ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

স্টাইলিশ ট্রেন্ড পোশাকে লোকশিল্প

প্রকাশিত: ০৭:৫৪, ৯ মার্চ ২০১৮

 স্টাইলিশ ট্রেন্ড পোশাকে লোকশিল্প

ব্যবহারিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য লোকশিল্পের উদ্ভাবন। এসব প্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরি করতে গিয়ে সুন্দর করে তৈরি করা হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের মনের রং ও হৃদয়ের স্পর্শ লেগেছে। লোকশিল্পের প্রধান পরিচয় হলো এর প্রতীকে এবং মোটিফে। প্রাচীন পূজা-সংস্কার, আঞ্চলিক আচার-উৎসবের ধারা প্রতীক ও মোটিফের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। অর্থাৎ লোকশিল্পের এক মুখ অতীতের স্মৃতি রোমন্থনের দিকে আর অপর মুখ বর্তমান জীবনের নিত্যকার প্রয়োজন সাধনের দিকে। এই দুই ধারার সংযোগ রক্ষা করে চলেছে ঐতিহ্যবোধ। সাধারণত চিন্তা-ভাবনা ও ইচ্ছার বিষয়গুলো প্রতীকের সাহায্যে রূপলাভ করে। বাংলার আলপনায় এর প্রমাণ রয়েছে। বাস্তব হোক বা কাল্পনিক, একটি নির্দিষ্ট রূপরীতি সাধারণ মানুষের কাছে স্বীকৃতি লাভ করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে-লোকশিল্পকলায় এটাই মোটিফ! মোটিফ বা নকশা কখনও লোপ পায় না, কারণ স্মৃতিতে টিকে থাকার ক্ষমতা আছে বলেই তা মোটিফ হিসেবে মর্যাদা পায়। বাংলা লোকশিল্পে ব্যবহৃত মোটিফ ও নকশার অন্ত নেই! শিল্পীরা যখন যে অবস্থার অনুকূলে অবস্থান করেছেন, তখন অবলীলায় সেটি অনুকরণ করেছেন বা তার নতুন রূপ সৃষ্টি করেছেন। লোকশিল্পের মোটিফ ও নকশার আদি উৎস অনুসন্ধান করে দেখা গেছে যে, লোকশিল্পীরা প্রধানাত প্রকৃতির অনুকরণ ও অনুসরণকেই প্রাধান্য দিয়েছেন বেশি। বাংলার লোকশিল্পে কিছু স্বতন্ত্র মোটিফ দেখতে পাওয়া যায়। যেমন পদ্ম, কলকা, সজীব গাছ, বর্ফি, বুটি, পুষ্পিত লতা, পেঁচানো ফুল, পেঁচানো রেখা, এককেন্দ্রিক বৃত্ত ইত্যাদি। পদ্ম বাংলার নিজস্ব ফুল। পুকুর, ডোবা, খাল, বিল, হাওড়ে পদ্ম-শাপলার কমতি নেই! সুতরাং শিল্পে পদ্ম আঁকার প্রেরণাটা এসেছে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে। সাধারণভাবে পদ্ম সৌন্দর্যের প্রতীক। লোকশিল্পের মধ্যে কাঁথা, আলপনা ও ভাস্করণে পদ্মচক্র মোটিফটি বেশি দেখা যায়। পদ্মের মতো রয়েছে আরও বেশি ক’টি মোটিফ যেগুলো অতীতে তো বটেই বর্তমানেও বহুল প্রচলিত। যেমন- কলকা : বাংলার শিল্পে কলকার আগমন মধ্যযুগে, তুর্কি মুসলমানদের সঙ্গে। আবার এটাও বলা হয় যে শিমের বিচি থেকে কলকা নকশার আইডিয়াটা আসে। কলকার উৎপত্তি যেটাই হোক না কেন, এটি বেশ জনপ্রিয়। সাধারণত পুরো নকশার ফাঁকে ফাঁকে বা কোনায় কলকা স্থান পায়। নকশিকাঁথা ও আলপনায় কলকার ব্যবহার বেশি। পোশাকেও এর ব্যবহার রয়েছে যথেষ্ট। বিশেষ করে হাতের কাজের বা সূচিনকশার পোশাকে কলকার মোটিফ ব্যবহার করা হয় বেশি। এটা ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের পোশাকেই করা যায় বলে ফতুয়া, পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ, শাড়ি ইত্যাদিতে কলকা মোটিফ খুব বেশি চোখে পড়ে। বর্ফি : আরেকটি জনপ্রিয় মোটিফ হলে বর্ফি। বর্ফিও মধ্যযুগের অবদান। কাঠ, পাথর ইত্যাদির ভাস্কর্যের নকশায় বর্ফি মোটিফ বেশি দেখতে পাওয়া যায়। চারকোনা জ্যামিতিক ছক আকারের এই মোটিফটি কলকার মতোই ছেলে বা পেয়ে যে কেউ ব্যবহার করতে পারেন। পোশাকসহ যে কোন উপকথা বা উপস্বর্গের সৃষ্টি দিয়েছে নকশাটি। বুটি : বুটি বয়নশিল্পের জ্যামিতিক নকশা। লোকশিল্পের ভিড়ে পাখা ও পাটিতে বুটি দেখা যায়। পোশাকের ক্ষেত্রে জামাদানির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। একসময় শুধুমাত্র এই বুটি নকশা দিয়েই তৈরি করা হতো বুটিদার মসলিন ও জামদানি। বর্তমানের টাঙ্গাইল শাড়িতেও বুটি নকশা ব্যবহারের উদাহরণ বেশ পুরনো। এছাড়া কাপড়ে হাজার বুটি এ মোটিফেরই অবদান! বৃত্ত : বৃত্তও হলো একটি জ্যামিতিক নকশা। একই কেন্দ্রে একাধিক বৃত্ত এঁকে নকশা করা হয়। কখনও পদ্মপাপড়ি, কখনও পুষ্পিত লতা, কখনও রৈখিক জালি দিয়ে বৃত্তের মোটিফ আঁকা হয়। এ ধরনের নকশা মহেঞ্জোদারো-হরপ্পার আমল থেকে প্রচলিত রয়েছে। নকশিকাঁথায়, আলপনায় ও কাঠের কাজে এ ধরনের নকশা দেখা যায় বেশি। পোশাকেও বৃত্তাকারের নকশা অনেক বেশি ব্যবহার করা হয় বেশি। বিশেষ করে পাঞ্জাবি ও ফতুয়ার বুকে-পিঠে এবং শাড়ির আঁচলে এ ধরনের নকশা চোখে পড়ে বেশি। ফুল-লতা : ‘তরঙ্গিত পুষ্পিত লতা’ সাধারণত কোন বস্তুর কিনারে স্থান পায়। ফুল-পাতাসহ লতা এ নকশার উপাদান এবং তরঙ্গের ছন্দে এটি আঁকা হয়। নকশিকাঁথাসহ নানা ধরনের জিনিসে অলঙ্করণে এ মোটিফ ব্যবহার করা হয়। পোশাকের ক্ষেত্রে শাড়ি বা ওড়নার পাড়ে এ নকশা দেখা যায় বেশি। এছাড়া ‘পেঁচানো ফুল’ বা ‘পেঁচানো রেখা’ প্রধানত আলপনার মোটিফ। কাঁথা বা বিছানার চাদরের কিনারেও এ নকশার দেখা মেলে। পেঁচানো নকশা ইরানি চিত্রকলা অংশ। বাংলায় এ ধরনের নকশার আগমন প্রায় মধ্যযুগেই। সুদূর অতীত থেকে আজ পর্যন্ত এমন পেঁচানো রৈখিক মোটিফের ব্যবহার সমানভাবে রয়েছে। বিশেষ করে পোশাকের ব্যবহার হরদম করা হয়। শাড়ি, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, শার্ট, স্কার্ট, সালোয়ার-কামিজ ইত্যাদি প্রায় সব ধরনের পোশাকেই প্যাঁচানো নকশার ব্যবহার করা হয়। ছবি : সাকিব আহমেদ
×