ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আমি কি ভুলিতে পারি শিউলী আহমেদ

প্রকাশিত: ০৭:৪৩, ৯ মার্চ ২০১৮

আমি কি ভুলিতে পারি শিউলী আহমেদ

একুশে ফেব্রুয়ারির সকাল বেলা- সাদা-কালো শাড়ি পরে অফিসের উদ্দেশে বের হলাম। বিকেলে বইমেলা হয়ে বাসায় ফিরব। বের হতেই চোখে পড়ল ফুল আর আলপনায় সাজানো ছোট্ট শহীদ মিনারটা। চোখ ছলছল করে উঠল। আনমনে গুনগুন করে উঠলামÑ ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি...।’ এলাকার ছোট দরিদ্র ছেলেরা প্রতি বছরই এখানে এই শহীদ মিনারটি বানিয়ে সাজায়। আগের দিন তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাল আর টাকা তোলে। আগে ওরা আসলেই জানতে চাইতাম কাল ওরা কি কি করবে। চাকরির সুবাদে বাসায় না থাকায় এখন আর তা হয় না। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে একটু সামনে এগুতেই দেখি আরেকটি শহীদ মিনার। বাহ্্! কাছাকাছি ২টা! রিক্সায় উঠে কিছু দূর যেতেই দেখি সামান্য দূরত্বে আরও ২টা। এগুলো তেমন সাজানো নয়। ইট-বালি দিয়ে কোন রকমে দাঁড় করানো। সামনে কিছু ফুল। খুব ভাল লাগল সুন্দর না হোক, ছোট বাচ্চারা যে এইটুকুন করেছে এই তো অনেক। ওরা হয়ত ভাল করে জানেই না একুশে ফেব্রুয়ারি কি! হঠাৎ খেয়াল করলাম- প্রতিটা শহীদ মিনারই তৈরি করেছে শ্রমজীবীদের ছোট ছেলেরা। তাদের সঙ্গে সচ্ছল বা মধ্যবিত্ত পরিবারের কোন বাচ্চাও নেই। দেশপ্রেম কি তাহলে নিম্নবিত্তদের কাছে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে? আর অন্যরা ঘুরে বেড়িয়ে উৎসব পালনে ব্যস্ত হয়ে গেল? মনে পড়ে ছোটবেলার ভোরের আলো ফুটতেই প্রভাত ফেরির জন্য স্কুল ড্রেস পরে, খালি পায়ে স্কুলে যেতাম। বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে র‌্যালি বের করতাম। কৈশোরে খুব ভোরে অন্ধকার থাকতে সাদা-কালো শাড়ি পরে, খালি পায়ে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...’ গানটি গেয়ে গেয়ে শহীদ মিনারে যেতাম। মনের মধ্যে কেমন একটা শিহরণ জাগত। চোখে পানি এসে যেত। অন্য রকম একটা অনুভূতি কাজ করত। সবাই গলা ছেড়ে গাইত। প্রতিটা মানুষ খালি পায়ে। সাদা-কালো পোশাক পরা। সবার চোখেমুখে ভাষার প্রতি, ভাষা শহীদদের প্রতি দেশের প্রতি কি গভীর শ্রদ্ধা, ভালবাসা আর কৃতজ্ঞতা। সব মানুষ শহীদ মিনারকেন্দ্রিক, বিশাল লাইন করে সবাই শহীদ মিনারের দিকে ফুল নিয়ে এগোচ্ছে আর গাইছে- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি...’ তখন প্রায় প্রতিটা এলাকায় ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান হতো। রাত জেগে এলাকার বড় ভাইয়েরা শহীদ মিনার বানিয়ে ফুল দিয়ে সাজাত। কখনও কখনও আমরা মেয়েরাও তাদের কাজে সাহায্য করতাম। বিকেল থেকে শুরু হতো অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। এ এক অন্য রকম ভাল লাগা। আজকাল তা আর তেমন চোখে পড়ে না। সবার মাঝে সেই উত্তেজনাও নেই। এখন ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ মানে অন্য সব ছুটির দিনের মতো উৎসবমুখর একটা ছুটির দিন। সেই শ্রদ্ধা-ভক্তি, ভালবাসা তেমন একটা দেখা যায় না। শুধুই একটা উৎসবের দিন, বেড়ানোর দিন, প্রেমিক-প্রেমিকাদের সাদা-কালো পোশাক পরে সাজগোজ করে সারাদিন এক সঙ্গে কাটানোর একটা দিন। বড় ভাইয়েরা ব্যস্ত দলীয় কার্যক্রমে অংশ নিয়ে নিজেদের অবস্থান মজবুত করায়। এলাকায় বিশাল বিশাল সাউন্ড সিস্টেম দিয়ে ধুম-ধারাক্কা গানবাজনা নিয়ে। তবু ভাষার প্রতি, দেশের প্রতি যুগে যুগে ভালবাসা, শ্রদ্ধা-ভক্তি থাকবে। কিছু মানুষ থাকবে যাদের মাঝে বেঁচে থাকবে দেশ, বেঁচে থাকবে ভাষা।
×