রায় ৪৪ কোটি পাঁচ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া মিলে। এ ব্যাপারে শাহবাগ থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। সেই মামলায় চার জনের ব্যাংক এ্যাকাউন্টে প্রায় ৪৪ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়। তার মধ্যে ইকবালের এ্যাকাউন্টে ৮৮ লাখ ও প্রেস্টিজ নামের আরেক এ্যাকাউন্টে ২২ লাখ টাকা পাওয়া গেছে। বাকি টাকা কোথায় কিভাবে সরানো হয়েছে সে বিষয়ে তদন্ত চলছে। তারা হুন্ডিসহ নানা মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার করেছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে। গ্রেফতারকৃতরা ঢাকা, ঝিনাইদহ ও যশোর এলাকার প্রায় এক হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে ৪৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা সেসব অর্থ ইউনিপে টু ইউ’র প্রধান কার্যালয়ে জমা দিয়ে দিয়েছে বলে দাবি করেছে। মোল্যা নজরুল জানান, কোম্পানিটির দৃশ্যমান কোন কার্যক্রম নেই। তবে গোপনে তাদের কার্যক্রম রয়েছে। বিশেষ করে কোম্পানিটি মানুষের কাছ থেকে যে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে, তা বিভিন্ন ব্যাংক নামে বেনামে গচ্ছিত রয়েছে বলে জানা গেছে। সেইসব অর্থ বিদেশে পাচারের প্রক্রিয়া করছিল গ্রেফতারকৃতরা। কোম্পানিটির মালিক বিদেশে পলাতক থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনও তদন্ত করে দেখছে। কোম্পানিটির এমডি ইমরান ও একজন জেনারেল ম্যানেজার জেলে রয়েছে। তাদের বিষয়ে খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে তাদের বিষয়ে তথ্য জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। তথ্য পাওয়া গেলে, তাদের এ মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ব্যবস্থা করা হবে। আর বিদেশে পলাতক থাকা কোম্পানিটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেডনোটিস জারি করে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই দেশে এমএলএম কোম্পানি মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিল। এমএলএম কোম্পানি ২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত কয়েক বছরে বহু অর্থ হাতিয়ে নেয়। এমএলএম কোম্পানি মানুষ বা প্রতিষ্ঠানের ইমেজকে কাজে লাগিয়ে প্রতারণা করে থাকে। দেশে গ্লোবাল মানি সুইং কর্পোরেশন লিমিটেড, ডেসটিনি, বিজিনেস, ইউনিপে টু ইউসহ বেশ কয়েকটি এমএলএম কোম্পানির কার্যক্রম ছিল। পরবর্তীতে সরকার কোম্পানির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। গ্লোবাল মানি সুইং কোম্পানির বিরুদ্ধে অন্তত ৩শ’ জনের কাছ থেকে বহু টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। আর ডেসটিনি নামের এমএলএম কোম্পানিটির বিরুদ্ধে সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান লে. জে. (অব) হারুন-অর-রশীদের ইমেজকে কাজে লাগিয়ে শত শত মানুষের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
×